ইডলিবকে কেন্দ্র করে সিরিয়া তুরস্ক সংঘাত
লালন ফকির
সিরিয়া এবং তুরস্কের সীমানায় অবস্থিত ছোট্ট অঞ্চল সিরিয়ার ইডলিবকে কেন্দ্র করে উভয় দেশের মধ্যে পুনরায় সংঘাত সৃষ্টি হয়েছে। গত ১ মার্চ ইডলিবের উপর তুরস্কের ড্রোন হামলার পর উভয় দেশের মধ্যে সংঘর্ষ শুরুর আশঙ্কা তৈরি হয়। এই অঞ্চলটি জেহাদি জঙ্গিদের অন্যতম ঘাঁটি বলে পরিচিত এবং এপর্যন্ত ৯০ হাজার মানুষ এলাকাচ্যুত হয়েছেন। ১ মার্চ ড্রোন হামলার এক সপ্তাহ পূর্বে তুর্কি ড্রোনগুলি সিরিয়ার আকাশসীমা লঙ্ঘন করে সিরিয়ার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বেশ কিছু অংশকে তছনছ করে দেয়। তুরস্কের দাবি যে, এই আক্রমণে সিরিয়ার সাঁজোয়া গাড়ি এবং ট্যাঙ্ক সহ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার এক উল্লেখযোগ্য অংশ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। সিরিয়ার তিনজন সামরিক জেনারেলসহ বেশ কিছু সৈন্য এই আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছে। ফেব্রুয়ারির ২৭ তারিখে তুরস্কের সেনাবাহিনী ইডলিবে অবস্থিত সিরিয়ান আরব আর্মির (এসএএ) উপর আক্রমণ করলে ৩৬জন সিরিয়ান সেনা নিহত হয়।
তুর্কি রাষ্ট্রপতি তারিপ এরদোগান এর পূর্বে সিরিয়ার সমস্ত সেনাকে ইডলিব ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাঁর মতে এই এলাকাকে ‘নিরাপত্তা অঞ্চল’-এ পরিণত করতেই তা প্রয়োজন। কিন্তু তুরস্কের রাষ্ট্রপতির এই নির্দেশ মানতে সিরিয়া রাজি হয়নি। ফলে তুরস্ক একে অজুহাত করে সিরিয়ার উপর সামরিক আক্রমণ সংঘটিত করে। তুরস্কের এই আক্রমণের ফলে সিরিয়ান আরব আর্মিকে সাময়িকভাবে শহরাঞ্চল থেকে সরে যেতে হয়। এই অঞ্চলটি ইডলিব শহরে প্রবেশের প্রধান পথ।
ফেব্রুয়ারি মাসের তেরো তারিখে তুরস্কের প্রতিরক্ষামন্ত্রী হুলুমি আকর হুমকির স্বরে বলেছেন যে, সিরিয়া-তুরস্ক সীমানায় অবস্থিত ইডলিব শহরের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব তাদের, কারণ এখানে সিরিয়ান বিদ্রোহী সেনাদের অবস্থান রয়েছে। রাশিয়ার সোচিতে স্বাক্ষরিত রুশ-সিরিয়া শান্তিচুক্তিতে বলা হয়েছে যে, সিরিয়া ভূখণ্ডে তুরস্ক পর্যবেক্ষণ ঘাঁটি নির্মাণ করতে পারবে, যার মাধ্যমে অস্ত্র সংবরণ চুক্তি রক্ষিত হচ্ছে কিনা তা তারা দেখবে। তুর্কি প্রতিরক্ষামন্ত্রী আরও জানিয়েছেন যে, ‘র্যা ডিকালস্’ সহ সকলেই এই অস্ত্র সংবরণ চুক্তি অনুসরণ করছে কিনা তা দেখাই হবে তুর্কি সেনাবাহিনীর দায়িত্ব।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে এই ‘র্যা ডিকালস্’-এর অর্থ হলো পূর্বতন আলকায়দা যোদ্ধা যারা বর্তমানে হায়াত তাহির আল্-সাম (এইচটিএস) বা সিরিয়া লিবারেশন কমিটির ছত্রছায়ায় সংগঠিত হয়েছে। এইচটিএস ২০১৭ সালে তৈরি হয়েছিল। ইডলিবে অবস্থিত জেহাদি গোষ্ঠীগুলিকে নিয়ে এই এইচটিএস গঠিত হয়েছিল। এইচটিএসের প্রধান স্তম্ভ হলো সিরিয়ার আলকায়দা শাখা। এদের পূর্বতন নাম ছিল জাবাট ফতেহ আল শাম এবং তারও পূর্বে নাম ছিল জামাত আল্ নাসরা। পর্যবেক্ষকদের মতে বারে বারে নাম পরিবর্তনের কারণ হলো আল কায়দার সাথে এদের সম্পর্কহীনতাকে প্রতিষ্ঠিত করা।
