করোনায় আক্রান্ত দক্ষিণ এশিয়া
লালন ফকির
কোভিড-১৯ ভাইরাসের সংক্রমণের আক্রান্ত এবং মৃত্যুর তালিকায় প্রথম স্থানে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।এই সংক্রমণপর্বে প্রথম দিকে ইয়োরোপের দেশগুলি, বিশেষত ইতালি, ফ্রান্স, ব্রিটেন প্রভৃতি দেশ থাকলেও পররবর্তীকালে এর পরিবর্তন ঘটে এবং দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ স্থানে চলে আসে ব্রাজিল, ভারত ও রাশিয়া। অর্থাৎ প্রাথমিকপর্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইয়োরোপ এর এপিসেন্টার থাকলেও বর্তমানে ব্রাজিল ও ভারত এই স্থান নিয়েছে। ভারতে গত ৬ জুলাই কেন্দ্রীয় স্বাস্হ্য মন্ত্রক প্রকাশিত পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, এই ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা হলো ৬ লক্ষ ১৭ হাজার ৪৯৩জন এবং মৃতের সংখ্যা ১৯ হাজার ৬৯৩ জন।ভারতে প্রথম সংক্রমণ শুরু হয় ৩০ জানুয়ারি। বিশেষজ্ঞদের মতে এই সময়ে সংক্রমণের বৃদ্ধির হার যদি অব্যাহত থাকে তাহলে চলতি মাসের শেষেই সংক্রমণের সংখ্যা ১২ লক্ষ অতিক্রম করে যাবে। প্রসঙ্গত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম সংক্রমণ শুরু হয় ২৩ জানুয়ারি। জুলাই মাসের শুরুতে সংক্রমণের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৯ লক্ষ ৬৫হাজার ৮৯৭ জন এবং মৃতের সংখ্যা ১ লক্ষ ৩২ হাজার। ব্রাজিলে প্রথম সংক্রমণ শুরু হয় ২৬ ফেব্রুয়ারি। বর্তমানে মোট সংক্রমিতের সংখ্যা ১৬ লক্ষ ৪ হাজার ৫৮৫ জন এবং মৃতের সংখ্যা ৬৪ হাজার ৯০০ জন। চতুর্থ স্থানে অবস্থানরত রাশিয়ায় প্রথম সংক্রমণের ঘটনা ঘটে ৩১ জানুয়ারি। বর্তমানে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা যথাক্রমে ৬লক্ষ ৮৭ হাজার ৮৬২ জন এবং ১০ হাজার ২৯৬ জন। লক্ষণীয় বিষয় হলো, চীনে প্রথম সংক্রমণ ঘটে ২০১৯ সালের ৭ নভেম্বর, একসময়ে প্রথম স্থানে থাকলেও বর্তমানে তার স্থান ২২তম। মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৮৩ হাজার ৫৫৭ জন ( যার মধ্যে ৭৮ হাজার ৫৭৮ জন ইতিমধ্যেই সুস্থ ) মারা গেছেন ৪ হাজার ৬৩৪ জন।
ভারতে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে ৪ দফায় ১০০ দিনের বেশি সময় ধরে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছিল।কিন্তু তাকে কঠোরভাবে কার্যকর করতে প্রশাসনিক উদ্যোগ যথেষ্ট ছিল না। এই কারণে সরকারি তথ্যে দেখা যায় যে, করোনা সংক্রমণ ১ লক্ষ থেকে ২ লক্ষে পৌঁছতে সময় লেগেছে ১০ দিন কিন্তু ২ থেকে ৩ লক্ষে পৌঁছতে সময় লেগেছে ৭ দিন, ৫ থেকে ৬ লক্ষে পৌঁছতে লেগেছে ৫ দিন, আর ৬ লক্ষ থেকে ৭ লক্ষে পৌঁছতে লেগেছে ৪ দিন। এই হারে সংক্রমণ বাড়তে থাকলে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে ব্রাজিলকে অতিক্রম করে যাবে ভারত। কোভিড মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় সরকার এবং বিভিন্ন রাজ্য সরকারের চূড়ান্ত ব্যর্থতা ব্যাপকভাবে প্রকট হয়েছে। একমাত্র ব্যতিক্রম বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট পরিচালিত কেরালা সরকার। এই রাজ্যে জনস্বাস্থ্যের কাঠামো যথেষ্ট মজবুত বলেই করোনার আক্রমণ ভয়াবহ হতে পারেনি। কিন্তু অন্যদিকে অর্থনৈতিক দিক থেকে