শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক পরিস্থিতি প্রসঙ্গে
লালন ফকির
দক্ষিণ মধ্য এশিয়ায় অবস্থিত দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কার বর্তমান আর্থ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি বেশ সঙ্কটপূর্ণ হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে দেশের অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানে রাষ্ট্রপতি রাজাপাক্ষে ও তাঁর মনোনীতদের ব্যর্থতা এবং অন্যদিকে এই উপমহাদেশের প্রধান দুই শক্তি ভারত ও চীনের মধ্যে নেতিবাচক অনুঘটকের ভূমিকা সাম্প্রতিক সমস্যার অন্যতম প্রধান কারণ।
সম্প্রতি শ্রীলঙ্কা এক ভয়ঙ্কর খাদ্য সমস্যার সম্মুখীন। কৃষক স্বার্থ তথা জনস্বার্থ বিরোধী নীতি চাপিয়ে দেওয়া যা পরবর্তীকালে প্রত্যাহৃত হয়, তা এর জন্য অনেকখানি দায়ী। খাদ্য সমস্যাকে আরও বৃদ্ধি করেছে ভয়ঙ্কর মুদ্রাস্ফীতি, বিভিন্ন পরিকাঠামোগত শিল্প বিশেষত বিদ্যুৎ শিল্পের উৎপাদন এবং বণ্টনের ব্যাপক অবনতি, কোভিড মহামারীর ভয়ঙ্কর আক্রমণ সমগ্র জাতীয় জীবনকেও দুর্বল করে দিয়েছে বলে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
এই সমগ্র শোচনীয় পরিস্থিতির জন্য রাষ্ট্রপতি রাজাপাক্ষের প্রশাসন পরিচালনায় ব্যর্থতা এবং তাঁর বিশ্বস্ত অনুগামীদের চূড়ান্ত ব্যর্থতাকে দায়ী বলে মনে করা হচ্ছে। রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে এই ঘনিষ্ঠ মহলকে যে সমস্ত প্রশাসনিক কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, তার সর্বক্ষেত্রেই তারা ব্যর্থ হয়েছে।
রাজাপাক্ষে ২০১৯ সালে যখন ক্ষমতাসীন হন তার প্রেক্ষিত ছিল দেশের পূর্বাংশে চার্চ এবং হোটেলে সংগঠিত সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ, যে আক্রমণে প্রায় ২৫০ মানুষ নিহত হন। এই সন্ত্রাসমূলক পরিস্থিতি থেকে মুক্তিলাভের জন্য শ্রীলঙ্কাবাসী রাষ্ট্রপতি পদে রাজাপাক্ষের উপর নির্ভর করেছিল। জনগণের প্রত্যাশা ছিল রাজাপাক্ষে একটি শক্তিশালী এবং শান্তিকামী শ্রীলঙ্কা দেশের নাগরিকদের উপহার দেবেন।
কিন্তু রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে জনগণের এই মোহ বাস্তবে রূপায়িত হয়নি। পরিবর্তে বর্তমান রাষ্ট্রপতি জনগণের বোঝায় পরিণত হয়েছেন। তাঁর নেতৃত্বে শ্রীলঙ্কার অবমূল্যায়ন ঘটেছে। দেশব্যাপী অযৌক্তিক ধারণার বিস্তৃতি ঘটেছে, যার ফলে শ্রীলঙ্কার সম্পর্কে মাঝারি মানের ধারণা গড়ে উঠেছে।
শ্রীলঙ্কার বর্তমান বৃহত্তম সমস্যা হলো তার অর্থনীতি। বর্তমান বছরটি শ্রীলঙ্কার নিকট খুবই দুর্বিষহ বার্তা বহন করছে। বর্তমান বছরটিতে শ্রীলঙ্কাকে ৬৯০ কোটি ডলার বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে হবে। দেশের বর্তমান বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয় ভাণ্ডারের সঙ্গীন অবস্থা এবং কোভিড-১৯ মোকাবিলায় গৃহীত পদক্ষেপের পরিণতিতে দেশের অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং জনগণের বিক্ষোভ প্রশমিত করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দেশের অধিকাংশ সংবাদপত্রে অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ হলো, জনগণের খাদ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং বিদেশি বন্ড ও ঋণের কিস্তি শোধ করার উপর সরকারকে গুরুত্ব দিতে