E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

পেরুতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বামপন্থী প্রার্থীর জয়

লালন ফকির


লাতিন আমেরিকার তৃতীয় বৃহত্তম দেশ পেরুর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বামপন্থী প্রার্থী পেড্রো কাস্তিলো জয়ী হয়েছেন। পেরুর জাতীয় রাজনীতিতে তিনি একজন বামপন্থী মতাদর্শের মানুষ বলে পরিচিত। পেশায় কাস্তিলো একজন শিক্ষক। তিনি দেশের কট্টর উদার অর্থনীতির প্রবক্তা কেউকো ফুজিমোরিকে পরাস্ত করেছেন। উভয়ের মধ্যে ভোটের ব্যবধান খুব সামান্য। মাত্র ৭১ হাজার। কাস্তিলো পেয়েছেন ৫০.২ শতাংশ ভোট। অন্যদিকে ফুজিমোরি পেয়েছেন ৪৯.৭ শতাংশ ভোট। পেরুর জনসংখ্যা ৩ কোটি ২০ লক্ষ। এরমধ্যে ২ কোটি ৪০ লক্ষ ভোটার। ভোট দিয়েছেন ১ কোটি ২০ লক্ষ। জয়ের ব্যবধান সামান্য হলেও পেরুর মতো একটি দেশে বামপন্থী প্রার্থীর জয় বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।

পেরুর নির্বাচনী ফলাফল সম্পর্কে আলোচনার পূর্বে দেশটির ভূ-রাজনৈতিক তাৎপর্য সম্পর্কে আলোচনা প্রয়োজন। দক্ষিণ আমেরিকার অন্যতম দেশ পেরু প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে অবস্থিত। জনসংখ্যার বিন্যাসে ইনকা সম্প্রদায় সংখ্যাগরিষ্ঠ। ১৮২১ সালের ২৮ জুলাই স্পেনের অধীনতা থেকে পেরু মুক্তি পায়। স্বাধীনতা অর্জনের পরে অনেক উত্থান পতনের মধ্যে দিয়ে পেরুতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হয়।

