E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

হলোকাস্ট থেকে গাজা স্ট্রিপ

আকাশ কর


অউশভিৎজ কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে মুক্ত শিশুরা।

পোল্যান্ডের অউশভিৎজ কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে নাৎসি এসএস গার্ডদের সামনে গান গাইতে এসেছেন এক ইহুদি তরুণী। মৃত্যুর আগ মুহূর্তে সুন্দরী তরুণীদের থেকে গান শোনাটাই ছিল নাৎসি বাহিনীর অফিসারদের বিকট বিনোদন। পরের দিন গ্যাস চেম্বারে পুরে দেওয়া হবে বলে নির্ধারিত হেলেনা সিট্রোনোভাকে গান গাইতে হলো চোখের জলে। ফ্রান্‌ৎজ ভুঙ্ক নামের এক অফিসার শুনলেন সে গান। কী যেন ঘটে গেল তার ভেতরে। কৌশলে হেলেনার গ্যাস চেম্বার যাত্রা আটকে দিল সে। পরের দিনই একটা ছোট্ট চিরকুট পেলেন হেলেনা। ফ্রান্‌ৎজ লিখলেন পৃথিবীর সবচেয়ে আশ্চর্য সেই কথা - তোমাকে ভালোবাসি। স্বজন হত্যাকারী নাৎসি বাহিনীর একজনের থেকে প্রেমের প্রস্তাবে রাগে ফেটে পড়লেন হেলেনা। ছিঁড়ে ফেলে দিলেন সেই চিরকুট। তবে ‘ভালোবাসি’ শব্দটির কী যেন এক সম্মোহনী শক্তি আছে, যা ঘটার নয়, তাই ঘটায়। ক্রমে প্রেমে পড়লেন ইহুদি তরুণীও। মৃত্যুর জান্তব উল্লাস আর কান্না-চাপা ভারি বাতাসের ভেতর কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পূর্বরাগে মাতলেন এক নাৎসি তরুণ ও এক ইহুদি তরুণী। কড়া নজরদারির মধ্যেই চললো তাদের গোপন প্রণয়পর্ব। হেলেনাকে তো বটেই, তার বোনকেও বারবার নিশ্চিত মৃত্যুর থেকে বাঁচিয়ে আনলেন ফ্রান্‌ৎজ। যে হাত একবারও কাঁপেনি হাজার হাজার মানুষের জীবন নিতে। প্রেম এসে জড়িয়ে ধরল হাত। দুটো জীবন দিলেন তিনিই। এরপর ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে একে একে কনসেনট্রেশন ক্যাম্প থেকে বন্দি ইহুদিদের উদ্ধার করল সোভিয়েতের রেড আর্মি। ভয়াবহতার কথা শুনে শিউরে উঠল দুনিয়া। নাৎসি এসএস গার্ডরা গণহত্যার প্রমাণ যথাসম্ভব লোপাট করে পালালেন এদিক ওদিক। মুক্তি পেয়ে এদিক ওদিক ধাক্কা খেয়ে শেষমেষ, বোন রেজিনাকে নিয়ে পূর্ব ইয়োরোপের দিকে পাড়ি দিলেন হেলেনা। উঠলেন, ইজরায়েলে এসে। এদিকে, ধরা পড়লেন ফ্রান্‌ৎজ ভুঙ্ক। ১৯৭২ সালে বিচার শুরু হলো তার। খবর পেয়ে ২৭ বছর পর ইজরায়েল থেকে বোনকে নিয়ে অস্ট্রিয়ার আদালতে ছুটে এলেন হেলেনা। ২৭ বছর পর ফের দেখা হলো দুজনের। সাক্ষ্য দিলেন, কীভাবে ফ্রান্‌ৎজ বাঁচিয়েছিল তাঁদের দুই বোনকে। তার বিরুদ্ধে তীব্র অত্যাচারের প্রমাণ থাকলেও এই সাক্ষ্য তাকে বাঁচিয়ে দিল নিশ্চিত মৃত্যুদণ্ড থেকে। মোহব্বতের কসম খেয়ে জান বাঁচানোর শুভ মহরৎ ফিরে এলো। একদিন যার প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন তার সাক্ষ্যেই প্রাণ গেল না ফ্রান্‌ৎজ-এর। অলক্ষ্যে হাসল মহাকাল। আজ ফের ফিরে এলো ইতিহাস।

