E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

নয়া উদারবাদের বিকল্প বামপন্থার জয় পেরুতে

শান্তনু দে


২০০ বছরের ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে এই প্রথম পেরুতে নির্বাচিত একজন বামপন্থী রাষ্ট্রপতি।

এই প্রথম, পেরু নির্বাচিত করেছে আন্দিজের প্রত্যন্ত গ্রামের এক নিরক্ষর কৃষক পরিবারের সন্তানকে। গ্রামের প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক পেদ্রো কাস্তিও সেকারণে শুধু দেশের প্রথম বামপন্থী রাষ্ট্রপতিই নন, প্রথম কৃষক রাষ্ট্রপতিও।

এক ঐতিহাসিক মুহূর্তর সাক্ষী পেরু। নিও লিবারেল মিডিয়ার তুমুল কুৎসা প্রচারকে পরাস্ত করে পেরুর ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় শুরু করতে চলেছেন পেদ্রো কাস্তিও।

সপ্তাহভর গণনার শেষে বামপন্থী প্রার্থী কাস্তিও’র সমর্থনের হার ৫০.১৭ শতাংশ। প্রতিদ্বন্দ্বী দক্ষিণপন্থী প্রার্থী, কট্টর উদার বাজার নীতির সমর্থক কেইকো ফুজিমোরির চেয়ে ৬০,০০০ ভোটে এগিয়ে। সরকারিভাবে ঘোষণা করা না হলেও নিশ্চিত জয়ের পথে। সওয়া তিন কোটি জনসংখ্যার দেশে এই ব্যবধান সামান্য হলেও, তাৎপর্য ব্যাপক।

কেইকো যথারীতি কোনও তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই নির্বাচনে ‘অনিয়ম’, ‘জালিয়াতির’ অভিযোগ তুলেছেন। গ্রামের ৮০২টি ভোটকেন্দ্রের ২,০০,০০০ ভোট বাতিলের দাবি তুলেছেন। যে গ্রামাঞ্চলে কাস্তিও’র জনভিত্তি ব্যাপক।

স্বাভাবিক। ২০১৬-তে, ৪০ হাজার ভোটে হেরে গিয়ে একই অভিযোগ তুলেছিলেন কেইকো। কোনও প্রমাণ ছাড়া সেবারও দাবি করেছিলেন নির্বাচনে ‘জালিয়াতি’ হয়েছে। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা অবশ্য আগের মতো এবারেও কেইকোর দাবি খারিজ করে দিয়েছেন।

পেরুর ভোট দেখেছে তীব্র মেরুকরণ। নয়া উদারবাদের বিরুদ্ধে এক স্পষ্ট জনাদেশ। বহুজাতিক সংস্থাকে অবাধ লুটের মৃগয়া ক্ষেত্র করে দিতে স্বৈরাচারী আলবার্তো ফুজিমোরি (১৯৯০-২০০০) যে নয়া উদার ধারণা নিয়ে সংবিধান তৈরি করেছিলেন, তা এখনও বলবৎ। অপার খনিজ সম্পদে ভরপুর পেরু এখনও লাতিন আমেরিকার গরিব ও অনুন্নত দেশগুলির একটি। তীব্র অসাম্য। আন্দিজের গ্রামাঞ্চল আর উত্তরে উপকূলীয় শহরাঞ্চলের মধ্য অসাম্য প্রকট। গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ মানুষই গরিব। এক শতাংশ ফার্মের দখলে ৭৭ শতাংশ জমি। মানে তাদের হাতে বাকি ৯৯ শতাংশের চেয়ে বেশি জমি। ৬২ শতাংশেরই নেই কোনো ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট। ২০২০, পেরুর জিডিপি পড়েছে ১১.১ শতাংশ। শেষ ৩০ বছরে সবচেয়ে শোচনীয় মন্দার মুখে দেশ। একরত্তি দেশে কাজ হারিয়েছেন ২০ লক্ষ মানুষ। বেকারত্বের হার দ্বিগুণ বেড়ে ১৪.৫ শতাংশ। যদিও, এটি শুধুই সংগঠিত ক্ষেত্রের হিসেব, যে দেশে শ্রমশক্তির ৭০ শতাংশই চুক্তির বাইরে। দারিদ্র্যের হার ২০১৯ থেকে ৬ শতাংশ বেড়ে ২৭.৫ শতাংশ। কারণ, বিদেশি পুঁজির প্রবল দাপট। তাবৎ খনির মালিক দেশ-বিদেশের কর্পোরেট। খনিজ সম্পদের অবাধ লুটে বেড়েই চলেছে কর্পোরেটের মুনাফার পাহাড়। অর্থনীতিতে নেই রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ। দেশের খনিজ সম্পদে নেই রাষ্ট্রের অধিকার। অথচ, তা জাতীয় সম্পদ। ব্যবহার করার কথা জনগণের স্বার্থে। নয়া উদার নীতিতে সম্পদের অসম বণ্টনে সরকারের হস্তক্ষেপ না থাকায় বেড়ে চলেছে গরিব-বড়োলোকের ব্যবধান।