সমৃদ্ধশালী রাজ্য বলে পরিচিত মহারাষ্ট্র এবং গুজরাট করোনায় আক্রান্ত এবং মৃতের তালিকার নিরিখে যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। ভারতে করোনা আক্রমণের পর্যালোচনাতে দেখা গেছে স্বাস্হ্য ব্যবস্থা সরকারি নিয়ন্ত্রণে থাকলে মানুষকে রক্ষা করা সম্ভব। কেরালা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। অন্যদিকে সামগ্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থা বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলে দিলে জনগণের যে কি দুরবস্থা হয় - মহারাষ্ট্র, গুজরাট তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। এশিয়া বা লাতিন আমেরিকার দেশগুলির মধ্যে কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে ভিয়েতনাম,দক্ষিণ কোরিয়া, ভেনেজুয়েলা এবং কিউবা।
দক্ষিণ এশিয়ার আক্রান্ত দেশগুলির মধ্যে রয়েছে পাকিস্তান, বাংলাদেশ,নেপাল প্রভৃতি। পাক সরকার জাতীয় লকডাউন প্রত্যাহার করে নেয় ৯জুন। এই তুলে নেওয়ার একমাসের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা ১ লক্ষ ছাড়িয়ে যায়। যদিও পাক সরকার ভালভাবেই জানে যে, প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা এর থেকে অনেক বেশি। জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে সরকার প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, অন্তত প্রায় আড়াই হাজার মানুষ কোভিড ১৯ আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। বিশ্ব স্বাস্হ্য সংস্থার মতে কোভিড ১৯ আক্রান্তের নিরিখে বিশ্বের প্রথম দশটি দেশ যেখানে কার্যত ভয়ঙ্কর চেহারা নিয়েছে, পাকিস্তান তার অন্যতম।পাক সরকারকে লেখা এক তথ্যে লকডাউন তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্তের কঠোর নিন্দা করেছে হু (বিশ্ব স্বাস্হ্য সংস্থা)। শুধু তাই নয়, কোভিড ১৯ মোকাবিলায় যেসব ব্যবস্থা পাক সরকার গ্রহণ করেছে তাও যথেষ্ট নয় বলে হু সমালোচনা করেছে। বিশেষত, হু যে সব নির্দেশিকা দিয়েছিল পাক সরকার তা কার্যকর না করায় বিশ্ব স্বাস্হ্য সংস্থার সমালোচনার মুখে পড়েছে। পাক বিশেষজ্ঞরা জুন মাসেই সরকারের অযোগ্যতা এবং অপদার্থতার কঠোর সমালোচনা করে বলেছিল, সরকার যদি তার ভূমিকা সংশোধন না করে তাহলে জুলাই আগস্ট মাসের মধ্যে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা ১ লক্ষ অতিক্রম করে যাবে। ইতিমধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ লক্ষ ৪৮ হাজার ৮৭২। মৃতের সংখ্যা ৫,১৯৭। বিশেষজ্ঞদের মতে, পাকিস্তানের স্বাস্থ্য পরিকাঠামো এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় উপযুক্ত নয়। এই সময়ের মধ্যে আক্রান্তদের পরীক্ষানিরীক্ষা খুবই কম হয়েছে। চিকিৎসকদের মৃত্যুহার দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বাধিক।
জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে পাঞ্জাব প্রদেশের মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, কোভিড রোগীদের চিকিৎসায় যে সমস্ত ডাক্তার যুক্ত আছেন তাঁদের ৪০ শতাংশের বেশি আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন। বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, দেশের বিভিন্ন প্রান্তের হাসপাতালে বেড না পাওয়া বা চিকিৎসার সরঞ্জামের অভাব থাকায় স্বাস্হ্যকর্মীরা কোভিড ১৯ রোগীদের আত্মীয় স্বজনদের দ্বারা একাধিকবার আক্রান্ত হয়েছেন। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, করাচিতে বসবাসকারী দু’কোটি মানুষের জন্য ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিটের শয্যার সংখ্যা মাত্র ৬০০।
বিশ্ব স্বাস্হ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী জনসংখ্যার নিরিখে পাকিস্তান বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম দেশ। কিন্তু সেখানে আধুনিক এবং সচল ভেন্টিলেটরের সংখ্যা মাত্র ৭৫০। পাক প্রধানমন্ত্রী প্রাথমিকস্তরে লকডাউন ঘোষণার বিরোধী ছিলেন। তিনি অর্থনীতিতে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে অতিমারী মোকাবিলার প্রশ্নে উদাসীন ছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন, পাকিস্তানের মতো দেশে লকডাউন ঘোষণা ‘বিলাসিতা’ ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু পরে সামরিক প্রশাসন এবং প্রধানমন্ত্রী ঐকমত্য হয়ে লকডাউনের সিদ্ধান্ত নেন। বিশ্ব ব্যাঙ্কের পূর্বাভাস হলো, পাক অর্থনীতি আগামী আর্থিক বর্ষে ০.২ শতাংশ হারে সংকুচিত হবে। একই সাথে পূর্বাভাসে এও বলা হয়েছে, দেশের ৭ কোটি ৪০ লক্ষ কাজের মধ্যে ১ কোটি ৮০ লক্ষ কাজ নষ্ট হবে।
দক্ষিণ এশিয়ার অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হলো বাংলাদেশ। এই দেশটি কোভিড ১৯ দ্বারা মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বাংলাদেশে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৭০ হাজার। বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন এই সংখ্যা জুলাই মাসের পূর্বেই দ্বিগুণ হবে এবং তা হয়েওছে। বাংলাদেশে কোভিড পরীক্ষার সুযোগ খুবই কম। রাজধানী ঢাকায় প্রতি পাঁচ জনের পরীক্ষা পিছু একজন করোনা পজিটিভ পাওয়া গেছে। সরকারিভাবে মৃত্যুর যে হিসাব দেওয়া হয়েছে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক স্তরে - বিশেষজ্ঞরা তা মানতে রাজি নন। বাংলাদেশে সারা বিশ্বের মধ্যে জনপ্রতি হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা সবথেকে কম। ইতিমধ্যে ১ হাজারের বেশি মানুষ কোভিডে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন, যার মধ্যে ৩৪ জন ডাক্তার। কিন্তু দেশের বিভিন্ন মহলের পক্ষ থেকে এই সংখ্যার ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করা হয়েছে। দেশে মার্চ মাসের শেষে লকডাউন জারি করা হয়েছিল এবং জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। প্রত্যাহার করার সময়ে করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি অব্যাহত ছিল।
দক্ষিণ এশিয়ার অপর একটি দেশ নেপালেও সংক্রমণ হয়েছে। বিভিন্ন দেশের সংক্রমণের চিত্র থেকে এটি স্পষ্ট যে, স্বাস্হ্য পরিষেবার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিয়য়টি থেকে সরকার ক্রমান্বয়ে হাত গুটিয়ে নিচ্ছে, তার পরিণতিতে এই সঙ্কট। ভারতের ক্ষেত্রে কেরালার ভিন্ন চিত্র এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কিউবা, ভিয়েতনামের ট্র্যাক রেকর্ড তা প্রমাণ করছে।