একদিন কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পচছিল যে ইহুদিরা। হেলেনার মতো তাদেরই অনেকের ঠাঁই হয়েছিল প্যালেস্তাইনের বুকের ভেতর আরেক পৃথক ভূখণ্ড ইজরায়েলে। আজ সেই তাদেরই উত্তর প্রজন্মের একাংশ জাতিসত্তার অন্ধত্বে নেমেছে প্যালেস্তাইন দখলের শেষ যুদ্ধে। ইতিহাস ফিরে ফিরে আসে। নির্মম থেকে নির্মমতর হয়ে ফিরে আসে। প্রাচীন গ্রিক ভাষায় ‘হলোকস্টাস’ শব্দের অর্থ পোড়ানোর মাধ্যমে বলিদান। এর থেকেই এসেছে ‘হলোকাস্ট’ শব্দটি। ইহুদিরা হিব্রুতে একে অভিহিত করে ‘শোহ’ (shoah) শব্দটির মাধ্যমে। যার অর্থ বিপর্যয়। ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে হিটলারের নাৎসি পার্টির নেতৃত্বে ইহুদিদের উপর যে নারকীয় গণহত্যা নেমে এসেছিল তাকে ইতিহাস চিহ্নিত করেছে হলোকাস্ট হিসেবে। সরাসরি খুন করে কিংবা কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে এনে হত্যা করে সর্বমোট ৬০ লাখের কাছাকাছি ইহুদিকে হত্যা করা হয়েছিল এই সময়ে। একটি জাতিকে সম্পূর্ণ নির্মূল করে, বিশুদ্ধ রক্তের জার্মান গড়ার ডাকেই আয়োজিত হয়েছিল এই নরবলি যজ্ঞ। হিটলারের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের নারকীয়তার ভয় দেখিয়ে আজও ঘুম পাড়ানো হয় ইয়োরোপের শিশুদের। ফুল বিছানো পথে হাঁটিয়ে নিয়ে গিয়ে গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে খুন কিংবা এক ঘরে অনেককে আটকে রেখে তাতে সায়ানাইড-যুক্ত জিকলন-বি প্রবেশ করিয়ে শ্বাসরোধ করে মারা অথবা স্নানের সময়ে শাওয়ার থেকে কার্বন মনোক্সাইড দিয়ে নিকেশ করার মতো উদ্ভাবনী এবং ভয়ংকর ঘটনা ক্ষত তৈরি করেছে মানব ইতিহাসে। শুধু অউশভিৎজ এর ক্যাম্পেই এক দিনে চার হাজার শিশুকে একসাথে খুন করা হয়েছিল। বোঝাই যায় ভয়াবহতার পরিমাণ। এক সময়ে মাটি কম পড়ে গিয়েছিল কবর দেওয়ার জন্য। বিশ শতকের প্রথম থেকেই ইয়োরোপ জুড়ে ইহুদিরা জাতিবিদ্বেষের শিকার হয়। বিভিন্ন দেশে তাদের উপর অত্যাচার করা হয় এবং তাড়িয়ে দেওয়া হয়। ক্রমেই বাড়তে থাকে ইহুদি রিফিউজির সংখ্যা। ইহুদিরা বিশ্বাস করত, বাইবেলে বর্ণিত পিতৃপুরুষ আব্রাহাম এবং তার বংশধরদের জন্য যে পবিত্রভূমির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল তা অবস্থিত মধ্যপ্রাচ্যের ফিলিস্তিন অঞ্চলেই। যেখানে অবস্থিত জেরুজালেম। ফলে, হাজার হাজার ইহুদি রিফিউজি এসে বসতি গড়তে শুরু করল সেখানেই। সেখানে বসবাসকারী আরব ও মুসলিমদের সঙ্গে ধীরে ধীরে এই অভিবাসন নিয়েই বিবাদের পরিস্থিতি তৈরি হলো ইহুদিদের। সেই সময় প্যালেস্তাইন বা ফিলিস্তিন ছিল তুর্কী অটোমান সাম্রাজ্যের