E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

ভারত-পাক সম্পর্কের উন্নতির পথে প্রধান বাধা সীমান্তপারের সন্ত্রাসবাদ

লালন ফকির


অনিবার্য নানা কারণে প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তানের অর্থনীতি সংকটগ্রস্ত। ভারতীয় অর্থনীতিরও একই হাল। বিশ্ব অর্থনীতির মন্দা অবস্থা থেকে কেউই রেহাই পাচ্ছে না। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা এই সংকটে যুক্ত করতে চলেছে নতুন মাত্রা। আন্তঃরাষ্ট্রীয় সংস্থা ফিনান্সিয়াল অ্যাকশান টাস্ক ফোর্সের ( এফএটিএফ) এটি জি ৭ গোষ্ঠীর উদ্যোগে ১৯৮৯ সালে আত্মপ্রকাশ করে মূলত আন্তর্জাতিকস্তরে আর্থিক কেলেঙ্কারিগুলির ওপর নজরদারির লক্ষ্যে। এর সূত্র ধরেই ২০০১ সাল থেকে এই সংস্থা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলি বিভিন্ন রাষ্ট্র থেকে যে নানা ধরনের আর্থিক মদত পেয়ে থাকে, তা খতিয়ে দেখে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রকে কালো তালিকা ও ধূসর তালিকাভুক্ত করে অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা জারির সুপারিশ করে থাকে। ধূসর তালিকাভুক্ত সেই দেশগুলিকে করা হয় সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে যুদ্ধে যাদের ঘাটতি আছে এবং এফএটিএফ-এর বর্ধিত নজরদারির আওতায় থাকা অবস্থায় যারা ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে দায়বদ্ধ। কালো তালিকায় তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয় যারা সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে যুদ্ধে সরাসরি অসহযোগিতা করছে বলে মনে করা হয়।সম্প্রতি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী সংগঠনকে মদত দেবার যে অভিযোগ করেছে ভারত সরকার, তা পর্যালোচনার পর এফএটিএফ পাকিস্তানকে এই প্রশ্নে ধূসর তালিকা থেকে কালো তালিকাভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে।

পাকিস্তানে বিগত কয়েক মাস ধরে গণতন্ত্র সহ বিভিন্ন দাবিতে ব্যাপক গণআন্দোলন গড়ে উঠেছে। এইসব আন্দোলন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের পদত্যাগের দাবিতে সরব হয়েছে। একইসঙ্গে সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধেও জনগণ সোচ্চার হয়েছে। ঠিক এরকম সময়েই এফএটিএফ-এর সিদ্ধান্ত পাকিস্তানকে বিপদের মুখে ফেলে দিয়েছে সন্দেহ নেই।

এফএটিএফ-এর ২২ অক্টোবর অনুষ্ঠিত পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে ধূসর তালিকাতেই পাকিস্তানের নাম রেখে দেওয়ার যুক্তিকে খারিজ করেছে ভারত সরকার।পাকিস্তান চায় তাদের নাম ধূসর তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হোক, অর্থাৎ তাদের বর্ধিত নজরদারির বাইরে রাখা হোক। ভারত দাবি করেছে পাকিস্তানকে ধূসর তালিকা থেকে কালো তালিকার অন্তর্ভুক্ত করা হোক।সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসে পাকিস্তানের যোগাযোগের বহু প্রমাণ ভারত সরকার হাজির করেছে। যেমন, কুখ্যাত মাসুদ আজহার, জাকিউর রেহমান লাখভি, দাউদ ইব্রাহিম প্রভৃতি সন্ত্রাসীদের কোনো শাস্তি পাকিস্তান সরকার দেয়নি।