পেদ্রো কাস্তিও’র দল ‘ফ্রি পেরু’ চায় এই সংবিধান বদলে এক নতুন সংবিধান। আর সেই খসড়া সংবিধান লিখতে গণপরিষদ। খসড়া সংবিধান অনুমোদনে গণভোট। যাতে পুনরুদ্ধার করা যায় দেশের স্ট্র্যাটেজিক ক্ষেত্র-সহ তাবৎ জাতীয় সম্পদকে। ব্যবহার করা যায় দেশের মানুষের জন্য, বিশেষ করে হতদরিদ্র, গরির মানুষের জন্য।

খনিজ ক্ষেত্রের জাতীয়করণের ডাক দিয়ে ২০১২-তে তৈরি হয় ফ্রি পেরু। নিজেদেরকে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মারিয়ের্তাগি বলে ঘোষণা করে। হোসে কার্লোস মারিয়ের্তাগি ছিলেন ১৯২৮ সালে পেরুর কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা। ফ্রি পেরু বলে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতা, লাতিন আমেরিকার ঐক্যের কথা। নয়া উদার সংবিধান বদলে চায় নতুন সংবিধান। মহিলাদের অধিকারকে সম্মান। দলের ওয়েবসাইটে স্পষ্ট উচ্চারণঃ ‘যে কোনও ধরনের সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপ ও বিদেশী নির্ভরতার নিন্দা করে ফ্রি পেরু।’

ফ্রি পেরু’র প্রতিষ্ঠাতা নিউরোসার্জেন ভ্লাদিমির সেরন ১৯৯৭-তে কিউবা থেকে মেডিসিনে ডক্টরেট করেন। পরে কিছুদিন ক্যামাগুয়েতে প্র্যাক্টিসও করেন। ছিলেন জুনিন প্রদেশের গভর্নর। বছর পঞ্চাশের সেরন এখনও ফ্রি পেরু’র সাধারণ সম্পাদক। ভুয়ো দুর্নীতি মামলায় গতবছর আগস্টে তাঁকে জেলে পোরা হয়। এবছর ৯ জুন বিচারপতি সেই অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছেন।

‘পেরুর রাষ্ট্রপতি হিসেবে কাস্তিও’র নির্বাচন শক্তিশালী করবে ঐক্যবদ্ধ লাতিন আমেরিকার বলিভারিয় স্বপ্নকে। সাম্রাজ্যবাদের মুখে দাঁড়িয়ে, যারা এই লাতিন আমেরিকাকে নিজের উঠোন বলে মনে করে, তাদের জন্য এটা বড়ো আঘাত।’ বলেছেন ফ্রি পেরু দলের অন্যতম শীর্ষ নেতা উরি কাস্ত্রো। ‘এটাই একজোট হয়ে এগিয়ে যাওয়ার সময়, যাতে আর কখনো আমরা উপনিবেশে পরিণত না হই।’

কাস্ত্রোর স্পষ্ট কথা, মুনাফার ৭০-৮০ শতাংশ বেমালুম বহুজাতিক খনন সংস্থা নিয়ে চলে যাবে - এই নয়া উদার যুক্তি খারিজ করা জরুরি। ‘আমরা এই পাটিগণিতকে উলটে দেওয়ার প্রস্তাব করব, যাতে সিংহভাগ থাকে রাষ্ট্রের কোষাগারে। সম্পদ আমাদের। সেকারণে প্রতিটি চুক্তির নতুন করে সমঝোতা করা হবে। এবং পরিবর্তন করা হবে সংবিধান।’ যেখান থেকে অর্থ বরাদ্দ করা হবে স্বাস্থ্য ও শিক্ষায়। বি-শিল্পায়ন/ বি-জাতীয়করণের মডেলে চাপিয়ে দেওয়া নির্ভরতা থেকে আমরা ফিরব স্বনির্ভরতায়। শিল্পে সরকারি বিনিয়োগে আমরা থাকব অঙ্গীকারবদ্ধ।

পেরুর সংবাদপত্রগুলির ৮০ শতাংশের নিয়ন্ত্রণ যে মিডিয়া টাইকুনের হাতে - সেই ‘গ্রুপো এল কমার্সিও’ তাই স্বাভাবিকভাবেই ছিল কাস্তিও’র ঘোর বিরোধী। মাওবাদী ‘শাইনিং পথের’ সঙ্গে কাস্তিও’র ‘ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক’ প্রমাণে দিনরাত ছিল ব্যস্ত। শাইনিং পথ মানে বর্বরতার চরম নিদর্শন। যা নিয়ে পেরুর নোবেল জয়ী সাহিত্যিক মারিও ভার্গাস ইয়োসা লিখেছেন সাড়া জাগানো বই ‘ডেথ ইন আন্দিজ’। যৌবনে ফিদেল ছিলেন তাঁর অনুপ্রেরণা। ছিলেন মার্কেজের বন্ধু। পরে নয়া উদারবাদের কট্টর সমর্থক। ১৯৯০, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে কেইকোর বাবা আলবার্তো ফুজিমোরির সঙ্গে যখন প্রতিদ্বন্দ্বিতায়, তখন তিনি নয়া উদারবাদের পক্ষে জোরালো সওয়াল করেন। চান ‘আন্দিজে থ্যাচারবাদ’।