পেরুর উপকূলে রয়েছে মরুভূমি। এই মরুভূমি সাহারার থেকেও শুষ্ক। এখানে গড়ে উঠেছে রাজধানী শহর লিমা সহ অন্যান্য শহরগুলি। উপকূলের পূর্ব দিকে উত্তর থেকে দক্ষিণ বরাবর বরফে ঢাকা আন্দিজ পর্বত। এই অঞ্চলে রয়েছে সবুজ মালভূমি। আন্দিজ পর্বতের পূর্বদিকে ঢাকা ঘন অরণ্য। দক্ষিণ আমেরিকার অন্যান্য দেশের তুলনায় পেরুতে সবথেকে বেশি স্থানীয় মানুষ ইন্ডিয়ানাদের বাস। পেরুর সাম্প্রতিক রাষ্ট্রপতি নির্বাচন এক কঠিন ও জটিল পরিস্থিতির মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়। বিগত চার বছরে চারজন রাষ্ট্রপতি শাসন করেছেন। প্রথমজন ভোট কেনাবেচার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে পদত্যাগে বাধ্য হন।দ্বিতীয় জন দুর্নীতির অভিযোগে ভর্ৎসিত হয়ে বিদায় নিতে বাধ্য হন। তৃতীয় ব্যক্তির মেয়াদ ছিল এক সপ্তাহ। তার মধ্যে তিনি পদত্যাগে বাধ্য হন। চতুর্থ জন রাষ্ট্রপতি হিসাবে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন। দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির অবনতির কারণেই এই রাজনৈতিক অস্থিরতা বলে ধারণা। প্রথমত বলা প্রয়োজন, পেরুতে আয় ও সম্পদের অসাম্য ব্যাপক। বিশেষত, আন্দিজের গ্রামাঞ্চল এবং উত্তর উপকূলীয় শহরাঞ্চলের মধ্যে এই বৈষম্য প্রবল। বিশেষত, গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারীরা ব্যাপক দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করে। এমনকি শহরাঞ্চলের মানুষদের মধ্যে বিশেষত বস্তিতে বসবাসকারীরা দারুণ অর্থনৈতিক দুর্দশার মধ্যে থাকেন। আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সঙ্কট এই বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। এক তথ্যে দেখা যায়, ১০ শতাংশের বেশি জনসংখ্যাকে এই অর্থনৈতিক সঙ্কট চরম দারিদ্র্যে নিক্ষেপ করেছে। দেশের ৬২ শতাংশ জনসংখ্যার কোনো ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই। শতকরা ১২ ভাগ মানুষকে গাদাগাদি করে বসবাস করতে হয়। পেরুতে বেকার সমস্যা ভয়াবহ। এমনকি যারা কর্মরত তাদের ৭০ শতাংশই অসংগঠিত ক্ষেত্রের যা লাতিন আমেরিকার দেশগুলির মধ্যে সর্বাধিক। অসংগঠিত ক্ষেত্রে যারা কর্মরত তাদের চাকরির কোনো নিরাপত্তা নেই। নেই নিয়মিত বেতনের নিশ্চয়তা। বেতনের পরিমাণও খুব সামান্য। এদের সামনে দুটি পথ আছে - হয় কম বেতনে চাকরি করতে হবে নয়তো চাকরি ছেড়ে নিশ্চিত মৃত্যুকে বেছে নিতে হবে। এই অসহনীয় জীবনযন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে অনেকেই গ্রামে ফিরে যাচ্ছেন। গ্রামাঞ্চলের পরিস্থিতিও আদৌ সুখকর নয়। কারণ কৃষিতেও রয়েছে ব্যাপক অসাম্য। ‘লাতিন আমেরিকার গ্রামাঞ্চলের বৈষম্য শীর্ষক অক্সফ্যামের একটি রিপোর্ট ২০১৬ সালে প্রকাশিত হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে, পেরুতে এই বৈষম্য লাতিন আমেরিকার মধ্যে সর্বাধিক। পেরুর ১ শতাংশ কৃষি খামারের নিয়ন্ত্রণে ৭৭ শতাংশের বেশি জমি কেন্দ্রীভূত।

অর্থনৈতিক সঙ্কটের পরিণতিতে দারিদ্র্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে অসন্তোষ। আর এখান থেকে আত্মপ্রকাশ করছে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ। বিশেষত কৃষি মজুর, শ্রমিক এবং বেকার যুবকদের মধ্যে। এযাবৎকাল ক্ষমতায় আসীন সরকারগুলি দমনপীড়নের মাধ্যমে এর মোকাবিলা করেছে। এছাড়া সরকারি প্রতিনিধিদের বিভিন্ন দুর্নীতি মানুষ দেখেছে। এসবের কারণে বিভিন্ন রাষ্ট্রপতিকে পদত্যাগ করতে হয়েছে এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয়েছে।

কোভিড-১৯ অতিমারীর আক্রমণ পেরুর সামাজিক নিরাপত্তা বিশেষত চিকিৎসা সংক্রান্ত নিরাপত্তার ফাঁকফোকরগুলি স্পষ্ট করে দিয়েছে। বিশ্বে জনসংখ্যাপিছু মৃত্যুহার সবথেকে বেশি পেরুতে। দেশটিতে এপর্যন্ত ১ লক্ষ ৪০ হাজার মানুষ অতিমারীতে মারা গেছেন। দেশের ভয়াবহ আর্থিক সঙ্কটের কারণে এই অতিমারীর প্রতিরোধে কোনো ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়নি। প্রতিষেধক টিকা এলেও তার সংখ্যা এতই কম যে চাহিদা মতো তা জনগণের কাছে পৌঁছানো যায়নি।পেরুর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের এটিই ছিল প্রেক্ষাপট।

