E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

বাংলাদেশের ঘটনাঃ প্রেক্ষাপট ও অভিঘাত

বিশ্বম্ভর মণ্ডল


ঢাকার শাহবাগে সাম্প্রদায়িক হিংসার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিল।
ছবিঃ অনিন্দ্য আরিফ

বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর দেশবাসীর উদ্দেশে একটি বক্তৃতা দিতে গিয়ে সংখ্যালঘুদের উদ্দেশে বলেছেনঃ ‘‘নিজেদের সংখ্যালঘু বলে ভাববেন না। বাংলাদেশের মাটিতে জন্ম নেওয়া সমস্ত সন্তানের ধর্মীয় স্বাধীনতা রয়েছে।” একসময় তাঁর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেনঃ ‘‘এই দেশ হিন্দুদের না, এই দেশ মুসলমানের না। এই দেশকে যে নিজের বলে ভাববে এই দেশ তার। এই দেশের কল্যাণ দেখে যার মন খুশিতে ভরে উঠবে এই দেশ তার। এই দেশের দুঃখে যে কাঁদবে এই দেশ তার। এবং এই দেশ তাদের যারা এদেশের স্বাধীনতার জন্য সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছে এবং ভবিষ্যতে দিবে।”

মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে এখন সম্মুখসমর শুরু করার সময় এবং সেটা শুরুও হয়েছে। সাম্প্রদায়িক শক্তি, মৌলবাদী শক্তি বিপন্ন বোধ করেছে মুজিবুরের প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়পর্বে। মুজিবুরের জন্ম শতবর্ষ উদযাপনকে কেন্দ্র করে ওদেশে মৌলবাদবিরোধী শক্তিগুলো নিজেদের দুর্বলতাগুলোকে কাটিয়ে নিজেদের অনেকটাই সংহত করে তোলার চেষ্টা করছে। এটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে উঠতে শুরু করতেই মৌলবাদী শক্তিও বসে নেই, তারাও নিজেদের সংহত করে তোলার নিরন্তর প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। সেই পরিকল্পিত ও সংঘটিত প্রয়াসের বহিঃপ্রকাশ হলো পুজো মণ্ডপকে কেন্দ্র করে সংঘটিত হিংসাত্মক ঘটনা।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শরিক ছিলেন যাঁরা তাঁদের সামনে এগিয়ে এসে মুজিবের স্বপ্ন, মুজিবের ভাবনাকে সাধারণ মানুষের কাছে আরও একবার নিয়ে যেতেই হবে। মানুষকে মনে করিয়ে দিতে হবে, মুজিবের সেই কথাগুলো, যেখানে তিনি বলছেনঃ ‘‘First I am a human being, then a Bengali and after that a Muslim’’। দৈনন্দিন জীবনের বিশ্বাসে, নিশ্বাসে-প্রশ্বাসে জড়িয়ে নিতে হবে ধর্ম নিয়ে মুজিবের সেই অমোঘ বক্তব্যকে - “religion is an absolutely private affair which should have no place in either ideology or the practice of politics.’’। ধর্ম এবং জাতীয়তাবাদের মধ্যে কোনরকম সম্ভাব্য সমঝোতাকে তিনি নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন।

গত এক দশক ধরে শেখ হাসিনা তাঁর বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে মৌলবাদীদের এবং ধর্মের ব্যবসায়ীদের একপ্রকার কোণঠাসা করে দিয়েছেন। মুজিবের শতবর্ষ উপলক্ষে শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছেন, তিনি তাঁর দেশের প্রতিটি মানুষের মাথায় ছাদের ব্যবস্থা করবেন এবং একজনকেও না খেয়ে যাতে রাতে ঘুমাতে যেতে না হয় তার ব্যবস্থা করবেন। বাংলাদেশে এখন “মুজিব বর্ষ” উদযাপন চলছে। বাংলাদেশকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অনেকটাই উন্নতির পথে তিনি এগিয়ে নিয়ে গেছেন। তাঁর নেতৃত্বে আজকে বাংলাদেশ “মধ্য আয়ের দেশ” হিসেবে নিজের অবস্থান উন্নীত করেছে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হয়ে উঠেছে। এমনকী মাথাপিছু জিডিপি’র হিসেবে ২০২০ সালে ভারতকে অতিক্রম করেছে। এছাড়াও ইউনাইটেড নেশনস-এর তৈরি করা “অনুন্নত দেশ”র তালিকা থেকে নিজেদের বাদ করে নিতে পেরেছে।

