E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

মার্কিন-চীন সংঘাত বেড়েই চলেছে

লালন ফকির


বিশ্বব্যাপী করোনা সংক্রমণের ক্রমবর্ধমান পরিস্থিতির মধ্যে মার্কিন-চীন সংঘাত বা প্রকৃত অর্থে চীন বিরোধী মার্কিন কুৎসা বেড়েই চলেছে। সম্প্রতি একটি দিনও যাচ্ছে না যেদিন চীন বিরোধী কুৎসা প্রচার হচ্ছে না। কুৎসাগুলি এতই ভিত্তিহীন যে, সেগুলি মাঝে মাঝে হাস্যকর পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। এই কুৎসাগুলির বিষয়বস্তু বা চরিত্র ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু আসলে লক্ষ্য একই। ডোনাল্ড ট্রাম্প সহ মার্কিন প্রশাসনের বিভিন্নস্তরের কর্তা ব্যক্তিরা এইসব কুৎসা প্রচারের সামনের সারিতে থাকছেন। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহে মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব জন পম্পিও কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত গণতন্ত্র সম্পর্কিত বক্তৃতা করতে গিয়ে বলেছেন, চীন বর্তমানে একটি ‘দুর্বৃত্ত ক্ষেত্রে’ পরিণত হয়েছে এবং ইয়োরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলির উচিত চীনের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে একটি মহাজোট গঠনে উদ্যোগী হওয়া। এই মহাজোট ‘দুর্বৃত্ত ক্ষেত্র’কে ধ্বংস করতে পারবে। মার্কিন বিদেশসচিব যে মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করছিলেন সেই কোপেনহেগেনে ডেমোক্র্যাসি সামিট হল বিশ্বব্যাপী তথাকথিত গণতন্ত্র রক্ষার মঞ্চ, যা প্রধানত দক্ষিণপন্থীদের ঐক্যবদ্ধ করতে ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এর নেতা অ্যান্ডর ফক্স রাস মিউসেন ছিলেন ন্যাটো যুদ্ধ জোটের প্রধান। পম্পিও দম্ভ করে বলেছেন, তিনি যখন সিআইএ-র প্রধান ছিলেন তখন বিভিন্ন দেশের সরকার থেকে গণতন্ত্রপন্থীদের সরকারগুলিকে উৎখাত করে ‘মুক্ত সরকার’গুলি প্রতিষ্ঠা করতে ভূমিকা পালন করেছেন। এবং বর্তমানেও সেই ভূমিকা পালন করে চলেছেন। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে পম্পিও’র এই বক্তব্য ঠান্ডা যুদ্ধমার্কা। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক মহল মনে করে, যে দেশটিতে রাজনৈতিক বন্দীর সংখ্যা বিশ্বে সর্বাধিক, পুলিশি অত্যাচার সর্বাধিক, কৃষ্ণাঙ্গ জনগণ অত্যাচারিত, তারাই কেন গণতন্ত্র ও মুক্ত দুনিয়ার কথা বলে? ঠান্ডা যুদ্ধের সময় সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যে সমস্ত কথাবার্তা যেভাবে বলা হতো এখন চীনের বিরুদ্ধে ঠিক একই কায়দায় একই ভাষায় তা বলা হচ্ছে। করোনা-উত্তর বিশ্ব পরিস্থিতিতে নিজ একাধিপত্য কায়েমের সামনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বড় বাধা হলো চীন। গণতন্ত্র বা মুক্ত দুনিয়া বিষয়ে চীনবিরোধী কুৎসার সঙ্গে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে আর একটি উপাদান। তাহলো কোভিড ১৯-কে কেন্দ্র করে চীনবিরোধী প্রচার। এই মিথ্যাচারের মূল প্রতিপাদ্য হলো, মধ্য চীনের উহান প্রদেশে যেহেতু এই ভাইরাস সংক্রমণের সূত্রপাত ঘটে, তাই অতিমারীর ভাইরাস চীনেই তৈরি করা হয়েছে এবং বিশ্বে ছড়ানো হয়েছে। বলাবাহুল্য বিশ্ব স্বাস্হ্য সংস্থা বা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা তথ্যপ্রমাণ সহ এর বিরোধিতা করেছে। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে এর প্রচারে কিছুটা রাশটানা হলেও এই অপপ্রচার এখনও বন্ধ হয়নি। প্রথমদিকে চীনের পক্ষ থেকে এই অপপ্রচারের বিরুদ্ধে তেমনভাবে সোচ্চার না হলেও পরবর্তীকালে চীনের পক্ষ থেকে একে ভিত্তিহীন বলে প্রচার করা হয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চীনবিরোধী কুৎসা প্রচার সম্প্রতি এক নতুন মাত্রা নিয়েছে। হিউস্টনে অবস্থিত চীনা দূতাবাস মার্কিন বাণিজ্যিক প্রক্রিয়ার ওপর নজরদারি চালাচ্ছে এই অজুহাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেখানকার চীনা দূতাবাস বন্ধ করার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। চীন কড়াভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই একতরফা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। চীন মনে করে এর ফলে উভয় দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

এইরকম পরিস্থিতিতে মার্কিন বিদেশসচিব পম্পিও’র একটি মন্তব্য চীনবিরোধী পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করেছে। পম্পিও বলেছেন, দক্ষিণ চীন সাগর সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাবে। ইতিপূর্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ চীন সাগর সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য প্রকাশ করেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক বক্তব্য অতীতের তুলনায় অনেক বেশি আক্রমণাত্মক। এর সাথে সামঞ্জস্য রেখেই এই এলাকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দু’টি এয়ারক্র্যাফ্ট কেরিয়ার নিয়োগ করেছে। এর একটি হলো, ইউএসএস নিমৎজ এবং অপরটি হলো ইউএসএস রোনাল্ড রেগান। এর প্রতিবাদ করে চীন এই অঞ্চলে একাধিক রণতরী মোতায়েন করেছে। এছাড়াও বিশ্ব বাণিজ্য দুনিয়ায় চীনের আধিপত্য খর্ব করতে মার্কিন প্রশাসন তার স্যাঙাৎদের নিয়ে প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক সামরিক দিক থেকে চীনের প্রভাব হ্রাস করতে এবং বিশ্ব বাণিজ্যে মার্কিন আধিপত্য কায়েম করতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই চেষ্টা। বিশেষত, মধ্যপ্রাচ্য, আরব দুনিয়া, আফ্রিকা মহাদেশ এবং লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান চীনা প্রভাব বৃদ্ধিতে মার্কিন প্রশাসন উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে।

লাইন অফ অ্যাকশন এলাকাতে ভারত-চীনের সীমান্ত সংঘর্ষের পরবর্তীকালে নরেন্দ্র মোদীর ভারতের সঙ্গে এই অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ সহযোগী জাপান এবং অস্ট্রেলিয়ার গভীর ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। ভারতের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এমন সামরিক চুক্তি করেছে যা তারা সাধারণভাবে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলির সাথে করে থাকে। ২০১৪ সালে উভয় দেশের মধ্যে আরও একটি চুক্তি হয়। এটি ‘জয়েন্ট স্ট্র্যাটেজিক ভিশন ফর দি এশিয়া প্যাসিফিক অ্যান্ড দ্য ইন্ডিয়ান ওশান রিজিয়ন’ বলে পরিচিত। সম্প্রতি ভারত-মার্কিন দ্বিপাক্ষিক পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে ‘লজিস্টিক এক্সচেঞ্জ মেমোরান্ডাম অফ এগ্রিমেন্ট’। এর সাহায্যে মার্কিন নৌবাহিনী ভারতীয় নৌঘাঁটি ব্যবহার করতে পারবে। ২০১৬ সালে মার্কিন প্রশাসন প্রধান ভারতকে প্রতিরক্ষা সহযোগীর মর্যাদা দিয়েছে।

