ওয়ারশ নেই, ন্যাটো কেন?
শান্তনু দে
‘‘আমরা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিতে চাই, পূর্ব দিকে ন্যাটোর আর কোনো অগ্রগতি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। আর এতে কী কোনো অস্পষ্টতা রয়েছে? আমরা কী মার্কিন সীমান্তের কাছে ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করতে গিয়েছি? না, আমরা তো যাইনি। বরং, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই তার ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে আমাদের ঘরে এসেছে, দাঁড়িয়ে আছে আমাদের দোরগোড়ায়। আমাদের ঘরের কাছে কোনো আঘাত করার ব্যবস্থা রাখা যাবে না, এই দাবি করা কী তাহলে ভুল হবে, খুব অস্বাভাবিক হবে?’’
সরাসরি প্রশ্ন তুলেছেন রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন। ২৩ ডিসেম্বর, ২০২১। বর্ষশেষের সাংবাদিক বৈঠকে। শ’পাঁচেক দেশি-বিদেশি সাংবাদিকের সামনে, আন্তর্জাতিক মহলের কাছে। আর এই বিবৃতিতেই স্পষ্ট রাশিয়া ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সাম্প্রতিক সংঘাতে আক্রমণকারী আসলে কে?
বার্লিন প্রাচীরের সামনে দাঁড়িয়ে ১৯৮৭’র ১২ জুন, মার্কিন রাষ্ট্রপতি রেগান ঘোষণা করেছিলেনঃ
‘সাধারণ সম্পাদক গর্বাচ্যভ, আপনি যদি শান্তি চান, আপনি যদি সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পূর্ব ইয়োরোপের সমৃদ্ধি চান, আপনি যদি উদারীকরণ চান - তবে আসুন এই গেটের সামনে। মিস্টার গর্বাচ্যভ খুলে দিন এই গেট! মিস্টার গর্বাচ্যভ, গুঁড়িয়ে দিন এই প্রাচীরকে।’
নয়া উদারবাদের আলোচনায় তখন ‘স্বাধীনতা’, ‘গণতন্ত্র’ আর ‘শান্তি’। সুখের স্বপ্ন ফিরি। আর এখন, সোভিয়েত-পরবর্তী পূর্ব ইয়োরোপে দুঃস্বপ্নের দিনরাত।
সোভিয়েত ইউনিয়নের অবসানকে রেগান সেদিন বর্ণনা করেছিলেন শান্তি ও সমৃদ্ধির ‘অগ্রদূত’ হিসেবে। তিন দশক পর, পূর্ব ইয়োরোপ এবং সাবেক সোভিয়েত ব্লকে না এসেছে শান্তি, না সমৃদ্ধি।
যুদ্ধ ও শান্তির দৃষ্টিকোণ থেকে আজ অন্তত একজনও দাবি করতে পারবেন না ১৯৯১-পরবর্তী পর্ব কেটেছে শান্তিতে, বিশেষত ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ের আপেক্ষিক স্থায়িত্বের নিরিখে। এই সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বেপরোয়া ঢঙে সম্প্রসারিত করেছে ন্যাটোকে, একেবারে রাশিয়ার চৌকাঠ পর্যন্ত।
সোভিয়েত পতনের এক বছর আগে, তৎকালীন মার্কিন বিদেশসচিব জেমস বেকার রাশিয়ার কাছে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, ‘ন্যাটো পূর্বদিকে এক ইঞ্চি-ও এগোবে না’, যদি মস্কো দুই জার্মানির মিলনে সম্মতি দেয়। পূর্বদিকে এক ইঞ্চি-ও নয় অর্থঃ পূর্ব বার্লিনের পূর্বে ‘এক ইঞ্চি-ও এগোবে না’ ন্যাটো।
গর্বাচ্যভ সেই চুক্তিতে সহমত হয়েছিলেন। কিন্তু, ওয়াশিংটন তার কথা রাখেনি।
সেদিন সবাই আশা করেছিলেন এবারে ন্যাটোকে গুটিয়ে দেওয়া হবে। কারণ, যে উদ্দেশে ন্যাটো তৈরি করা হয়েছিল, সেই সোভিয়েত ইউনিয়নই আর নেই। তাছাড়া, ন্যাটোর মোকাবিলার লক্ষ্যে যে ওয়ারশ চুক্তি হয়েছিল, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইয়োরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির বিপর্যয়ের পর তারই যখন অবসান হয়েছে, তখন ন্যাটোর প্রাসঙ্গিকতা আর কোথায়? ধাপে ধাপে নিরস্ত্রীকরণ এবং পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি কমানোর চুক্তিও সই হয়ে গিয়েছে। সেকারণে স্বাভাবিক ভাবনা ছিল ন্যাটোর আর কোনো প্রয়োজন নেই।
ঠান্ডা যুদ্ধের অবসানের পর পেরিয়ে গিয়েছে তিন দশক।
তবু ন্যাটো কেন সম্প্রসারিত হচ্ছে? ভেঙে দেওয়ার পরিবর্তে কেন সে নিজেকে সম্প্রসারিত করে চলেছে?