এবার একটু প্রসঙ্গান্তরে যাই। “মসজিদ ভাঙে ধার্মিকেরা, মন্দিরও ভাঙে ধার্মিকেরা। তারপরও তারা দাবি করে তারা ধার্মিক। আর যারা ভাঙাভাঙিতে নেই, তারা অধার্মিক বা নাস্তিক” - আজ বড়ো বেশি প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে হুমায়ুন আজাদের এই কথাগুলো। শেখ মুজিব ছিলেন উদার, অসাম্প্রদায়িক আর তাঁর মধ্যে ছিল মুক্তিযুদ্ধের আলোকিত চেতনা। মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে যারা ছিল তাদের সমর্থকদের বিপজ্জনক গোষ্ঠীগুলোকে যে আজও নিশ্চিহ্ন করা যায়নি তা বোঝা যায় বিশেষ বিশেষ সময়ে। ধর্মীয় মৌলবাদীদের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে তাদের উদ্যোগে বাংলাদেশে এই ধরনের ঘটনা মাঝে মাঝে মাথা চাড়া দেয়। দেশজুড়ে নানা অশান্তির বাতাবরণ তৈরির ধারাবাহিক ও আন্তরিক প্রয়াস তাদেরই উদ্যোগে ঘটে যাদের মনটা আজও পাকিস্তানে পড়ে আছে অথবা যারা প্রতিবেশী দেশগুলোর মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক শক্তির দোসর হিসাবে ওই দেশে কাজ করে থাকে।

এদের বিরুদ্ধে লড়াইটা হলো ধারাবাহিক। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সামান্য শৈথিল্য দেখানো হলে সাম্প্রদায়িক শক্তি তার সুযোগ নেবেই। নতুন নতুন বন্ধু খুঁজে সে নিজেকে আরও শক্তিশালী ভূমিকায় নিয়ে যাবার চেষ্টা করবে। যেমন ওই দেশে যারা মুক্তিযুদ্ধে হেরে গেছে তারাই সাম্প্রদায়িক চেহারায় আক্রমণ করে বারবার। সাম্প্রদায়িক ও ধর্মান্ধ রাজনৈতিক শক্তিগুলো নানা গুজব ছড়িয়ে দিয়ে বারে বারে নিত্যনতুন কায়দায় একইরকমভাবে দেশকে অস্থিতিশীল করার ঘটনা ঘটিয়ে যায়।

এটাও ঠিক যে, ওইদেশে প্রধানমন্ত্রী ও প্রশাসন অত্যন্ত তৎপরতার সঙ্গে পরিস্থিতির মোকাবিলা শুরু করেছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেনঃ “ধর্ম যার যার উৎসব সবার। প্রত্যেকে যার যার নিজস্ব ধর্ম স্বাধীনভাবে আনন্দের সঙ্গে পালন করবেন বাংলাদেশে।” আওয়ামি লিগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেনঃ “বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা যখন তাদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা উদযাপন করছেন তখন এদেশের চিহ্নিত সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী সামাজিক মাধ্যমে গুজব মিথ্যা অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে।” বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান যথার্থই বলেছেনঃ ‘‘যারা ধর্মকর্মে বিশ্বাস করেন তারা এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে পারেন না। দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার লক্ষ্যেই এই ঘটনা ঘটানো হয়েছে।”

