আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার প্রসঙ্গে
লালন ফকির
অবশেষে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া চলছে। এখনও পর্যন্ত সিদ্ধান্ত আছে যে, আগামী ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আফগানিস্তান ভূখণ্ড থেকে মার্কিন সেনা সহ সমস্ত বিদেশি সেনা প্রত্যাহার করা হবে। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী গত ১৫ আগস্ট কাবুলের পতন ঘটেছে। তালিবানরা আফগানিস্তান দখল করেছে।
আফগানিস্তানে বিগত এক দশক ধরে পর্যায়ক্রমে প্রায় এক লক্ষ সেনার জন্য ঘাঁটি নির্মাণ করেছে মার্কিন প্রশাসন। এখন এই সেনা প্রত্যাহৃত হওয়ার পর সেখানকার পরিস্থিতি কী হবে সেটাই এখন আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বিষয়ে আলোচনার পূর্বে এর প্রেক্ষিত সম্পর্কে আলোচনা করা প্রয়োজন। আফগানিস্তান মধ্য এশিয়ার একটি স্থলবেষ্টিত দেশ। এর অতীতে নাম ছিল আরিয়ানা বা প্রাকট্রিয়া। পরে পরিচিত হয় থোরাসান (উদিত সূর্যের দেশ) নামে।
আফগানিস্তানে রয়েছে ২০টি জাতিগোষ্ঠীর বাস। এই জাতিগোষ্ঠী আবার অসংখ্য উপজাতি গোষ্ঠীতে বিভক্ত। প্রত্যেকটি জাতিগোষ্ঠীর রয়েছে নিজস্ব ভাষা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। আফগানিস্তানকে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে এ এক বড়ো প্রতিবন্ধকতা। এই অঞ্চলের মানুষের একটিই বন্ধন তা হলো ধর্ম। এখানকার প্রায় সব মানুষের ধর্ম ইসলাম। আফগানিস্তানের সবচেয়ে বড়ো উপজাতি গোষ্ঠীটি পার্যতুন বা পাখতুন বলে পরিচিত। এরপরই রয়েছে তাজিক উপজাতি গোষ্ঠী।
প্রাচীনকালে পারসিক, গ্রিক, মোঘল প্রভৃতি নানা জাতের মানুষ এই অঞ্চল অধিকার করেছে। ১৭৪৭ সালে আফগান নেতা আহমদ শাহ দুরানির নেতৃত্বে প্রথম আফগান জাতিগুলি ঐক্যবদ্ধ হয়। ১৭৭৬ সালে দুরানি কান্দাহার থেকে কাবুলে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। ইতিমধ্যে আফগানিস্তান অধিকার করার জন্য রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অ্যাংলো আফগান যুদ্ধ শুরু হয়। ১৮শ শতাব্দীব্যাপী এই যুদ্ধ চলে।
তৃতীয় অ্যাংলো আফগান যুদ্ধের শেষে ১৯১৯ সালের আগস্ট মাসে ব্রিটিশ শাসনের অবসানে আফগানিস্তান পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯২৩ সালে আমানুল্লা দেশের প্রথম সংবিধান চালু করেন এবং নিজেকে রাজা হিসাবে ঘোষণা করেন। ১৯৭০ দশকের শেষার্ধ থেকে আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। ১৯৭৯ ও ১৯৮০ সালে সোভিয়েত বাহিনী আফগানিস্তানে প্রবেশ করে।
১৯৯২ সালের এপ্রিলে কাবুল দখল করে মুজাহিদিন গোষ্ঠীগুলি। ১৯৯৪ সাল থেকে শুরু হয় মুসলিম মৌলবাদী তালিবানদের শাসন। ২০০১ সালের মার্চ মাসে তালিবানরা বামিয়ানের বিশাল বুদ্ধমূর্তি ভেঙে দেয়। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্রে উগ্রপন্থী হানার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে সামরিক অভিযান চালায়। ২০০১ সালের নভেম্বর মাসে মার্কিন সেনারা আফগানিস্তান দখল করে। এইভাবে আফগানিস্তানে তালিবান শাসনের অবসান ঘটে। আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের সপক্ষে মার্কিন প্রশাসনের অজুহাত ছিল যে, বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার উপর আক্রমণের পরিকল্পনা ছিল আলকায়দার নেতা বিন লাদেনের। এই বিন লাদেন তখন আফগানিস্তানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁকে নিজেদের কাছে ফেরত চেয়েছিল মার্কিন প্রশাসন। কিন্তু আফগানিস্তানের তালিবান শাসকেরা তাতে রাজি ছিল না। তাই লাদেনকে ফিরে পেতে মার্কিন প্রশাসন আফগানিস্তান আক্রমণ করে।