আজ সোভিয়েত নেই। তাহলে শত্রু কে?
আসলে আমেরিকার শত্রু খোঁজার অভিযান জারি রয়েছে এখনও। যেমন বলেছিলেন বুশঃ ‘হয় আপনি আমাদের সঙ্গে, নতুবা আমাদের বিরুদ্ধে’।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ন্যাটো যখন তৈরি হয়েছিল, তখন তার প্রথম মহাসচিব ব্রিটিশ লর্ড ইজমে সংক্ষেপে এর প্রকৃত উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে বলেছিলেনঃ ‘রুশদের বাইরে রাখা, মার্কিনিদের ভিতরে রাখা, এবং জার্মানদের দাবিয়ে রাখা’।
অন্যভাবে বললে, শুরু থেকেই ন্যাটো গণতন্ত্র বিস্তারের হাতিয়ার ছিল না। আসলে তার লক্ষ্য ছিল পশ্চিমের পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলির মাধ্যমে ইয়োরোপে ভূরাজনৈতিক আধিপত্যকে অটুট রাখা। অবশ্য জার্মানদের ‘দাবিয়ে’ রাখার ধারণা দ্রুতই বাতিল করে। এবং জার্মানি হয় ন্যাটো’র সামরিক ক্ষেত্রের অন্যতম শক্তি।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ চায় বিশ্বজোড়া আধিপত্য।
ন্যাটোকে ভেঙে দেওয়ার পরিবর্তে তাই তারা তাকে আরও পূর্বদিকে সম্প্রসারিত করতে শুরু করে। লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া এবং এস্তোনিয়ার মতো বাল্টিক রাষ্ট্র-সহ পোলান্ড, বুলগেরিয়া, হাঙ্গেরি, চেক সাধারণতন্ত্র, স্লোভাকিয়া, স্লোভানিয়া, রোমানিয়ার মতো পূর্ব ইয়োরোপের সাবেক ‘সোভিয়েত’ সাধারণতন্ত্রগুলির অধিকাংশই এখন ন্যাটোর শৃঙ্খলে। যুগোস্লাভিয়ার উপর বর্বর বোমাবর্ষণ-সহ ন্যাটো একাধিক যুদ্ধ চালিয়েছে বলকান অঞ্চলে। আর এখন রাশিয়া সীমান্তে ইউক্রেন, জর্জিয়াকে তাদের সদস্য করতে চাইছে।
বার্লিনের ভাঙা প্রাচীরের ওপর দাঁড়িয়ে যেদিন ফুকুয়ামা ঘোষণা করেন, ‘ইতিহাসের অবসান, দ্বন্দ্বের স্থায়ী অবসান, অনন্ত শান্তির যুগ শুরু’, সেদিন থেকেই ন্যাটো এগিয়েছে মস্কোর দিকে।
১৯৯০ থেকে ন্যাটো আজ বেড়ে হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ। সদস্য সংখ্যা ষোল থেকে বেড়ে এখন ৩০। পূর্ব ইয়োরোপ, বলকান ছাড়িয়ে এমনকী সামরিক হস্তক্ষেপ করেছে আফ্রিকায়। এবং মধ্য ও পশ্চিম এশিয়ায়। আফগানিস্তানে ন্যাটো’র বর্বরতাকে দেখেছে গোটা দুনিয়া। নামে নর্থ অতলান্তিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন। কোথায় উত্তর অতলান্তিক, আর কোথায় কাবুল!
ইউক্রেন নিয়ে ক্রমশ উত্তাপ বাড়ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে। ক্রমশ চড়ছে ওয়াশিংটন ও মস্কোর মধ্যে উত্তেজনার পারদ। তারমধ্যেই ২৩ জানুয়ারি রুশ সীমান্তবর্তী দেশগুলিতে অতিরিক্ত ৫,০০০ সেনা পাঠানোর প্রস্তুতির নির্দেশ দিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন সেই আগুনে ঘি ঢেলেছেন। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী পরমাণু শক্তিধর দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছেন। আর ক’দিন আগে চাঞ্চল্য ছড়িয়ে বলেছেন, মার্কিন নাগরিকদের ইউক্রেন ছেড়ে বেরিয়ে আসা উচিত। যুদ্ধের আশঙ্কা উসকে দিয়ে যোগ করেছেন ‘একেবারেই ভিন্ন পরিস্থিতি। যে কোনো মুহূর্তে যে কোনো দিকে গড়াতে পারে পরিস্থিতি। তাই ইউক্রেনে বসবাসকারী আমেরিকানদের সে দেশ ত্যাগ করাই শ্রেয়।’ ওয়াশিংটন পোলান্ডে পাঠাচ্ছে ৩,০০০ মার্কিন সেনা।
বাইডেন দাবি করে চলেছেন, ইউক্রেনে আক্রমণের পরিকল্পনা করছে রাশিয়া। লন্ডনের দাবি, ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে রুশ-বান্ধব জমানা বসাতে অভ্যুত্থানের ছক কষছে মস্কো। নিউ ইয়র্ক টাইমস থেকে ওয়াশিংটন পোস্ট, এনপিআর থেকে ফক্স নিউজ একতরফা বলে চলেছে, ইউক্রেনে আগ্রাসনের পরিকল্পনা করছে রাশিয়া, ঘনিয়ে আসছে যুদ্ধ। লাগাতার বাজিয়ে চলেছে যুদ্ধের দামামা। এভাবেই চলছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে এবং যুদ্ধের প্রস্তুতিকে বৈধতা দিতে একযোগে প্রচার, যাতে মার্কিন আগ্রাসনের পিছনে ওয়াশিংটন দাঁড় করাতে পারে তার ইয়োরোপীয় মিত্রদের। যেমন প্রচার তোলা হয়েছিল ১৯৯৯-তে সাবেক যুগোস্লাভিয়ার বিরুদ্ধে, ২০০১ সালে আফগানিস্তান, ২০০৩ সালে ইরাক এবং ২০১১-তে লিবিয়া এবং সিরিয়ার বিরুদ্ধে।
ইউক্রেনের বর্তমান জমানা ২০১৪’র গোড়ায় এক অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে ক্ষমতা দখল করে। ইউক্রেনিয়, নব্য-নাৎসিসহ রুশবিরোধী জাতীয়তাবাদী শক্তি যে নতুন জমানা প্রতিষ্ঠা করে, তাকে সমর্থন জানায় ওবামা প্রশাসন। রুশবিরোধী এই রাষ্ট্র সঙ্গে-সঙ্গেই হামলা চালায় ইউক্রেনে বসবাসকারী সংখ্যালঘু রুশ-বংশোদ্ভূতদের উপর, যাঁদের অধিকাংশেরই বাস দেশের পূর্বদিকে, রাশিয়া সীমান্তে। আত্মরক্ষায় ডনবাস অঞ্চলের দুই প্রদেশ দনেৎস্ক ও লুহান্স্ক স্বাধীনতা ঘোষণা করে। কিয়েভ তাদের দমনে সেনা পাঠায়। এখনও চলছে গৃহযুদ্ধ।
দনেৎস্ক ও লুহান্স্ককে ‘স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য এই ফেব্রুয়ারিতেই রুশ সংসদে দাবি জানিয়েছে রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি। ৫৭ জন সাংসদ নিয়ে দুমায় দ্বিতীয় বৃহত্তম দল কমিউনিস্ট পার্টি। ২০১৪-তে দনেৎস্ক ও লুহান্স্ক স্বাধীনতা ঘোষণা করলেও রাশিয়া এখনও তাদের স্বীকৃতি দেয়নি। এদিকে ক্রিমিয়ায় গণভোটে ৯৫ শতাংশের সমর্থন নিয়ে উপদ্বীপের দখল ফের নিজের হাতে নিয়েছে রাশিয়া। ১৯৬৩’র আগে ক্রিমিয়া ছিল রাশিয়ার অংশ।