এই সময়ে কেউ ভাবেনি যে, কাস্তিলোকে মানুষ রাষ্ট্রপতি হিসাবে মেনে নেবে। কিন্তু তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ফুজিমোরি তাঁকে লড়াইয়ের মুখে ঠেলে দেন। ফুজিমোরি সর্বশেষ তিনটি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। কাস্তিলো এক ছোট কৃষক পরিবারের সন্তান। একজন শিক্ষক ও সমাজসেবক হিসাবে সাধারণ মানুষ তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। তিনি দেশের কৃষক সমাজের অংশ হিসাবে এবং ট্রেড ইউনিয়নের কর্মী হিসাবে শ্রমিকশ্রেণির কাছে খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তাঁর সমগ্র নির্বাচনী প্রচার ছিল গরিব মানুষ কেন্দ্রিক।তিনি নির্বাচনী প্রচারে ধনীদের ওপর কর আরোপ, তামা উৎপাদকদের ওপর কর বৃদ্ধি প্রভৃতি প্রতিশ্রুতি দেন।তামা শিল্পে বিদেশি উৎপাদক সংস্থাগুলির জাতীয়করণের প্রতিশ্রুতিও তিনি দিয়েছেন। তিনি একইসঙ্গে দেশের সামরিক যুগের শাসন, নব্য উদারনীতি এবং সমগ্র বৈষম্যের অবসান সম্পর্কে একটি গণভোটের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। একইসঙ্গে তাঁর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির মধ্যে জনজাতি, মহিলা, কৃষকসমাজের অধিকার রক্ষার কথা ছিল। ২০১৭ সালে শিক্ষক ধর্মঘটে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা থেকে দেশের শিক্ষা সম্পর্কে তাঁর স্বচ্ছ ধারণা তৈরি হয়। এজন্য শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ জিডিপি'র ৩.৫ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে ১০ শতাংশ করার প্রতিশ্রুতি তিনি তাঁর নির্বাচনী প্রচারে উল্লেখ করেছেন।তাঁর শিক্ষা সংক্রান্ত প্রস্তাব ও কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি বিশেষত দেশের যুবকদের আকর্ষণ করেছে।

অন্যদিকে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ফুজিমোরি নিজেকে একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ হিসাবে তুলে ধরেন। তিনি কাস্তিলোকে একজন অপরিণত রাজনীতিবিদ বলে অ্যাখ্যা দেন। তাঁর অভিযোগ হলো, কাস্তিলো একজন কমিউনিস্ট এবং পেরুর 'শাইনিংপাথ’ আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক রয়েছে। তিনি প্রতিশ্রুতি দেন, ক্ষমতাসীন হওয়ার পরে পুরনো এবং অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদদের তিনি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদে প্রতিষ্ঠিত করবেন। এই পুরনো রাজনীতিবিদদের মধ্যে তাঁর পিতা আলবার্তো ফুজিমোরি রয়েছেন বলে অনেকেই মনে করেন।পেরুর জনগণ একে ডিক্টেটর বলে মনে করেন। প্রসঙ্গত, দেশের বামপন্থী জঙ্গি আন্দোলন ‘শাইনিং পাথ’-এর ওপর শুরু থেকেই দমনপীড়ন চালিয়ে আলবার্তো ফুজিমোরি ৭০ হাজার মানুষকে খুন ও গুম করেন। এদের ৮০ শতাংশ ছিলেন গ্রামের মানুষ। এর বিরুদ্ধে ব্যাপক লড়াই হয় এবং ফুজিমোরি গ্রেপ্তার হন। বর্তমানে তিনি কারাগারে রয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতিরও অভিযোগ রয়েছে। পরবর্তীকালে দক্ষিণপন্থী রাষ্ট্রপতিরা তাঁকে মুক্ত করার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তাঁরা ব্যর্থ হন।এই পরিস্থিতিতে তাঁর কন্যা শ্রীমতি কেইকো ফুজিমোরির প্রতিশ্রুতি ছিল তিনি ক্ষমতাসীন হলে পিতাকে মুক্ত করবেন। কেইকো ফুজিমোরির বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। ফলে সমস্ত দিক থেকেই পেরুর নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতি বেশ জটিল। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এই পরিস্থিতির মোকাবিলা কাস্তিলো কিভাবে করেন সেদিকেই তাকিয়ে আছে সমগ্র লাতিন আমেরিকা।