অধীন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তুর্কী অটোমান সাম্রাজ্য কার্যত ভেঙে পড়ে। এই পরিস্থিতি সামলাতে তখন যে লিগ অব নেশন গঠিত হয়েছিল, সেই বিশ্ব সংস্থার পক্ষ থেকে ব্রিটেনকে দায়িত্ব দেওয়া হয় প্যালেস্তাইন শাসন করার। এর ফলে আরও দলে দলে নিপীড়িত ইহুদিরা আসতে শুরু করে এখানে। জাতিবিদ্বেষ আর সাম্রাজ্যবাদের আঁতুরঘর ইয়োরোপে নির্মিত হয়েছিল ইহুদিদের উপর নির্মমতার ইতিহাস। অথচ, নিজেদের পাপের দায় নিজেরা নিল না ইয়োরোপ। প্রায়শ্চিত্ত করতে বেছে নেওয়া হলো এশিয়া মহাদেশের মধ্য প্রাচ্যকে।

আজকের গাজা।

জাতিবিদ্বেষের শিকার হওয়ার গোড়া থেকেই ইহুদিদের মধ্যে গড়ে ওঠে 'ইহুদিতত্ত্ব' বা 'জায়নবাদ'। তখন যা ছিল নিপীড়িত মানুষের আত্মশক্তিকে একত্রিত করে পুনর্জাগরণের মন্ত্র। সেই মন্ত্রই আজ প্যালেস্তাইন দখল করে সেখানকার আদি বাসিন্দাদের নিধনের মতবাদ হয়ে উঠেছে রাজনীতিকদের হাতে। হলোকাস্টের পর বিশ্বজুড়ে ইহুদিদের পৃথক রাষ্ট্রের দাবি জোরালো হলে ইয়োরোপের কোথাও না, বরং ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণে থাকাকালীন প্যালেস্তাইন ভূখণ্ডের ভেতরেই ভারতের স্বাধীনতার এক বছর পর ১৯৪৮ সালের ১৪ মে স্বাধীন রাষ্ট্রের ঘোষণা করে ইজরায়েল। তবে তারপরের দিনই মিশর, জর্ডন, সিরিয়া এবং ইরাক মিলে অভিযান চালায় ব্রিটেনের অধীনে থাকা ‘ইজরায়েল’ নামের ওই অঞ্চলে। সেটাই ছিল ইতিহাসের প্রথম আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ। জাতিসংঘ প্যালেস্তাইনে আরবদের জন্য একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় যে অঞ্চলটি বরাদ্দ করেছিল, এই যুদ্ধের পর তার অর্ধেকটাই চলে যায় ইজরায়েল বা ইহুদিদের দখলে। ফিলিস্তিনের জাতীয় বিপর্যয়ের শুরু সেখান থেকে। এটিকেই তারা বলে ‘নাকবা’ বা বিপর্যয়। প্রায় সাড়ে সাত লাখ ফিলিস্তিনিকে পালিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নিতে হয়। ইহুদি বাহিনী তাদেরকে বাড়ি-ঘর থেকে উচ্ছেদ করে, খুন করে। এ বিবাদ যদিও পুরোনো। জেরুজালেমকে কেন্দ্র করেই ‘ক্রুসেড’ ঘটেছিল। ইসলাম ও খ্রিস্টান ধর্মের সেই পুরোনো বিবাদই মোড় নিল রাজনৈতিক বিবাদে। আক্রান্ত ইহুদিদের সামনে রেখে ফিলিস্তিনের আরব ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার নীলনকশা তৈরি করেছিল সেদিনের ইয়োরোপ। সেই নকশা অনুযায়ী এরপর ১৯৫৬, ১৯৬৭, ১৯৭৩, ২০০৮, ২০০৯, ২০১২ সাল - বারবার যুদ্ধে জড়িয়েছে দুই পক্ষ। দখল-পুনর্দখলের লড়াইতে প্রাণ গিয়েছে হাজার হাজার মানুষের। এর মধ্যে জাতিসংঘ, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আদালত বিভিন্ন সমাধান সূত্র দেওয়ার চেষ্টা করলেও কাজের কাজ কিছু হয়নি। জাতিসংঘর ফয়সালা অনুযায়ী ভূখণ্ড পায়নি প্যালেস্তাইন। তাদের পেটের ভেতর অভিবাসন করে দেশ বানিয়ে ফেলেছে ইজরায়েল। প্যালেস্তাইন বলতে এখন দু-প্রান্তে গাজা আর ওয়েস্ট ব্যাংক। মাঝখানে অবরুদ্ধ করে রাখা ইজরায়েল। অথচ, সাধারণ পরিষদের ১৯২টি দেশের ১৩৪টি দেশের মত থাকলেও মানে, ৭০ ভাগ সদস্য রাষ্ট্রই প্যালেস্তাইনকে একটি রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকার করে নিলেও আমেরিকা ও ইয়োরোপের একাংশের চাপে জাতিসংঘ একে স্বীকৃতি দেয়নি। এদিকে দীর্ঘদিন ধরে সমাধান ও শান্তি আলোচনার অপেক্ষায় থাকা, আক্রান্ত রক্তাক্ত স্বাভাবিক জীবন থেকে বঞ্চিত প্যালেস্তাইনের মানুষ স্বাধীনতার জন্য অধীর হয়েছে। তারা ডাক দিয়েছে দ্য গ্রেট মার্চ টু রিটার্ন-এর।

গত কয়েক বছর ধরে লাগাতার অস্থিরতার পর, এ বছর ৭ অক্টোবর থেকে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ শুরু হলো ইজরায়েল এবং প্যালেস্তাইনের মধ্যে। ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ঘোষণা করলেন চুড়ান্ত সমাধানের। কি সেই সমাধান? মানচিত্রের বুকে প্যালেস্তাইন বলে কোনো দেশই আর থাকবে না। এমনিতেই প্যালেস্তাইনের মানচিত্রে ক্রমহ্রাসমান ছবিগুলি সামনে এসেছে তাতে দেখা যাচ্ছে উইপোকার মতো কীভাবে সেখানকার আদি বাসিন্দাদের হঠিয়ে ভূখণ্ড দখল করেছে ইজরায়েল। এখন পড়ে আছে কেবল গাজা স্ট্রিপ এবং ওয়েস্ট ব্যাংক। মাত্র ৭ কিলোমিটার চওড়া ও ৪৫ কিলোমিটার লম্বা গাজা স্ট্রিপে ঠাসাঠাসি করে বাস করেন ১৯ লাখ ফিলিস্তিনি। ওয়েস্ট ব্যাংকে প্রায় ২৪ লাখ। বাকিদের পূর্বপুরুষরা নিগৃহীত হয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন অন্য দেশে। এরা যেতে পারেননি স্বদেশের মাটি ছেড়ে। চোখে স্বপ্ন ছিল পুরোনো দেশ ফিরে পাবার। কিন্তু এখন ইজরায়েল ঝাঁপিয়ে পড়েছে ভবিষ্যতের ইতিহাস থেকে প্যালেস্তাইন নামটাই নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার লক্ষ্যে। সেজন্যেই গাজা স্ট্রিপ লক্ষ্য করে টানা হামলা চলছে। চারদিক থেকে অবরুদ্ধ করে রেখে, বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে রেখে, জল, খাবার সমস্ত কিছু আটকে দিয়ে আকাশপথে ক্রমাগত মিসাইল হামলা করে মৃত্যুপুরী বানানো। বাদ যায়নি হাসপাতালও। গাজার সবচেয়ে বড়ো যে হাসপাতাল আল শিফায় প্রতি ৫ মিনিটে এক জন নাগরিকের মৃত্যু ঘটছে, সেই হাসপাতাল ঘিরে ফেলেছিল ইজরায়েলি ট্যাংক। হাসপাতালের ভেতরে সারি সারি শিশুদের মৃতদেহের মধ্য থেকেই ফোনের ব্যাটারি শেষ হয়ে যাওয়া পর্যন্ত গোটা বিশ্বের কাছে সাহায্য চাইছিলেন সেখানকার সুপার। শেষমেষ সবাইকে মেরে ভেতরে ঢুকেছে ইজরায়েলি সেনা। গোটা গাজাস্ট্রিপের দখল নিতে চলেছে তারা। এ হামলার ভয়াবহতা লিখে প্রকাশ করা অসম্ভব। চেষ্টা করতে গেলে এ লেখা শেষই হবে না কোনোদিন। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও অসম লড়াই ছেড়ে এখনও যাননি প্যালেস্তাইনের মানুষ। ওই যে, পরাজয় আসন্ন জেনেও কিছু লড়াই লড়ে যেতে হয় ইতিহাসকে এইটা জানানোর জন্য যে, সবাই বিনাবাক্যে সব মেনে নেয়নি। লড়ছে গাজার এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড়ো গোষ্ঠী হামাসও।

কীভাবে জন্ম নিল হামাস? প্যালেস্তাইনের মুক্তিকামী নেতা ইয়াসের আরাফাতের নেতৃত্বে যখন প্যালেস্তাইনের রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলির সমন্বয় পিএলও গোটা বিশ্বের কাছে দরবার করে তাদের এই সমস্যা মেটানোর চেষ্টা করছে, তখনই আত্মপ্রকাশ এই হামাস গোষ্ঠীর। তাদের দাবি ছিল কোনো আলোচনা নয়, চাই সরাসরি যুদ্ধ। পৃথিবীর কাছে এবং প্যালেস্তাইনের সাধারণ মানুষের কাছে ক্রমশ জনপ্রিয় হতে থাকা আরাফাতকে ঠেকাতে এই হামাসের উত্থানকেই মদত দিয়েছিল সাম্রাজ্যবাদীরা। ঠিক যেভাবে বিভিন্ন জায়গায় রাজনৈতিক বিরোধীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীকে নিজেদের হাতে তৈরি করে এখন তাদের শত্রু হিসেবে দাঁড় করিয়ে রেখেছে আমেরিকা। এভাবেই উত্থান চরমপন্থী হামাসের। যারা এখন গাজা ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ করে। প্যালেস্তাইনের মুক্তি সংগ্রামকে যে পথে তারা পরিচালিত করছে সেটাও মোটেই সবক্ষেত্রে সমর্থনযোগ্য নয়। তাদের কামানের নিশানাও মাঝে মাঝেই ঘুরে যাচ্ছে সৈন্য সামন্তের বদলে সাধারণ ইজরায়েলিদের দিকে। আমেরিকা গোড়া থেকেই ইহুদিদের পৃথক রাষ্ট্র ইজরায়েলের পক্ষে। ক্লিনটন, বুশরা কখনো কখনো দুই দেশের সমস্যায় মধ্যস্ততার চেষ্টা করলেও ট্রাম্প ক্ষমতায় এসে ইজরায়েলে মার্কিন দূতাবাস সরিয়ে আনেন বিতর্কিত জেরুজালেমে। এই বার্তা দিতে যে, জেরুজালেম ইজরায়েলেরই। বাইডেন সরেননি সে নীতি থেকে। ক্রমাগত ইজরায়েলি আগ্রাসনকে মদত করে গেছে আমেরিকা। প্রথমত তেলের খনি মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার গেটওয়ে এই ইজরায়েল। এ ছাড়াও যুদ্ধবাজ দেশকে অস্ত্র সরবরাহ করে মোটা টাকা ঘরে তোলে তারা। আর আমেরিকার বরাবরের নীতি মধ্যপ্রাচ্য সহ এশিয়ার বড়ো অংশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বজায় রাখা। যারা তাদের পায়ে এসে পড়েনি তাদের ভালো থাকতে দেবে না তারা। তাই এখনও ভয়ংকর অস্ত্রের সমরসাজ নিয়ে প্যালেস্তাইনের উপর ইজরায়েলি আক্রমণে সঙ্গী আমেরিকা। গোটা বিশ্বে ইজরায়েলের পক্ষে জনমত গঠন করতেও চেষ্টার কসুর করছে না তারা।

১৯৩৮ সালের ২৬ নভেম্বর হরিজন পত্রিকায় মহাত্মা গান্ধী লিখেছিলেন, ‘ইংল্যান্ড যেরকম ব্রিটিশদের বা ফ্রান্স যেভাবে ফরাসিদের, সেই একই ভাবে ফিলিস্তিন আরবদের।’ তারপর থেকে এই বিবাদে ভারতবর্ষের অবস্থান সেটাই। প্রধানমন্ত্রী বদলেছে। সরকার বদলেছে। অবস্থান বদলায়নি। নেহরু থেকে রাজীব কিংবা ইন্দিরা গান্ধী হয়ে মনমোহন সিংহ পর্যন্ত, মাঝখানে বিভিন্ন কোয়ালিশন সরকার এমনকী অটল বিহারি বাজপেয়ীর নেতৃত্বে বিজেপি সরকারও থেকেছে প্যালেস্তাইনের পাশেই। ভারত সবসময় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিশ্বাস করেছে কোনো দেশের উপর সাম্রাজ্যবাদী খবরদারি বরদাস্ত করা যায় না এবং যে কোনো বিবাদই আলোচনার টেবিলে মেটানো যায়। প্যালেস্তাইনের ক্ষেত্রেও ভারতের অবস্থান ছিল সেখানকার আদি বাসিন্দাদের দেশ ও অধিকারের সাথে কোনোরকম কম্প্রোমাইজ না করেই মেটাতে হবে এই বিবাদ। এই প্রথম নরেন্দ্র মোদি সরে এলেন সেই অবস্থান থেকে। বিশ্বগুরু হওয়ার প্রবল বাসনায় মত্ত প্রধানমন্ত্রী ট্যুইট করলেন ইজরায়েলের পাশে দাঁড়িয়ে। এই যুদ্ধের আগেও অবশ্য নেতানিয়াহুর সঙ্গে প্রকাশ্য গলাগলি করতে কম দেখা যায়নি তাকে। যেন, আমেরিকার বন্ধু মানেই ভারতের বাই ডিফল্ট বন্ধু। একবার এক মার্কিন সংবাদমাধ্যমে ‘‘ফিডেল কাস্ত্রোর মতো ‘স্বৈরাচারীকে’ কেন সমর্থন করছেন’’ - এই প্রশ্নের উত্তরে নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, ‘‘আমেরিকাকে বুঝতে হবে, কেউ তাদের শত্রু হলেই সে সারা বিশ্বের শত্রু হয়ে যাবে না। কেউ মাথানত না করলেই তাকে স্বৈরাচারী বানানো যাবে না।’’ - মোদির নতুন ভারত এখন এই মন্ত্র থেকে দূরত্ব তৈরি করেছে। আসলে ইতিহাসের নিয়মে নিপীড়িত মানুষ জোট বাঁধতে যত না সময় নেয় তার চেয়ে অনেক দ্রুত জোট বাঁধতে পারে ফ্যাসিবাদীরা। প্যালেস্তাইন প্রশ্নে এক অদ্ভুত অবস্থান নিল ভারত। প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ্যে ইজরায়েলের পাশে। আরএসএস ‘মুসলিম নিধনকারী’ ইজরায়েলের হয়ে গলা ফাটাচ্ছে। তাদের কেউ কেউ তো হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেতেও উৎসাহী ছিলেন। গেছেন কিনা অবশ্য জানা নেই। বিজেপি চেষ্টা করছে লোকসভা ভোটের আগে প্যালেস্তাইন বিরোধী হাওয়া তুলে আসলে মুসলমানের বিরুদ্ধে হিন্দু ভোটকে সংহত করতে। অথচ ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের অফিশিয়াল স্ট্যান্ড কিন্তু তা নয়। সংঘর্ষ শুরুর পরে গত মাসেই রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভায় জর্ডনের আনা ইজরায়েল সংক্রান্ত একটি খসড়া প্রস্তাবের উপরে ভোটাভুটির সময়ে ভোটদানে বিরত ছিল ভারত। তবে গত ৯ নভেম্বর ইজরায়েলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যে