বর্তমান অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ যখন প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের দায়িত্বে ছিলেন তিনি উভয় দেশের মধ্যে সম্পাদিত সামরিক চুক্তিগুলির উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। স্টকহোমে অবস্থিত ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (আইপিআরআই)-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, মোদী সরকার কেন্দ্রে আসীন হওয়ার পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে অস্ত্র আমদানির পরিমাণ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এক তথ্যে দেখা যাচ্ছে, শেষ ছয় বছরে ২,০০০ কোটি ডলার মূল্যের অস্ত্র ভারত ক্রয় করেছে। মার্কিন বিদেশ সচিব পম্পিও বলেছেন, ভারতের নিরাপত্তা সম্পর্কিত বিষয়ে বর্তমানের মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অতীতে কখনও এতো সচেতন ছিল না।

কিন্তু আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, এই অঞ্চলের দেশগুলির মধ্যে ভারত এবং ভুটান ব্যতীত অন্য সকল দেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক উন্নত রয়েছে। কিছুদিন আগে পর্যন্ত নেপালের সাথে চীনের সুসম্পর্ক ছিল না। কিন্তু গত দশকে এই সম্পর্কের পরিবর্তন ঘটেছে এবং চীন ও নেপাল অনেক কাছাকাছি এসেছে মোদী সরকারের কিছু ভ্রান্ত পদক্ষেপের জন্য। ভুটান ও চীনের মধ্যে ডকলামকে কেন্দ্র করে আগে বিরোধ থাকলেও বিভিন্ন ইস্যুতে এমনকি পররাষ্ট্র নীতির প্রশ্নে ভুটান ও চীন কাছাকাছি এসেছে। চীনের সাথে ভুটানের কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকলেও সম্প্রতি বিপুল সংখ্যক চীনা পর্যটক ভুটানে আসছেন এবং এরফলে ভুটানের বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার স্ফীত হচ্ছে। ভুটান চীনের সাথে সীমানা বিরোধের সমাধান করেছে। শ্রীলঙ্কার সাথে চীনের কূটনৈতিক সম্পর্কের উন্নতি ঘটেছে। সম্প্রতি শ্রীলঙ্কার হামবানতোলায় চীনের উদ্যোগে একটি গভীর বন্দর নির্মাণের কাজ চলছে। একই ধরনের বন্দর পাকিস্তান এবং মায়ানমারেও তৈরি হচ্ছে। এইসব বন্দর চীনের ‘বোল্ড অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ প্রকল্পের অধীন। মায়ানমারে নির্মিত বন্দরটির সাহায্যে চীন পশ্চিম এশিয়া থেকে মালাক্কা প্রণালীকে পাশ কাটিয়ে বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করতে পারবে। ইরানীয় সরকার দানবীয় মার্কিন অর্থনৈতিক অবরোধকে অস্বীকার করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প রূপায়ণ করে চলেছে। সম্প্রতি ইরান ঘোষণা করেছে যে, একটি রেল প্রকল্প, ভারতের সহযোগিতায় যা সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত ছিল, তা ইরান নিজস্ব উদ্যোগেই সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বর্তমানে ভারতের সাহায্য ছাড়াই এই দীর্ঘ রেলপথ ছারহার থেকে বাহেদান পর্যন্ত সমাপ্ত হবে। এই রেল প্রকল্পটি আফগান সীমান্তে অবস্থিত ঝারনাজ পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। ইরান সরকার সম্প্রতি ঘোষণা করেছে, ৪০ কোটি ডলার মূল্যের একটি প্রকল্প আগামী দু-বছরের মধ্যে সমাপ্ত হবে। এই ঘোষণার পরই সংবাদে প্রকাশিত হয়েছে যে, চীন ও ইরান উভয় দেশের মধ্যে ৪০ হাজার কোটি ডলার মূল্যের আরেকটি বিশাল প্রকল্পের উদ্বোধন হতে চলেছে। এই প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে পরিকাঠামোগত ক্ষেত্রে বিনিয়োগ, ম্যানুফ্যাকচারিং, পরিবহণ প্রভৃতি ক্ষেত্র। এই প্রেক্ষাপটে বলা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন কোনো দেশের সঙ্গে কোনো চুক্তি করে তখন তার চরিত্র সহযোগিতামূলক বা গঠনমূলক হয় না, হয় আধিপত্যমূলক। চীনের ক্ষেত্রে ঘটে ঠিক এর উল্টো। এর মধ্যে দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের চরিত্রগত পার্থক্য প্রমাণিত হচ্ছে।