হবে। চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারি যখন ৫০ কোটি ডলারের বিদেশি বন্ডের মেয়াদ শেষ হচ্ছে তখন সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক অব শ্রীলঙ্কার গভর্নর অজিম নাইভার্ড ক্যাবরাল জানিয়েছেন যে, শ্রীলঙ্কা তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছে এবং মেয়াদ শেষে বন্ডের সমুদয় অর্থ পরিশোধ করেছে। দেশের মজুত সোনা বিক্রি করে এবং ভারত ও চীনের সাথে মুদ্রা হস্তান্তরের বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে এই বন্ডের অর্থ পরিশোধ করা হয়। এর পাশাপাশি আমদানির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার স্ফীত করা হয়েছে। এই ঋণ পরিশোধের মধ্য দিয়ে শ্রীলঙ্কা তার বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
বলাই বাহুল্য সরকারের এই সমস্ত পদক্ষেপ ব্যাপক সমালোচনার সম্মুখীন হয়। কারণ দেশের অর্থনীতিতে চলমান উচ্চহারের মুদ্রাস্ফীতিকে এইসব পদক্ষেপ আরও বৃদ্ধি করবে এবং জনগণকে আরও দুর্দশার মধ্যে নিক্ষেপ করবে। একথাও প্রচারিত হয় যে, এই বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে শ্রীলঙ্কা তার মজুত স্বর্ণ ভাণ্ডার থেকে ৩.১ টন সোনা বিক্রি করেছে।
এই ঘটনার কয়েকমাস পূর্বে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটে। এই কথাও প্রচারিত হয় যে, শ্রীলঙ্কা তার বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে পারবে না। ২০২১ সালের নভেম্বর মাসের শেষে শ্রীলঙ্কার বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয় ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়ে মাত্র ১৬০ কোটি ডলারে পৌঁছেছে। এই পরিমাণ অর্থ দিয়ে খুব বেশি হলে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী একমাসের বেশি আমদানি করা যাবে না।
ডিসেম্বর মাসের শেষার্ধে অধিকাংশ রেটিং এজেন্সি জানায় যে, ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কা সরকার ঋণ পরিশোধে সমর্থ হবে না। জানুয়ারি মাসের ১৮ তারিখে চীনের সাথে এক বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে তার বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার বৃদ্ধি করে ৩০০ কোটি ডলারে পৌঁছায়। শ্রীলঙ্কা যাতে বিদেশী ঋণ পরিশোধে সমর্থ হয় সেক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা গ্রহণ করেছে। দীর্ঘ আলোচনার পর মুদ্রা হস্তান্তরের বিশেষ পদ্ধতির মধ্য দিয়ে শ্রীলঙ্কা ৪০ কোটি ডলার প্রদান করে। এছাড়া খাদ্য ও অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ক্রয়ের ঋণ বাবদ শ্রীলঙ্কা ১০০ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ করে। এছাড়া ১৮ জানুয়ারি ভারত সরকারের পক্ষ থেকে এসিইউকে-র মাধ্যমে ঋণ পরিশোধে কিছু বাড়তি সময় শ্রীলঙ্কাকে দেওয়া হয়। ১৮ জানুয়ারি ভারত সরকারের পক্ষ থেকে শ্রীলঙ্কার পেট্রোজাত পণ্য সামগ্রী ক্রয়ের জন্য ৫০ কোটি ডলারের এক নতুন ধরনের ঋণ মকুব করেছে। ভারত সরকারের সাহায্য এমন সময়ে মকুব করা হয়েছিল যখন শ্রীলঙ্কার বিদ্যুৎ শিল্প এবং পেট্রোলিয়াম শিল্পের আর্থিক পরিস্থিতি বেশ সমস্যায় পড়েছিল।
শ্রীলঙ্কার বিদেশি মুদ্রার এই শোচনীয় পরিস্থিতির মধ্যেও কিছু রুপালী রেখা দেখা যাচ্ছে। এর একটি হলো পর্যটন শিল্পের মধ্য দিয়ে বিদেশি মুদ্রার আদায় বৃদ্ধি এবং অনাবাসী শ্রীলঙ্কার অধিবাসীদের প্রেরিত বিদেশি মুদ্রার পরিমাণ বৃদ্ধি।