সিরিয়াকে কেন্দ্র করে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এইচটিএসে’র মধ্যে যে সমস্ত অংশ রয়েছে তারা উত্তর সিরিয়াতে বিশেষত আলেপ্পো থেকে ইডলিব পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় তুরস্কের হয়ে প্রক্সি লড়াইতে শামিল হয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে ইরান ও রাশিয়ার সহযোগিতায় সিরিয়ান আরব আর্মি গঠিত হলে তারা পশ্চাদপসরণ করে এবং ইডলিবের বিভিন্ন অঞ্চলে আশ্রয় নেয়। এদের মধ্যে একদিকে যেমন এইচটিএস’র জেহাদি অংশ ছিল তেমনই অন্যদিকে ছিল চেচনিয়া, তাজিকস্তান, উজবেকিস্তান, তুরস্ক থেকে আগত জেহাদিরা। ২০১৮ সাল থেকেই সিরিয়ার মাটি থেকে আল কায়দাকে উৎখাত করার জন্য সিরিয়ার সরকার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে এসেছে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে এইচটিএসে’র আধ্যাত্মিক দিকটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রশ্নে ইডলিবের ধর্মীয় জগতে সৌদি সালাফি ধর্মগুরু আবদুল্লাহ আল-মুহাসিনির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। একেই এইচটিএস’র প্রধান রূপকার বলে মনে করা হয়। ইনি তুর্কিস্তান ইসলামিস্ট পার্টির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এবং চীনা ইউবোরদের সব থেকে প্রতিক্রিয়াশীল অংশের সাথে যুক্ত। এক সময় এই মুহাসিনিই ইসলামিক স্টেট্সের সাথে এই অঞ্চলের অন্যান্য সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলির যোগাযোগ রক্ষায় উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এক সময় সৌদি আরব পর্যন্ত এই হিংসাত্মক কার্যকলাপকে মহিমান্বিত করার প্রবণতা এবং তার ধর্মীয় মৌলবাদী নীতির বিরোধিতা করতে বাধ্য হয়েছিল। আরওয়াইট খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে তার ঘৃণাসুলভ এবং পক্ষপাতমূলক বিবৃতি, তার হিংসাত্মক চরিত্রকেই প্রমাণ করে।
বিগত কয়েক বছর ধরে এইচটিএস নিজেদের ‘মডারেট’ বলে প্রমাণিত করার ব্যাপক প্রয়াস চালিয়েছে। যেমন ২০১৫ সালে এই সংগঠন ইডলিবের প্রধান শক্তি রূপে পরিণত হয়েছে। তখন থেকেই তারা আল কায়দার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। এরা নিজেদেরকে ইসলামিক মতাদর্শ সম্পন্ন সিরিয়ান জাতীয়তাবাদী শক্তি বলে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে। কিন্তু এই প্রচারের সাথে বাস্তবের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। কারণ তারা যে প্রচার করে তার মূল সুর হলো এই যে, সিরিয়া রাষ্ট্র পরিচালিত হবে শরিয়ত আইন অনুসারে এবং তাদের বিভিন্ন বক্তব্য আলকায়দার মতোই প্রতিক্রিয়াশীল, এমিনকি তুরস্কের শাসকদল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (একেপি) পার্টির সাথেও এর মিল রয়েছে, রাজনৈতিক সম্পর্কও রয়েছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের বক্তব্য হলো এই যে, এই ধরনের ‘র্যা ডিকালস্’-এর সংখ্যা এক লক্ষ থেকে দুই লক্ষ, যারা ইডলিবে রয়েছেন এবং এরা আল কায়দার সমর্থক। এই বিষয়টি মার্কিন প্রশাসনেরও অজানা নয়।
ইডলিব সম্পর্কে প্রদত্ত রাষ্ট্রসংঘের পরিসংখ্যান ও তথ্যগুলি কম উদ্বেগের বিষয় নয়। ইডলিবের জনসংখ্যা প্রায় ৩০ লক্ষ। এর এক তৃতীয়াংশ হলো শিশু। এই মানুষেরা সকলেই এই অঞ্চলের স্থানীয় অধিবাসী নয়। এদের এক অংশ উদ্বাস্তু হিসাবে অন্য জায়গা থেকে এসেছে। ২০১৯ সালে সংঘর্ষ যখন তীব্রতা লাভ করে রাষ্ট্রসঙ্ঘের তথ্য মতন সেই সময় উদ্বাস্তুর সংখ্যা নয় লক্ষে দাঁড়ায়। রাষ্ট্রসঙ্ঘের মানবাধিকার সম্পর্কিত আন্ডার সেক্রেটারি মার্ক লোকর একে একবিংশ শতাব্দীর মানবাধিকারের উপর সর্বশেষ আক্রমণ বলে অভিহিত করেছেন।
এই পরিস্থিতিতে ইডলিব থেকে এক বড় অংশ উদ্বাস্তু উৎখাত হয়ে তুরস্কের বিভিন্ন সীমানা শহরে আশ্রয় গ্রহণ করছে, যাতে সেখান থেকে তুরস্কের বিভিন্ন শহরে আশ্রয় গ্রহণ করা যায়। নিজেদের উপর থেকে চাপ কমানোর জন্য এবং ইয়োরোপীয় ইউনিয়নের উপর চাপ সৃষ্টি করতে তুর্কি প্রধানমন্ত্রী এই সব উদ্বাস্তুদের গ্রিসে পাঠিয়ে দিতে কাসটানিজ সীমানা উন্মুক্ত করে দিচ্ছে। এখানে এই প্রশ্নে গ্রিস সীমানা বাহিনীর সাথে উদ্বাস্তুদের সংঘর্ষ সংগঠিত হচ্ছে। এই ঘটনার বেশ কিছু প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হচ্ছে। তুরস্কের এই অবস্থানের প্রধান লক্ষ্য হলো ইয়োরোপীয় ইউনিয়নের উপর চাপ সৃষ্টি করা, যাতে তারা তুরস্ক-সিরিয়া সংঘাতে তুরস্ককে সমর্থন করে। কারণ তুরস্ক ন্যাটোভুক্ত রাষ্ট্র হলেও এপর্যন্ত ন্যাটো এই সংঘাতে তুরস্কের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেনি। কিন্তু এই সংঘাতে সিরিয়ার সাধারণ মানুষ দারুণ দূরবস্থার সম্মখীন।
এই প্রেক্ষাপটে ২০১৭ সালের মে মাসে তুরস্ক, রাশিয়া এবং ইরানের মধ্যে আস্তানায় (কাঝাখস্থান) একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এই চুক্তির লক্ষ্য হলো : ইডলিবে একটি ‘যুদ্ধ সম্প্রসারণ বিরোধী’ অঞ্চল গড়ে তোলা হবে যার নেতৃত্বে থাকবে তুরস্ক। সিরিয়ার উত্তরাঞ্চল সম্পর্কে একটি পারস্পরিক বোঝাপড়ায় পৌঁছতে ২০১৯ সালের অক্টোবরে রুশ রাষ্ট্রপতি পুতিন এবং তুর্কি রাষ্ট্রপতি এরদোগানের মধ্যে সোচিতে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। মার্কিন ভূমিকা প্রত্যাহৃত হওয়ার পর এই অঞ্চলে পূর্ণাঙ্গ তদারকি প্রতিষ্ঠা করা সিরিয়ার পক্ষে সম্ভব নয়। রাশিয়ার পক্ষে এই অঞ্চলে পর্যবেক্ষণ জারি করা সম্ভব।
পূর্বোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে একথা বলা প্রয়োজন, ইডলিবকে কেন্দ্র করে সিরিয়া তুরস্কের বিরোধ নিষ্পত্তির সম্ভাবনা দেখা দিলেও তার যে সত্ত্বর মীমাংসা হবে — রাজনৈতিক মহল তা মনে করে না সিরিয়ার আসাদ সরকার ইরানীয়দের সাহায্যে এইচটিএসে’র দখলীকৃত অঞ্চল উদ্ধার করার যে প্রয়াস নিয়েছে তা তুর্কি সরকার সমর্থন করে না। বর্তমান পরিস্থিতিতে তুরস্কের বিরোধিতায় রাশিয়া অবতীর্ণ হতে রাজি নয়। অবশ্য এই ধরনের জটিলতা সত্ত্বেও ইডলিব নিয়ে যে আলোচনার অগ্রগতি ঘটেছে তা এই অঞ্চলের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যে ইতিবাচক ঘটনা এবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।