আফগানিস্তানে তালিবান শাসকদের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। ২০০২ সালের জুন মাসে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হামিদ কারজাই রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হন। ২০০৩ সালের ১১ আগস্টে পাঁচ হাজার সেনার আন্তর্জাতিক বাহিনীর নেতৃত্ব গ্রহণ করে ন্যাটোর ২০০৪ সালে নতুন সংবিধান গৃহীত হয়। ওই বছর ডিসেম্বর মাসে দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসাবে নির্বাচিত হন হামিদ কারজাই।
পরবর্তীকালে ২০১৪ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে কারজাই ক্ষমতা ত্যাগ করেন এবং রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হন আসরাফ গনি। ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে সরকারিভাবে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো সেনা প্রত্যাহৃত হলেও কয়েক হাজার বিদেশি সেনা আফগানিস্তানে থেকে যায়।
আফগানিস্তান বর্তমানে এক সমস্যাসঙ্কুল রাষ্ট্র। রাষ্ট্রসঙ্ঘের মধ্যে আফগানিস্তান বিশ্বের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া দেশ। এখানে শিশু মৃত্যুর গড় হার সবচেয়ে বেশি। জনসংখ্যার ৫০ শতাংশ বেকার, মুদ্রাস্ফীতি ৫০০ শতাংশ। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির হিসাব অনুযায়ী প্রায় ৫০ লক্ষ মানুষ গৃহহীন। প্রায় ১৪ লক্ষ মানুষ ইরানে এবং ৯ লক্ষ মানুষ পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছেন। দেশের ৮৬৬ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় প্রায় ১০লক্ষ ল্যান্ডমাইন পাতা আছে।
এই প্রেক্ষাপটে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের প্রসঙ্গটি আলোচনা করতে হবে। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিছুটা তাড়াহুড়ো করে সেনা প্রত্যাহারের অন্যতম কারণ হলো তালিবান কর্তৃক কাবুল দখলের আশঙ্কা। বর্তমানে মার্কিন সেনাবাহিনীর সামরিক ঘাঁটি বাগরামের অবস্থান কাবুলের সন্নিকটে। কাবুল বিমানবন্দর থেকে সড়কপথে এর দূরত্ব মাত্র আধ ঘণ্টা। এই সামরিক ঘাঁটি বিগত শতাব্দীর পঞ্চাশ দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক নির্মিত হয়েছিল। এক দশক পূর্বে এখানে প্রায় এক লক্ষ মার্কিন সেনার আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছিল।
আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের ঘটনাকে তালিবানরা ইতিবাচক পদক্ষেপ বলে ঘোষণা করেছে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহযোগী ব্রিটেন, জার্মানি এবং ন্যাটো যুদ্ধ জোটের অন্যান্য সঙ্গীরা মার্কিন সেনার তাড়াহুড়ো প্রত্যাহারকে তারা অসুবিধাজনক এবং আফগান সেনাদের নিরস্ত্র অবস্থায় নিক্ষেপ করার সাথে তুলনা করেছে। মার্কিন প্রচার মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে যে, মার্কিন গোয়েন্দা বিভাগ বাইডেন প্রশাসনকে জানিয়েছিল তালিবানরা আগামী ছয় মাসের মধ্যে কাবুল দখল করে নিতে পারে। এদের মতে আসরাফ গনির সরকারকে বড়োজোর আগামী দু’বছরের জন্য রক্ষা করা যেতে পারে। এদের মতে বিগত দেড় মাসে তালবানরা অনেকটাই কাবুলের দিকে অগ্রসর হয়েছে। তালিবানরা দাবি করেছে যে, তারা দেশের দুই-তৃতীয়াংশ এলাকার দখল নিয়েছে। বেশ কিছু বাণিজ্যিক শহরের সীমানা এলাকাতেও তারা পৌঁছে গিয়েছে।