পাকিস্তান অবশ্য সন্ত্রাসবাদীদের শাস্তিদানের বিষয়টি অস্বীকার করে কিছু তথ্য হাজির করেছে। কিন্তু এগুলির বেশিরভাগই ধোপে টেঁকেনি। এফএটিএফ-এর পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে একমাত্র সিরিয়া পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। চীন এবং মালয়েশিয়া পাকিস্তানের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকলেও ধূসর তালিকা থেকে পাকিস্তানকে মুক্ত করার দাবিকে তারা সমর্থন করেনি। ভারতের বিদেশমন্ত্রকের প্রতিনিধিদলের পক্ষে বলা হয়েছেঃ ‘‘পাকিস্তান যাই বলুক না কেন তারা এখনও সীমানা অতিক্রম করে সন্ত্রাসীদের মদত দিয়ে চলেছে।’’ এফএটিএফ-এর সভাপতি মার্কাস প্লেয়ার অধিবেশন শেষে সাংবাদিক বৈঠকে বলেছেনঃ ‘‘পাক সরকার তাদের বিরুদ্ধে আনা বিভিন্ন অভিযোগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছে ঠিকই, কিন্তু এখনও বেশকিছু শর্ত পূরণ করেনি। পাকিস্তানকে ধূসর তালিকাভুক্ত করার সময়ে ২৭টি শর্ত নির্দিষ্ট করা হয়েছিল, এরমধ্যে ছ’টি বিষয়ে এখনও কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।’’ রাজনৈতিক মহলের মতে পাকিস্তান যদি এখন এফএটিএফ’র শর্তগুলি পূরণ করে, তাহলে তাদের ধূসর তালিকার বাইরে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। তবে তিনি হুঁশিয়ারির সুরে বলেছেন, পাকিস্তানের ক্রিয়াকলাপ নিয়ে এশিয়া-প্যাসিফিক গ্রুপ অন মানি লন্ডারিং সংস্থাটিও তদন্ত করছে। তারা তালিকাভুক্ত করলে এফএটিএফ সেটিকে মান্যতা দেবে। ২০১৮ সাল থেকে পাকিস্তান ধূসর তালিকাভুক্ত রয়েছে। সেখানকার সরকার যদি সন্ত্রাসবাদকে মদত দেওয়া বন্ধ না করে তাহলে তাদের কালো তালিকাভুক্ত হতে হবে। উত্তর কোরিয়া ও ইরান বর্তমানে কালো তালিকাভুক্ত রয়েছে।

পাকিস্তানের সন্ত্রাসবিরোধী আদালত গত নভেম্বরে হাফিজ সৈয়দকে পাঁচ বছরের জন্য কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে। হাফিজ সৈয়দ হলেন সন্ত্রাসবাদী সংগঠন জামাত-উদ্-দোয়ার প্রধান। ২০০৮ সালে মুম্বাইয়ে সন্ত্রাসবাদী হামলায় তিনি যুক্ত ছিলেন। মুম্বাই হামলায় আর্থিক সহায়তা প্রদানের অভিযোগে ২০১৯ সালে লাহোরে সন্ত্রাসবিরোধী আদালতে তার বিচার হয়। হাফিজ লস্কর-ই-তৈবারও প্রধান ছিলেন। এই শাস্তি প্রদানের তথ্যকে পাক সরকার এফএটিএফ’র শর্তপূরণেরই অংশ হিসাবে হাজির করে। হাফিজের আগেও তাকে মুম্বাই কাণ্ডে জড়িত থাকার অপরাধে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণ পাক সরকারের কাছে হাজির করা হলেও তাতে কর্ণপাত করা হয়নি। ভারত সরকার বারবার অভিযোগ করেছে, লস্কর-ই-তৈবা সন্ত্রাসবাদী সংগঠন এবং পাক সেনাবাহিনীর ছত্রছায়ায় থেকে তারা ভারতের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে।

মুম্বাই হামলায় চারজন মার্কিন নাগরিক নিহত হন।এর সঙ্গে যুক্ত হাফিজের গ্রেপ্তারের জন্য মার্কিন প্রশাসন ১ কোটি ডলার পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। লস্কর-ই-তৈবার নেতা হাফিজ গ্রেপ্তার হওয়ার আগের দিনই পাক সরকার ভারতের বিরুদ্ধে তৎপরতা শুরু করে। পাক সরকারের পক্ষ থেকে একটি তথ্যপঞ্জি প্রকাশ করে অভিযোগ করা হয় যে, ভারত সরকার পাকিস্তানের অভ্যন্তরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে রাজনৈতিক অস্থিরতা চালাবার চেষ্টা চালাচ্ছে। এর প্রধান লক্ষ্য চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের মৈত্রীপূর্ণ সম্পর্ককে নষ্ট করা। পাক বিদেশমন্ত্রী শাহ মহম্মদ কুরেশি এবং সামরিক মুখপাত্র মেজর জেনারেল বাবর ইফতিকারের যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনে অভিযোগ করা হয়, পাকিস্তানের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা পরিচালনা করতে ভারতের নিজের ভূখণ্ডকে ব্যবহার করছে এবং পাক-আফগান সীমান্তে গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি করেছে। তিনি চড়া সুরেই বলেছিলেন, পাকিস্তান ভারতের কার্যকলাপের উপযুক্ত তথ্য প্রমাণ সহ রাষ্ট্রসঙ্ঘের কাছে ভারতের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি করেছে। পাক সামরিকমহলের অভিযোগ, বালুচি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ভারত মদত দিচ্ছে এবং এদের নেতৃত্বে চায়না-পাকিস্তান ইকনমিক করিডোরে সন্ত্রাসবাদী হামলা হয়েছে এবং করাচি শেয়ারবাজারে বিস্ফোরণও এরই কাজ।