শুধু পেরুতে নয়, এমনকি ব্রিটিশ দ্য টেলিগ্রাফে পর্যন্ত কাস্তিওকে নিয়ে শিরোনামঃ ‘মার্কসবাদী শাইনিং পথ গেরিলার প্রত্যাবর্তন’ পেরুতে। যদিও নির্বাচনের প্রচারে কাস্তিও বারংবার অস্বীকার করেছেন শাইনিং পথের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথা। অন্যদিকে ভোটের মুখে রয়টার্সের শিরোনাম, ‘নয়া উদারবাদ না মার্কসবাদ?’ যে মারিও ভার্গাস বরাবর ছিলেন ফুজিমোরি-বিরোধী, সেই তিনি নিজের তিন-দশকের অবস্থান থেকে সরে এসে বলেন, ‘গণতন্ত্রকে বাঁচানোর একমাত্র পথ’ হলো কেইকোর জন্য ভোট দেওয়া। তাঁর ছেলে আলভারো ভার্গাস বলেন, ‘আজ আমরা গুরুতর হুমকির মুখে। কমিউনিজমের বিরুদ্ধে আমাদের জিততেই হবে।’ গণনার শেষ দিকে দ্য ইকনমিস্ট-এ অসহায় আর্তনাদঃ পেরুর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সামান্য ব্যবধানে এগিয়ে একজন ‘কট্টর বামপন্থী’! পেরুর রাস্তার বিলবোর্ডে ছড়ানো হয়েছিল আতঙ্ক। ক্যাস্তিওকে জিতিয়ে আপনারা কি ‘পেরুকে ভেনেজুয়েলা, কিউবা করতে চান!’ ‘কমিউনিজম মানে দারিদ্র্য!’

গত তিন বছরে পেরু দেখেছে চার-চারজন রাষ্ট্রপতি। দুর্নীতি, উৎকোচ নেওয়ার দায়ে একের পর এক পদত্যাগ। বস্তুত, শেষ দশজন রাষ্ট্রপতির মধ্যে সাতজনই দুর্নীতির দায়ে অপরাধী সাব্যস্ত। অথবা দুর্নীতির অভিযোগে তদন্তের মুখে।

ক্ষুদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান, জঙ্গী ট্রেড ইউনিয়ন নেতা কাস্তিও ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান ২০১৭’র শিক্ষক ধর্মঘট থেকে। তাঁর মুখ্য স্লোগানঃ ‘ধনী দেশে থাকবে না একজনও গরির মানুষ।’ চিলির মতোই নতুন সংবিধান লিখতে গঠন করা হবে নির্বাচিত গণপরিষদ। কাস্তিও বলেছেন, সংসদ যদি একান্তই গণপরিষদ না করে, তবে তিনি তা ভেঙে দেবেন। জিডিপি’র ২০ শতাংশ বরাদ্দ করবেন স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে। তাঁর দল ফ্রি পেরু ইউএসএইড-কে বহিষ্কারের ডাক দিয়েছে। একইসঙ্গে মার্কিন সেনাঘাঁটির ঝাঁপ বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলেছে। ওয়াশিংটনের মদতপুষ্ট অর্গনাইজেশন অব আমেরিকান স্টেটসের পালটা সেলাক, ইউনাসুর-কে শক্তিশালী করার কথা বলেছে। সেইসঙ্গেই বলেছে স্ট্র্যাটেজিক ক্ষেত্রের জাতীয়করণের কথা।

জনাদেশকে ভেস্তে দিতে দক্ষিণপন্থীদের চেষ্টা ব্যর্থ করার ডাক দিয়েছেন কাস্তিও। ‘জনাদেশকে রক্ষার’ ডাক দিয়ে বলেছেন, ‘নাগরিকদের নজরদারিই রক্ষা করতে পারে গণতন্ত্রকে। একমাত্র মানুষই পারে মানুষকে রক্ষা করতে।’

তবে কাস্তিও’র সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ। ‘নতুন দেশ’ হিসেবে পেরুর পুনর্জন্মের জন্য কাস্তিওকে লড়তে হবে গেঁড়ে বসা শাসকশ্রেণি ও রাষ্ট্রযন্ত্রে তাদের বিভিন্ন শাখার বিরুদ্ধে। লড়তে হবে মিডিয়ার একপেশে কুৎসা প্রচারের বিরুদ্ধে। সংসদ, যার সংখ্যাগরিষ্ঠ তাঁর বিরুদ্ধে। ব্যবসা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে, যাদের মধ্যে তৈরি করা হয়েছে আতঙ্ক। রয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্তারা, যাঁরা বিদ্রোহের হুমকি দিয়ে রেখেছেন।