এই পরিস্থিতিতে কুমিল্লার ঘটনা যেমন বহুল প্রচারিত হচ্ছে, পাশাপাশি সিলেটের ঘটনাটাও কিন্তু বেশি বেশি করে প্রচারের আলোয় আনা দরকার। সিলেটে মৌলবাদীরা যখন একটি মণ্ডপ আক্রমণ করতে এসেছিল হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ একসাথে হাতে হাত ধরে দাঁড়িয়ে প্রতিরোধের ঘটনা ঘটিয়েছে। প্রচারের আলোয় আনা দরকার যে, বাংলাদেশের প্রশাসন আর মুসলিম জনতা সংখ্যালঘুদের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে নানা মণ্ডপে পাহারা বসিয়েছেন। ওই দেশের কমিউনিস্ট, বামপন্থী ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি এই ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই রাস্তায় নেমেছে এবং প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। বামপন্থীরা প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছেন যে, কুমিল্লার ঘটনা কেবল বাংলাদেশের মুসলিম মৌলবাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। এপারের হিন্দুত্ববাদীরা ওই ঘটনাকে নিজেদের হাত শক্ত করার কাজে ব্যবহার করবে।

যারা সত্যজিৎ রায়ের ‘আগন্তুক’ সিনেমা দেখেছেন তারা জানেন উৎপল দত্তের একটি ডায়ালগ। তিনি বলছেনঃ “যে জিনিস মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে আমি তাকে মানিনা। রিলিজিয়ান এটা করেই, আর অর্গানাইজড রিলিজিয়ান তো বটেই।’’ সব দেশেই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তাঁরাই বরাবর সোচ্চার হয়েছেন, যাঁরা শ্রেণিগত, লিঙ্গগত এবং আঞ্চলিক বৈষম্য নিয়ে বরাবর বারবার সক্রিয় থাকেন। বাংলাদেশে আপনি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কথা বলতে যান, তখন আপনাকে ওখানকার সাম্প্রদায়িক শক্তি বলবে - “আপনি শুধু এই দেশে মুসলমানদের নির্যাতন দেখেন। ও দেশে হিন্দুরা নির্যাতন করছে সেটা দেখেন না কেন?” আবার এ দেশেও যাঁরা সত্যটাকে তুলে ধরবার চেষ্টা করেন তাঁদেরকেও সাম্প্রদায়িক শক্তি একই কথা বলেন - “এরা এদেশে শুধু মুসলিমদের নির্যাতন দেখে ওপারে যে হিন্দুরা নির্যাতিত হচ্ছে তা এদের চোখে পড়ে না।” তারা এও বলেন, “হিন্দুরা হিন্দুদের স্বার্থের কথা না ভাবলে কে ভাববে।” পাশাপশি, দুই দেশেই সংখ্যাগুরু ধর্মের মধ্যে কিছু মানুষ আছেন যাঁরা হিংস্র উন্মাদনা তৈরিকারী জমি-সম্পদ দখল ও লুঠকারীদের বিরুদ্ধে বলেন ও প্রায়শই তাঁরাও আক্রমণের শিকার হন। পরিশেষে একটা কথা না বললেই নয়, বাংলাদেশে যারা ইসলামের নামে মন্দির বা হিন্দু বাড়িতে হামলা করছে তারা প্রকারান্তরে প্রতিবেশী দেশের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকেও সাহায্য করছে। কায়দা করে একইসাথে প্রতিবেশী দেশের সংখ্যালঘু মুসলমানদের মধ্যেও নিরাপত্তার অভাব বোধ তৈরি করা হচ্ছে। সচেতন মানুষ মাত্রই জানেন যে, ওপারের মুসলিম সাম্প্রদায়িকতাবাদকে ব্যবহার করে এপারের হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি যে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চায় তার সম্ভাবনাও প্রবল।