নিন্দা প্রস্তাব রাষ্ট্রপুঞ্জে খসড়া আকারে গৃহীত হয়েছিল, তা প্রস্তাব আকারে আসলে ইজরায়েলের দখলদারির বিরুদ্ধেই ভোট দেয় ভারত। সঙ্গে আরও ১৪৪টি দেশ। তেল সরবরাহকারী দেশগুলিকে চাইলেও চটাতে পারছে না মোদি সরকার। এছাড়াও আমেরিকা ও ইয়োরোপের গোটা কয়েক দেশ ছাড়া কেউই শেষমেষ নেই ইজরায়েলের পাশে। যারা আছে সেই প্রশ্নে সে দেশের সরকারও বিপুল বিক্ষোভের মুখে পড়ছে হাজার হাজার মানুষের। এই আন্তর্জাতিক পরিবেশের মধ্যে দাঁড়িয়ে বুকের ভেতর নেতানিয়াহুর স্বৈরাচারী নীতির প্রতি প্রেম থাকলেও বুক ঠুকে তা ব্যক্ত করতে পারছে না সংঘ পরিবার পরিচালিত সরকার।

এই প্রতিবাদও ইতিহাসের পুনরুত্থান এবং বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। বিশুদ্ধ রক্তের জার্মান গড়ার ডাক দিয়ে ইহুদি নিধনের সময়ে যেমন জার্মানির সবাই হিটলারের পাশে দাঁড়ায়নি, যেমন ভারতের সব হিন্দুর সমর্থন নেই আরএসএস’র হিন্দুত্ববাদে তেমনই ইজরায়েলের সব মানুষও মোটেই দু-হাত তুলে সমর্থন জানাচ্ছেন না এই আগ্রাসী এই নয়া জায়নবাদকে। ৭ অক্টোবর নেতানিয়াহু প্যালেস্তাইনের সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণার পর ১২ অক্টোবর থেকেই ইজরায়েলের রাজপথে আছড়ে পড়েছে প্রতিবাদ। ইতিহাসের চাকা ঘুরে এসেছে। ক্ষমতা দখলের স্বার্থে যে ইহুদিদের নিকেশ করতে একদিন নাৎসিবাদের উত্থান ঘটেছিল। হলোকাস্টের ভয়াবহতা থেকে মুক্তি পেয়ে সেই ইহুদিদেরই একাংশ জায়নবাদের নামে নিরপরাধ আবাল বৃদ্ধ বনিতার উপর অত্যাচার নামিয়ে আনতে গিয়েছে প্যালেস্তাইনে। আর আমাদের দেশে তা দেখে হাততালি দিচ্ছে হিন্দুত্বের কারবারিরা। তিন মতবাদের মূলে আছে আগ্রাসন আর জাতিবিদ্বেষ। তিন মতবাদেরই ফলশ্রুতি একনায়কতন্ত্র। হিটলার টেকেনি। নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে একে একে এক হচ্ছে বিশ্বের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। শিক্ষা নেওয়া উচিত এ দেশেরও কারো কারোর।

জানিনা, গাজা স্ট্রিপের বিশাল কনসেনট্রেশান ক্যাম্পে হেলেনা আর ফ্রান্‌ৎজ-এর মতো কোনও সুঠাম ইজরায়েলি প্রেমে পড়বেন কিনা কোনো হিজাব টানা ফিলিস্তিনি তরুণীর! জানিনা তার স্বয়ংক্রিয় রাইফেল থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে গোলাপ বেরিয়ে আসবে কিনা কোনোদিন। জানিনা সেখানে শিশুদের কান্না থামবে কিনা। মিসাইলের অন্ধকার মুছে আর কোনোদিন ভোর হবে কিনা। দীপাবলিতে যখন আমাদের আকাশজুড়ে আতসবাজির রোশনাই, সেদেশের আকাশেও আলো। তবে মৃত্যুদূতের। আমাদের ভেবে দেখা দরকার, গতকাল যা জার্মান, আজ তা প্যালেস্তাইন। আগামীকাল আমার দেশ নয় তো! ভয় আছে। ভয় আছে। ভয় পাওয়ার মতো সমস্ত ব্যবস্থা করা হচ্ছে।