রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ঘিরে অশান্ত বেলারুশ
সঙ্কট নিরসনে শীর্ষবৈঠকে ই.ইউ.
নির্বাচনে ৮০ শতাংশের বেশি ভোট পাওয়ার দাবি করে ষষ্ঠ বারের মতো বেলারুশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন লুকাশেঙ্কা। যদিও নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ করে ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছেন সাবেক শিক্ষক বিরোধী নেত্রী শ্বেতলানা তিখানোভস্কায়া। এই বিক্ষোভের মধ্যেই তিনি দেশ ত্যাগ করেছেন, এমন খবর প্রকাশ করেছে বিবিসি। দাবি উঠেছে পুনর্নির্বাচনের। ওদিকে বিরোধী নেত্রী শ্বেতলানা ৯ আগস্টের নির্বাচনের ফলকে প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন তিনি অন্তবর্তীকালীন দায়িত্ব নিতে তৈরি। শ্বেতলানা ১০ আগস্ট থেকে লিথুনিয়ায় নিরাপদে রয়েছেন বলে জানিয়েছেন সে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
নির্বাচনের পর থেকেই লাগাতার বিক্ষোভ চলেছে বেলারুশের রাজধানীসহ বিভিন্ন শহরে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বলা হচ্ছে, ওই সময় উপস্থিত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক নজরদারি সংস্থা বলেছে নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে। হিংসার পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন ইয়োরোপীয় ইউনিয়ন কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট চার্লস মিচেল জরুরি শীর্ষ বৈঠক ডেকেছেন। তিনি বলেছেন, নির্বাচন অবাধ এবং নিরপেক্ষ হয়নি। তাঁরা অবরোধ চাপানোর বিষয়টিও বিবেচনা করছেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
তবে প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কার দাবি, বিদেশি শক্তির মদতেই এই বিক্ষোভ হচ্ছে। কোনোমতেই সরকার মাথা নত করবে না বলেও সাফ জানিয়ে দেন তিনি। পুনর্নির্বাচনের প্রস্তাব উড়িয়ে দিয়ে তিনি বলেছেন, তাহলে দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে।
বিক্ষোভ দমন সম্পর্কে তিনি বলেন, ২৫জন পুলিশ আহত হয়েছেন। তাদের হাত পা ভেঙে গেছে। তাদেরকে নির্মমভাবে মারা হয়েছে। তার জবাব দিতেই আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ চড়াও হয়েছে। এখন আপনারা কাঁদছেন কেন? আমরা আমাদের দেশকে কখনোই ধ্বংস হতে দেব না। কেউ তার চেষ্টা করলে সমুচিত জবাব দেওয়া হবে।
এদিকে, পোল্যান্ডের ওয়ারশ’তে অবস্থিত বেলারুশ দূতবাসের সামনেও বিক্ষোভ হয়েছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার নির্যাতনের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে পোল্যান্ড। ইংল্যান্ড জানিয়েছে, তারা লুকাশেঙ্কোর জয়কে অনুমোদন করছে না।
নির্বাচন পরবর্তী হিংসা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্র। হোয়াইট হাউজের প্রেস ব্রিফিংয়ে শান্তিপূর্ণভাবে বেলারুশ নাগরিকদের অধিকার নিশ্চিতের পাশাপাশি তাদের পুলিশি শক্তি প্রয়োগ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানানো হয়।
তবে আবারও প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় লুকাশেঙ্কাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। বেলারুশের এ শাসককে সমর্থন দিয়েছেন চীন, কাজাখস্তান, উজবেকিস্তান, আজারবাইজানের রাষ্ট্রপ্রধানেরা।
অর্থনীতির সমৃদ্ধির নিরিখে পৃথিবীতে জিডিপি’র অঙ্কে ৭২ নম্বরে রয়েছে বেলারুশ। প্রায় ১৯৫ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি বেলারুশের (এই হিসেব ২০১৯ সালের)। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ হিসেবে বেলারুশ অপেক্ষাকৃতভাবে শিল্পগত ভিত্তিক থেকে যথেষ্ট উন্নত। কৃষির ভিত্তি এবং শিক্ষার উচ্চহার এই দেশের অন্যতম সম্পদ। তাই এদেশের মানুষের জীবন-জীবিকার মান অত্যন্ত উচ্চ। প্রাকৃতিক গ্যাস এবং তেলের প্রশ্নে রাশিয়ার উপর কিছুটা নির্ভরশীল এই দেশ। এই সমস্ত প্রাকৃতিক শক্তি উপাদান পুনরায় রপ্তানি করে বেলারুশ-এর খাতায় যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা জমা হয় তা জিডিপির ১০ শতাংশ।
বেলারুশ-এর কৃষিজ ও এবং শিল্পজাত পণ্য মূলত রপ্তানি করা হয় তার প্রতিবেশী দেশ রাশিয়াতে ২০১২ সালের হিসেব অনুযায়ী বেলারুশের বৈদেশিক বাণিজ্যের ৪৫ শতাংশ রাশিয়ার সঙ্গে। পিট হলো এই দেশের সবচেয়ে দামি খনিজ জ্বালানি ২০১৮ সালের হিসাব অনুযায়ী মানবসম্পদ উন্নয়ন সূচকে রাষ্ট্রসঙ্ঘের ৫৩ তম স্থানে রয়েছে বেলারুশ। কার্যকর স্বাস্থ্যব্যবস্থা, শিশু মৃত্যুর হার মাত্র ২.৯ শতাংশ যা রাশিয়া, ইংল্যান্ডের তুলনায় যথেষ্ট কম। মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে ডলারগত ভাবে পরিমাণ কুড়ি হাজার। দেশের প্রায় ৪০ শতাংশ বনভূমি সমৃদ্ধ। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মিলিটারি সেক্টর বেলারুশের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল ছিল। এমন সমৃদ্ধশালী দেশের মানুষ সে দেশের শাসক সম্পর্কে প্রশ্ন তোলায় আন্তর্জাতিক মহলেও দ্বিধা রয়েছে রাষ্ট্রপতি বিরোধী বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে। প্রশ্ন উঠছে বিদেশি উস্কানি নিয়েও।
নির্বাচনের পর দিন ১০ আগস্ট বেলারুশ পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষে লিপ্ত হয় সরকার বিরোধীরা। (৯ আগস্ট) নির্বাচনে নজিরবিহীন ভোট কারচুপির অভিযোগ এনে রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে প্রতিবাদ জানান তারা। ১৯৯৪ সাল থেকে টানা ক্ষমতায় থাকা প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কোর বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীরা স্লোগান দিলে চড়াও হয় পুলিশ। এসময় কাঁদানে গ্যাস, রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে পুলিশ। রণক্ষেত্রে পরিণত হয় রাজধানী মিনস্ক। সহিংস বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে অন্যান্য শহরেও। কোথাও কোথাও পুলিশের বিরুদ্ধে পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলে বিক্ষোভকারীরা।
আন্দোলনকারীরা বলছেন, পুলিশ নিরীহ মানুষকে গ্রেপ্তার করছে। নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম করা হয়েছে। ৮০ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে নিজের জনগণকে এত ভয় পান কেন তিনি? বেলারুশে কর্মরত বিদেশি সংবাদমাধ্যমের কর্মীরা আক্রান্ত - এমন খবরও উঠে এসেছে। এখন সবার নজর ইয়োরোপীয় ইউনিয়নের দিকে।