‘শান্তিপূর্ণ পথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ডনবাস সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত’ বলে দাবি জানিয়েছেন ইউক্রেনের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক পেত্রো সিমোনেঙ্কো। এ’মাসের গোড়ায় সিমোনেঙ্কো বলেছেন, ‘গত সাতবছর ধরে নিরাপত্তা পরিষদ কেন ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতিকে একবারের জন্যও আমন্ত্রণ জানাল না, যাতে সংঘাতের শান্তিপূর্ণ নিস্পত্তির জন্য তিনি কী করেছেন, তা নিয়ে রিপোর্ট করতে পারেন? কেন একের পর এক সমরাস্ত্র-বোঝাই মার্কিন ও ব্রিটিশ বিমান কিয়েভে (ইউক্রেনের রাজধানী) নামছে? ওরা কী আদৌ শান্তি চায়?’ মোটেই চায় না। আসলে ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পোলান্ডের মধ্যে সম্প্রতি হয়েছে একটি ‘ত্রিপাক্ষিক সামরিক জোট’, যার সঙ্গে জুড়ে রয়েছে ‘ইউক্রেনের নাৎসি-অলিগার্কের শাসক জমানা’। তাঁর বক্তব্য, ‘আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজির নির্দেশে নতুন করে ইয়োরোপের পুনর্বণ্টনের লক্ষ্যেই’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর এই তৎপরতা। আর নেপথ্যে রয়েছে মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ এবং ব্রিটিশ সংস্থা এম ১৬। নাহলে ‘কেন ২০০০ সালে ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি ভলোদিমির জেলেনস্কি লন্ডনে এম ১৬-র প্রধানের সঙ্গে কথা বলবেন? আর কেনই বা এবছর জানুয়ারিতে কিয়েভে সিআইএ-র প্রধানের সঙ্গে বৈঠক করবেন?’
রাশিয়ার কাছেই এখন ন্যাটোর সামরিক ঘাঁটি। ন্যাটোর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য-দেশ ইতালির অত্যাধুনিক সুপারসনিক, এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান এখন রয়েছে রুশ সীমান্ত থেকে মাত্র আধ ঘণ্টার দূরত্বে। রাশিয়ার পশ্চিম সীমান্তে ইতিমধ্যেই মোতায়েন রয়েছে ন্যাটোর ১,৭৫,০০০ সেনা। মজুত রয়েছে অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র।
সেকারণেই পুতিন বলেছেন, ‘তোমরা আমাদের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। আমরা আসিনি তোমাদের কাছে!’ তিনি বলেছেন, রাশিয়ার কাছে সমস্ত দেশ থেকে ন্যাটো নিজেদের প্রত্যাহার করুক। ইউক্রেনে ন্যাটোর কোনো দরকার নেই।
রাশিয়া ও চীন একযোগে ‘ন্যাটোর নতুন করে সম্প্রসারণের অবসান’ চেয়েছেন। বেজিঙে রাষ্ট্রপতি শি জিনপিঙ এবং ভ্লাদিমির পুতিন এক যৌথ বিবৃতিতে ন্যাটোকে ‘ঠান্ডা যুদ্ধের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিরত থাকতে’ বলেছেন। সেইসঙ্গেই, ন্যাটোকে ‘অন্য সমস্ত দেশের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ও স্বার্থকে সম্মান দেখাতে’ বলেছেন।