মার্কিন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন অবশ্য বলেছেন যে, বাগরাম থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করে আফগানিস্তানকে বিপদের মুখে ঠেলে দিতে চাইছেন না। বাইডেন প্রশাসনের উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে, মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পরও আফগানিস্তানের উপর প্রয়োজনে বোমাবর্ষণ বা ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করার অধিকার মার্কিন প্রশাসনের থাকবে। আফগানিস্তানে তাদের সহযোগীদের রক্ষার কর্তব্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আছে।
তালিবানদের সাথে মার্কিন নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনীর যুদ্ধবিরতি চলছে। ফলে সামরিক বিশেষজ্ঞদের ধারণা এই অবস্থায় যদি মার্কিন সেনাবাহিনী তালিবানদের উপর আক্রমণ সংঘটিত করে, তাহলে তার প্রতিক্রিয়ায় পুনরায় আফগানিস্তানে সংঘর্ষ শুরু হবে। বিদেশি সেনা প্রত্যাহৃত হওয়ার সম্ভাবনাও বিনষ্ট হবে। বর্তমানে কাবুলে মার্কিন দূতাবাস সুরক্ষায় ৬০০-র বেশি মার্কিন সেনা মোতায়েন রয়েছে। তারাও চাপের সম্মুখীন হবে। তালিবানদের পক্ষ থেকে কৌশলগতভাবে মার্কিন সেনা ও ন্যাটো বাহিনীকে আক্রমণ করছে না। তাছাড়া তুর্কি সেনা ব্যতীত ন্যাটোর অন্য কোনো সেনা আফগানিস্তানে নেই। তুর্কি বাহিনী মার্কিন প্রশাসনকে জানিয়েছে যে, মার্কিন সেনা আফগানিস্তান থেকে চলে গেলে তাদের বাহিনী কাবুল বিমানবন্দরের সুরক্ষায় ব্রতী থাকবে। তালিবানরা অবশ্য তুরস্কের এই অবস্থানকে সমালোচনা করেছে।
আফগানিস্তান থেকে বিদেশি সেনা প্রত্যাহারের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন আফগানিস্তানের পার্শ্ববর্তী এলাকায় মার্কিন ঘাঁটি তৈরি করে আফগানিস্তানের উপর আক্রমণ সংগঠিত করতে নতুন এলাকার সন্ধানে মরিয়া হয়ে উঠেছে। কিন্তু পাকিস্তান তার ভূখণ্ডে মার্কিন ঘাঁটি করতে আপত্তি জানিয়েছে। তালিবানরা ইতিমধ্যেই এ ব্যাপারে পাক প্রশাসনকে হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছে। মধ্য এশিয়ার দেশগুলি বিশেষত উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, কিরঘিজস্তান ইতিমধ্যে এ ব্যাপারে কোনো সাড়া শব্দ করেনি। এদের মধ্যে উজবেকিস্তান এবং কিরঘিজস্তানে অতীতে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি ছিল। কিন্তু এইসব দেশের জনমতের বিরোধিতার জন্য তা বন্ধ করে দিতে হয়েছে।
পাকিস্তান সহ আফগানিস্তানের প্রায় সব প্রতিবেশী দেশ চায় তালিবানরা আফগানিস্তান থেকে সরে আসুক। আফগানিস্তানের জাতীয় সংহতি ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে রাশিয়া এবং চীনও উদ্বিগ্ন। পুনরায় আফগানিস্তানে যদি গৃহযুদ্ধ শুরু হয় তাহলে এর পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে বলে তাদের অভিমত। আফগান সমস্যার সমাধানে রাশিয়া কূটনৈতিক স্তরে খুবই উদ্যোগী। তারা শান্তিপূর্ণভাবে আফগানিস্তানে ক্ষমতা হস্তান্তর পর্বের সমাধান চায়। রাশিয়া ইতিমধ্যেই সন্ত্রাসবাদীদের তালিকা থেকে তালিবানদের নাম প্রত্যাহার করেছে। তালিবানরা জানিয়েছে যে, চীনের স্বপ্নের প্রকল্প বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) প্রকল্পকে তারা সমর্থন করে। আফগানিস্তান সাংহাই সংহতি সংস্থা (এসসিও)-র এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। এই সংস্থার অন্যতম সদস্য হলো চীন, রাশিয়া, ভারত ও পাকিস্তান। তালিবানদের সাথে ভারতও যোগাযোগ রেখে চলেছে।
এক কথায় বলা চলে যে, আফগানিস্তানের সাথে যুক্ত সব পক্ষই চাইছে আফগানিস্তানের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বন্ধ হোক। আফগানিস্তানের নিজস্ব সমস্যার সমাধানের জন্য সে দেশের জনগণের উপরই নির্ভর করা উচিত। তবেই এই সমস্যার সমাধান হতে পারে।