পূর্বেই উল্লেখিত হয়েছে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক অধোগতির সময় ভারত এবং চীন সাহায্যের ডালি নিয়ে শ্রীলঙ্কার পাশে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলেও সত্য যে, উভয় দেশের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করে শ্রীলঙ্কা বাড়তি সাহায্যের যে আশা করেছিল, তা পূরণ হয়নি। একথা সর্বজনবিদিত যে, ভারত-শ্রীলঙ্কার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনতির সূচনা ২০০৯ সাল নাগাদ ঘটে, যখন শ্রীলঙ্কার সাথে এলটিটিই জঙ্গির লড়াই সংগঠিত হয়। এই সময় থেকে শ্রীলঙ্কা বিভিন্ন ধরনের যৌথ প্রকল্প থেকে নিজেদেরকে সরিয়ে রাখে। কিন্তু কিছু বাণিজ্যিক শিল্পের ক্ষেত্রে ভারতের সাথে যুক্ত যৌথ প্রকল্প থেকে সরে এসে শ্রীলঙ্কা একতরফাভাবে চীনের সাথে যোগ দেয়।
পূর্বতন রাষ্ট্রপতি মাহিন্দ্রা রাজাপাক্ষে সাংবাদিকদের বলেছিলেন যে, ভারতের সাথে সম্পাদিত যৌথ প্রকল্পগুলি শেষ হতে অনেক বিলম্ব হওয়ায় ভারতকে বাদ দিয়ে চীনের সাথে শ্রীলঙ্কা যৌথ প্রকল্পে যুক্ত হয়েছে। অবশ্য একজন প্রাক্তন ভারতীয় কূটনীতিবিদ যিনি একসময় কলম্বোয় ছিলেন, তিনি এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
প্রকৃত ঘটনা হলো অনেকগুলি প্রকল্প ছিল ‘শ্বেত হস্তির ন্যায়’। ফলে এইসব প্রকল্প থেকে সরে আসতে শ্রীলঙ্কা বাধ্য হয়েছিল। এই ধরনের প্রকল্পগুলির মধ্যে ছিল লোটাস টাওয়ার, দ্যা মাট্রালা মাহিন্দা রাজাপাক্ষে বিমানবন্দর, হামবানটোরা কনভেনশন সেন্টার। শ্রীলঙ্কার একটি বিমানবন্দর নির্মাণে ভারত আগ্রহ প্রকাশ করলেও শ্রীলঙ্কা রাজি হয়নি। কলম্বো বন্দরের একটা অংশের আধুনিকীকরণে ভারত ও জাপানের যৌথ উদ্যোগ গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু প্রাথমিক স্তরে শ্রীলঙ্কা সম্মত হলেও পরবর্তীকালে ভারতের পরিবর্তে চীনকে প্রকল্পের সাথে যুক্ত করা হয়।
চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে চীনের বিদেশমন্ত্রী ওয়াহ ই শ্রীলঙ্কা সফর করেন। এই সফরের সময় বলা হয় চীন-শ্রীলঙ্কার মৈত্রীর লক্ষ্য অন্য কোনও দেশ নয়, আর চীন-শ্রীলঙ্কার অভ্যন্তরীণ ঘটনায় তৃতীয় কোনও দলের হস্তক্ষেপ বরদাস্ত করা হবে না।
চীনের বিদেশমন্ত্রীর শ্রীলঙ্কা সফরের দিনই ভারতের সহযোগিতায় মাউন্ট ল্যাভিয়া থেকে ইন্টারসিটি সার্ভিসে এসিডিএমইউ চালু করা হয়। এই অনুষ্ঠানে শ্রীলঙ্কার পরিবহণমন্ত্রী প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করেন। এই অনুষ্ঠানে ঘোষণা করা হয় যে, শ্রীলঙ্কার বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মসূচিতে ভারতের বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৩৫০ কোটি ডলার। এর মধ্যে অনুদানের পরিমাণ ৫৭ কোটি ডলার।
শ্রীলঙ্কার সাধারণ মানুষ জনগণের সমস্যা সমাধানে শ্রীলঙ্কা সরকারের ভূমিকা সম্পর্কে বিরক্ত। তারা চায় যে, শ্রীলঙ্কার সমস্ত জাতীয় সমস্যাগুলি সমাধানে জাতীয় সরকার গঠনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করুক। তাছাড়া এই ব্যাপারে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলি বিশেষত ভারত ও চীনের সাহায্যে দেশের সমস্যা সমাধানে শ্রীলঙ্কা উদ্যোগী হবে - এটাই তাদের প্রত্যাশা।