পাকিস্তানের অভ্যন্তরে তৎপর বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী সংগঠন যেমন, তোরাক-ই-তালিবান-পাকিস্তান (টিটিপি), জামায়েত-উল- অহর এবং বালুচ লিবারেশন আর্মিকে ভারত মদত দিয়ে চলেছে বলে পাক সরকার ও সামরিক বাহিনী অভিযোগ করেছে। পাকিস্তানে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে সহায়তা দিতে ভারত নিজের ভূখণ্ডে ২১টি এবং আফগান ভূখণ্ডে ৬৬টি প্রশিক্ষণ শিবির নির্মাণ করেছে।আফগান সরকারের পক্ষ থেকে এতে তীব্র প্রতিবাদ করা হয়েছে। ভারত সরকারের পক্ষ থেকেও একে চরম মিথ্যাচার বলা হয়। আন্তর্জাতিক মহলেও পাকিস্তান এবিষয়ে কোনো সমর্থন পায়নি। ২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত নির্জোট সম্মেলনে উভয় দেশই সন্ত্রাসবাদ দমনে যৌথ উদ্যোগ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু বিগত চার পাঁচ বছর ধরে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে অগ্রগতি কিছু হয়নি। সীমানা অতিক্রম করে সন্ত্রাসবাদ দমনে উভয় দেশের মধ্যে কোনো দ্বিপাক্ষিক আলোচনা হয়নি। এমনকি উভয় দেশের মধ্যে পারস্পরিক আলোচনাও বন্ধ। বিশেষ করে নরেন্দ্র মোদী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ছ’বছরে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে ভারতের নিরাপত্তা বাহিনী দাবি করে জম্মু কাশ্মীর সীমান্তে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন জয়েশ-ই-মহম্মদের তৎপরতাকে বানচাল করে দেওয়া হয়েছে। এইখানে চারজন জঙ্গি নিহত হয়। নরেন্দ্র মোদী ঘোষণা করেন, জম্মু কাশ্মীরে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে ভারত সরকার সক্রিয়, সেই কারণেই এই জঙ্গি তৎপরতাকে বন্ধ করা হয়েছে। ভারতের বিদেশমন্ত্রকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পুলওয়ামাতে জয়েশ-ই-মহম্মদ হামলা চালায়।ভারতের বক্তব্য হলো, হামলার পরিকল্পনার পিছনে ছিল পাক সামরিক বাহিনী। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলিকে সমস্ত দিক থেকে মদত দান ও সীমানাপেরিয়ে সন্ত্রাসবাদ বন্ধ করার যে প্রতিশ্রুতি পাকিস্তান দিয়েছিল তা কার্যকর করতে কোনো উদ্যোগ তারা নেয়নি।

চীন সহ আন্তর্জাতিক মহলের বিভিন্ন অংশের পক্ষ থেকে শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতিতে উভয় দেশের মধ্যে পারস্পরিক আলাপ আলোচনার মধ্য দিয়ে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। বর্তমানে দুই দেশের শীর্ষ ক্ষমতায় যারা রয়েছে তাদের মনোভাব অত্যন্ত নেতিবাচক। একথা সত্যি, পাকিস্তানের ক্ষমতার কেন্দ্রে রয়েছে তিনটি শক্তি। ১) ইমরান খানের নেতৃত্বে একটি সরকার; ২) দেশের সামরিক বাহিনী, যারা পাকিস্তান আত্মপ্রকাশের পর বেশিরভাগ সময়েই ক্ষমতায় ছিল; ৩) বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী জঙ্গি সংগঠন যাদের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর যোগাযোগ রয়েছে। এরা নিজেদের স্বার্থেই উভয় দেশের পারস্পরিক সম্পর্ককে বিচার করে। অন্যদিকে ভারতে কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় রয়েছে ভারতীয় জনতা পার্টি যারা আরএসএস দ্বারা পরিচালিত। এদের মুসলিম ও পাকিস্তান বিদ্বেষ সর্বজনবিদিত। এই পরিপ্রেক্ষিতে উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য উভয় দেশের গণতান্ত্রিক শক্তিকে নিজ নিজ দেশের শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে গণসংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে।