E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

কাবুলে আতঙ্ক

আফগানিস্তানে এখনও গঠিত হয়নি নতুন সরকার


তালিবানের পতাকা নামিয়ে জাতীয় পতাকা হাতে জালালাবাদে বিক্ষোভে সাধারণ মানুষ।

নিজস্ব সংবাদদাতাঃ আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার শুরু হওয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ঝড়ের গতিতে তালিবানরা সে দেশের ৩৪টি প্রদেশ এবং শেষ পর্যন্ত রাজধানী কাবুলের দখল নিয়ে নিল। তালিবানরা কাবুলে ঢোকার কয়েক ঘণ্টা আগেই ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতি আশরাফ ঘানি সে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। সংযুক্ত আরব আমির শাহি জানিয়েছে রাষ্ট্রপতি আশরাফ ঘানিকে তারা তাঁদের দেশে আশ্রয় দিয়েছে মানবিক কারণে। তালিবান মুখপাত্ররা ১৭ আগস্ট দাবি করেছেন তারা শান্তি চান। প্রতিহিংসার পথে তারা যাবেন না। কিন্তু বাস্তবে এই নীতি কার্যকর হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে। কাবুল সন্ত্রস্ত হয়ে গেছে। হাজার হাজার আফগান তালিবানের হাতে সম্ভাব্য নিপীড়ন এড়ানোর জন্য দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। সোশ্যাল মিডিয়া এবং বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে ছড়িয়ে থাকা ভিডিয়োতে দেখা গেছে বিমানের সিঁড়ি বেয়ে ওঠার জন্য কয়েক শত মানুষ ধাক্কাধাক্কি করছে, বিমান টেক অফ করার মুহূর্তেও বিমানে ওঠার চেষ্টা করছেন অনেকে। মার্কিন বিমানবাহিনীর একটি বিমানের পাশে রানওয়ে ধরে ছুটছেন কয়েকশো মানুষ, লাফিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে দেখা যাচ্ছে এরকম দৃশ্যও।

আগামী সরকার গঠনের প্রশ্নে তালিবানদের নেতা হিসেবে সামনে এসেছে আবদুল ঘানি বারাদারির নাম। তালিবানদের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আখুনজাদা হলেও তালিবানদের সরকার গঠন হলে আবদুল ঘানি বারাদারি প্রধান হবেন বলে মনে করা হচ্ছে। আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের অনুরোধে কাতারের শান্তি আলোচনায় তিনি সাহায্য করবেন এই অজুহাতে ২০১৮-এর অক্টোবরে পাকিস্তানের জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয় বারাদারিকে। বারাদারি ২০২০-তে আমেরিকার সঙ্গে শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এরপর আর মার্কিন সেনাদের সঙ্গে সংঘাতে জড়ায়নি তালিবানরা। পরের এক বছর ধরে আফগান সরকারি সেনারা তাদের লক্ষ্যবস্তু ছিল।

তালিবানদের আফগানিস্তান দখলের পরেই কাবুলের সমস্ত বিদেশি দুতাবাস বন্ধ। বাণিজ্যিক বিমান চলাচল পুরো বন্ধ হয়ে গেছে সেখানে। কাবুলের ভারতীয় দূতাবাসের মোট ১৯২ জন কর্মী সকলেই দু’দফায় দেশে ফিরেছেন। নয়াদিল্লির বিদেশ দপ্তর থেকে প্রেস বিবৃতিতে জানানো হয়েছে আফগানিস্তানে আটকে পড়া ভারতীয়দের দেশে নিরাপদে ফিরিয়ে আনতে দায়বদ্ধ। ভারত সরকার জানিয়েছে, কাবুল বিমানবন্দর বাণিজ্যিক বিমান চলাচলের জন্য খোলা হলে সব ভারতীয়দের ফেরানোর ব্যবস্থা করা হবে।

সিপিআই(এম) সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছেন, আফগানিস্তান তালিবান দখলে যাওয়ার আগেই সেখানে ভারতের নাগরিকদের দেশে ফেরানোর আগাম পরিকল্পনা করতে ব্যর্থ হয়েছে মোদী সরকার। কোনো পরিকল্পনা তারা করেনি। অথচ তাদের ফেরাতে আগাম পরিকল্পনা নেওয়ার প্রয়োজন ছিল। তিনি বলেন, ভারত সরকারের উচিত আফগানিস্তানে ভারতীয় নাগরিকদের সমস্ত খোঁজখবর তথ্য রাখা, তাদের নিরাপদে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা। তিনি জানান, আফগানিস্তানের তালিবান দখলের অন্তত ১০ দিন আগে থেকে অন্যান্য দেশ তাঁদের নাগরিকদের দেশে ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা নেয়, ভারত সরকারের সেসব কোনো পরিকল্পনা ছিল না।

আফগানিস্তানে তালিবানের দখলের পর আন্তর্জাতিক মহলের নজরে রয়েছে বিশেষ করে দু’টি প্রশ্ন। তালিবানরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এমন কোনো সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীকে জায়গা করে দেয় কিনা যারা আন্তর্জাতিকভাবে তৎপর। তেমন হলে বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে বৈধতা পাবার ক্ষেত্রে সঙ্কটে পড়বে তালিবানদের আগামী সরকার। দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, তালিবানের প্রথম জমানায় মহিলাদের উপর ব্যাপক অত্যাচারের ঘটনা ঘটেছিল, সেই প্রশ্নে তালিবানরা কতদূর নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করবে তা নিয়ে উৎকণ্ঠা।

এক যৌথ বিবৃতিতে আফগান প্রসঙ্গে সিপিআই(এম) এবং সিপিআই বলেছে আফগানিস্তান নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক শক্তিগুলির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করা উচিত ভারতের। আফগান জনগণ যাতে শান্তিতে এবং সুস্থির পরিবেশে বসবাস করতে পারেন সেজন্যই ভারতের এই পদক্ষেপ করা উচিত। আফগানিস্তানে আটকে পড়া ভারতীয়দের নিরাপদে ফিরিয়ে আনার কাজটিও অগ্রাধিকার দিয়ে করতে হবে ভারত সরকারকে।

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আফগানিস্তানে লজ্জাজনক পরাজয়ের সম্মুখীন হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তালিবান শাসনের পতনের বিশ বছর পর তালিবানরা আবার ক্ষমতায় এসেছে। আশরাফ রনিঘা নেতৃত্বাধীন সরকার এবং জাতীয় বাহিনীর পতন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার ন্যাটো মিত্রদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের প্রকৃতির দুর্বলতাগুলো উন্মোচিত করেছে।

ভারত সরকারের আফগান নীতি অন্ধভাবে আমেরিকানদের অনুসরণ করছিল এবং এর ফলে এই অঞ্চলে ভারত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল এবং বাস্তবে ভারতের সামনে নামমাত্র কয়েকটি বিকল্প রয়েছে।

১৯৯০-এর দশকে, পূর্বতন তালিবান সরকার ছিল চরম মৌলবাদী, একইসাথে ছিল নারী, শিশু কন্যারা এবং অবদমিত জাতিগত সংখ্যালঘুসমুহের জন্য ধ্বংসাত্মক।

তালিবান কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত নতুন ব্যবস্থায় নারীদের অধিকারের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদান এবং জাতিগত সংখ্যালঘুদের অধিকার স্বীকার করা একান্ত প্রয়োজন।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগ যে, আফগানিস্তান যেন ইসলামিক স্টেট এবং আল কায়েদার মতো সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলোর স্বর্গরাজ্য না হয়ে ওঠে, তা ১৬ আগস্ট আফগানিস্তান নিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠকে যৌথভাবে প্রকাশ করা হয়েছিল।

আফগান জনগণ যাতে শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল পরিবেশে বসবাস করতে পারে সেজন্য ভারতকে অবশ্যই প্রধান আঞ্চলিক শক্তিগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে হবে। ভারত সরকারের উচিত অবিলম্বে আফগানিস্তানে আটকে পড়া সকল ভারতীয় নাগরিকদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার জন্য সর্বোচ্চ উদ্যোগ গ্রহণ করা।

তাৎপর্যপূর্ণভাবে তালিবানরা ঘোষণা করেছে তাদের বাহিনীকে কোনো ঘরে ঢুকতে বা সম্পত্তির ক্ষতি করতে নিষেধ করা হয়েছে। মার্কিন দূতাবাস এবং মার্কিন মদতপ্রাপ্ত স্থানীয় যুদ্ধবাজ নেতাদের বিলাসবহুল বাড়ি সম্পূর্ণ সুরক্ষিত থাকবে। আবার হাজার হাজার আফগান, তালিবানের হাতে সম্ভাব্য নিপীড়ন এড়ানোর জন্য দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পরেই একদল মহিলাকে আফগানিস্তানে তাদের অধিকারের দাবিতে প্রথম প্রকাশ্য বিক্ষোভ করতে দেখা গেছে। ইরানের সাংবাদিক মাসিহ আলিনেজাদের টুইটারে শেয়ার করা একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, চারজন আফগান নারী, যাদের ঘিরে তালিবানরা, কাবুলের একটি রাস্তায় হাতে লেখা পোস্টার ধরে রয়েছে। মহিলাদের সামাজিক সুরক্ষা, কাজের অধিকার, শিক্ষার অধিকার এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণের অধিকার সহ তাদের অধিকার দাবি করার কথা শোনা গেছে ভিডিয়োটিতে। ভিডিওতে মহিলাদের বলতে শোনা যায়, ‘‘বছরের পর বছর ধরে আমাদের সমস্ত অর্জনের সাথে আপস করা উচিত নয়...’’। ১৫ আগস্ট তালিবানরা কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর অনেক নারী তাদের জীবন ও নিরাপত্তার আশঙ্কায় আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে যান।

এদিকে বামিয়ানে সংখ্যালঘু হাজারা গোষ্ঠীর বিখ্যাত নেতা আব্দুল আলি মাজারের মূর্তি ভেঙে দিয়েছে তালিবানরা। তালিবানের প্রথম জমানায় মাজারে-কে খুন করা হয়েছিল দেশের সমস্ত জনগোষ্ঠীর সমান অধিকারের দাবিতে লড়াই করায় মাজারে-কে জাতীয় ঐক্যের শহিদ বলে ঘোষণা করা হয়েছিল ২০১৬-তে।

প্রশ্ন উঠেছে দু’দশক ধরে হাজার হাজার মার্কিন সেনা আফগানিস্তানে থাকার পরেও তালিবানরা এই শক্তি কোথায় পেল, কারা তাদের অস্ত্র দিল? কেনই বা ন্যাটো প্রশিক্ষিত আফগান সরকারি সেনাদের প্রতিরোধ ভেঙে পড়ল তাসের ঘরের মতো?

সংবাদ সংস্থার খবর, চীন বলেছে তালিবান জমানাকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে আফগানিস্তানের সরকার গঠনের পর। চীনের বিদেশমন্ত্রকের আশা, এই সরকার হবে মুক্ত এবং সর্বস্তরের প্রতিনিধিত্বমূলক।