আফগানিস্তানে তালিবান শাসন ও কাশ্মীর সমস্যা
লালন ফকির
আফগানিস্তানে তালিবান শাসন প্রতিষ্ঠার তিনমাস অতিক্রান্ত। ইতিমধ্যে এর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়ে আন্তর্জাতিক আঙিনায় ব্যাপক অালোচনা শুরু হয়েছে। বিশেষত তিন দশক পূর্বে তালিবানদের আফগানিস্তান শাসন পর্ব অনেকেরই স্মরণে রয়েছে। অবশ্য আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক মহলের একাংশের ধারনা যে, অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে তালিবানের বর্তমান নেতৃত্ব নিজেদের সংশোধন করছে বা করবে। বিশেষত এই মহলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে নারীদের সম্পর্কে নাকি তাদের অতীতের দৃষ্টিভঙ্গির তারা পরিবর্তন করে চলেছে। কিন্তু রাজনৈতিক মহলের বিভিন্ন অংশের ধারণা এ হলো তাদের কৌশল।
আন্তর্জাতিক মহলের এই আলোচনার বৃত্তের মধ্যে ভারত সহ এই উপমহাদেশও রয়েছে। আফগানিস্তানকে কেন্দ্র করে ভারতের অনেকগুলি স্বার্থের প্রসঙ্গ আলোচিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে যেমন রয়েছে অর্থনৈতিক বাণিজ্যিক স্বার্থ, তেমনই রয়েছে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমস্যা। অর্থনৈতিক সমস্যার ক্ষেত্রে আলোচনায় বিশেষভাবে স্থান পেয়েছে আফগানিস্তানে নির্মিত বা নির্মীয়মাণ বিভিন্ন প্রকল্পের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে। বিগত কয়েক বছরে আফগানিস্তানে ভারত সরকারের প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক সহায়তা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এইসব প্রকল্পের মধ্যে ছিল বৃহৎ জলাধার নির্মাণ, নৌবন্দর, বিমানবন্দর নির্মাণ, দ্রুত গতিসম্পন্ন জাতীয় সড়ক নির্মাণ, জল সরবরাহ ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণ প্রভৃতি। এই ধরনের চার শতাধিক প্রকল্প রয়েছে যার জন্য ২০/২২ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে, তা তালিবান শাসন আফগানিস্তানে কায়েম হওয়ার পর এইসব প্রকল্পের সামনে নানান দিক থেকে প্রশ্নচিহ্ন দেখা দিচ্ছে।
কিন্তু আফগাস্তিানে তালিবান শাসন প্রতিষ্ঠার পর ভারতে সাধারণভাবে সাম্প্রদায়িকতার সমস্যা বিশেষত কাশ্মীর সমস্যা নানান দিক থেকেই জটিল হয়ে উঠতে পারে বলে দেশি-বিদেশি গবেষকদের ধারণা। এর অনেকগুলি কারণ রয়েছে। প্রথমত, কাশ্মীরের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি বেশ জটিল। ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট সংবিধানের ৩৭০ ধারা এবং ৩৫ক ধারা বাতিলের মধ্য দিয়ে কথা বলার স্বাধিকার কেড়ে নিয়েছে নরেন্দ্র মোদি সরকার। তাছাড়া জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যকে ভেঙে জম্মু-কাশ্মীর এবং লাদাখ এই তিন অঞ্চলে বিভক্ত করে তাদের কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে পরিণত করা হয়েছে। এখানে নির্বাচন প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে এই তিন অঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবোধ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৯ সালের আগস্ট মাসের পর থেকে বিভিন্ন ধরনের কালা সার্কুলার জারি করা, পাসপোর্ট মঞ্জুর না করা, সন্ত্রাসবিরোধী আইনের প্রয়োগ, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ প্রভৃতির মধ্য দিয়ে জনগণের মৌলিক অধিকারগুলি আক্রান্ত হয়ে পড়েছে।
ইতিমধ্যে জম্মু কাশ্মীরের অভ্যন্তরে সাধারণ মানুষ এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে। ২৪ আগস্ট পিপলস্ অ্যালায়েন্স ফর গুপকার ডিসকারেশন (পিএজিডি)-এর পক্ষ থেকে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, অবিলম্বে ৪ আগস্ট ২০১৯-এর সাংবিধানিক পরিস্থিতি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। জম্মু-কাশ্মীর এবং লাদাখের পুরনো অবস্থান ফিরিয়ে আনতে হবে।
কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদি সরকারের এহেন কাশ্মীর বিরোধী কার্যকলাপের পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করছে কাশ্মীরের সন্ত্রাসবাদী সংগঠন এবং আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলি। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের উপর জঙ্গি হামলা শুরু হয়েছে। সংবাদে প্রকাশ ৭ অক্টোবর শ্রীনগরে একটি সরকারি বিদ্যালয়ে প্রিন্সিপালের ঘরে ঢুকে সংখ্যালঘু শিক্ষক-শিক্ষিকাকে আলাদা স্থানে সরিয়ে তারপর গুলি করে প্রিন্সিপাল ও এক সহকারীকে জঙ্গিরা হত্যা করেছে। এই ঘটনার ঠিক দু’দিন পূর্বে শ্রীনগরে জঙ্গিরা দুই ব্যবসায়ীকে খুন করে। ‘দ্য রেজিন্টান্স ফ্রন্ট’ নামক একটি সংগঠন এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে। আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করাই এই হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য বলে কাশ্মীর প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হচ্ছে। চলতি বছরে এ পর্যন্ত ২৮ জন নিরীহ নাগরিক খুন হয়েছেন। গত পাঁচদিনে নিহত হয়েছেন ৭ জন।
এই ঘটনার কয়েকদিন পর ১১ অক্টোবর জম্মুতে একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসবাদীর সাথে সংঘর্ষে পাঁচজন জওয়ান নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে একজন সেনা আধিকারিকও আছেন। ১১ অক্টোবর ভোরে জম্মু ও কাশ্মীরের পৃষ্ঠ জেলার সুরানকোট অঞ্চলে গভীর জঙ্গলের মধ্যে অভিযান চালানোর সময় সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে জওয়ানদের সংঘর্ষ ঘটে। গত জুন মাস থেকেই জম্মু-কাশ্মীরে একের পর এক সন্ত্রাসবাদীদের অনুপ্রবেশের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে, বিশেষ করে জম্মু অঞ্চলের রাজৌরির পুঞ্চ জেলার নিয়ন্ত্রণরেখা অতিক্রম করে সন্ত্রাসবাদীদের অনুপ্রবেশের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিগত জুন মাস থেকে অনুপ্রবেশ করতে গিয়ে নয়জন সন্ত্রাসবাদী নিহত হয়েছে।
এই সব ঘটনাকে সামনে রেখে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন জম্মু-কাশ্মীর সম্পর্কে নরেন্দ্র মোদি সরকারের দমননীতি এবং আফগানিস্তানে তালিবান শাসন প্রতিষ্ঠা এই দুইয়ের মিশ্রণে জম্মু-কাশ্মীর সন্ত্রাসবাদীদের মৃগয়াক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। এই অবস্থা আগামী দিনে আরও ভয়াবহ হয়ে উঠবে বলে দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক মহলের ধারণা। বিশেষত, পাকিস্তান তালিবান শাসিত আফগানিস্তানের প্রতিরক্ষা নীতি এবং বৈদেশিক নীতির নিয়ামক শক্তির ভূমিকায় রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে গত ৪ সেপ্টেম্বর পাক গোয়েন্দা সংস্থা এন্টার সার্ভিসেস ইনটেলিজেন্সের প্রধান জেনারেল ফয়েজ আহমেদের কাবুল সফর। তিনিই প্রথম একজন বরিষ্ঠ সরকারি আধিকারিক যিনি আফগানিস্তানে তালিবান শাসন প্রতিষ্ঠার পর কাবুল সফর করলেন। পেন্টাগনের প্রাক্তন সামরিক অধিকর্তা মাইকেল রাজিনের মতে আহমেদের এই ঝটিকা সফর ছিল মুল্লাহ বারাডার এবং হাক্কানি সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের নিরসন ঘটাতে।
আফগানিস্তানের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী সম্পর্কে ভারতের অবস্থান অনেকটা ‘দেখো এবং অপেক্ষা করো’-এর ন্যায়। ভারত সরকার একদিকে যেমন তালিবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি, তেমনি অন্যদিকে আফগানিস্তানে তালিবান বিরোধী বিভিন্ন গোষ্ঠীকেও সমর্থন জানায়নি। জাবিবুল্লাহ মুজাহিদ যিনি তালিবানদের মুখপাত্র হিসাবে পরিচিত, তিনি এ আর ওয়াই নামক এক পাক সংবাদ সংস্থাকে বলেছেন, কাশ্মীর সম্পর্কে ভারতের এক গঠনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা দরকার। তাঁর মতে পরমাণু শক্তিধর উভয় রাষ্ট্র ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যেকার বিরোধগুলি নিষ্পত্তির জন্য পারস্পরিক আলোচনায় বসা উচিত। তবে উভয় দেশই প্রতিবেশী রাষ্ট্র এবং উভয়েরই রয়েছে অভিন্ন স্বার্থ। তিনি এই সংবাদপত্রকে আরও বলেছেন যে, তালিবানরা যদি এই অঞ্চলে পাকিস্তানের হয়ে ‘প্রক্সি যুদ্ধে’ অংশগ্রহণ করে, তাহলে তার প্রতিক্রিয়া এই অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করবে।
তালিবান মুখপাত্র পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের পারস্পরিক সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক যোগসূত্র সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন যে, তালিবানরা পাকিস্তানকে ‘দ্বিতীয় হোমল্যান্ড’ বলে মনে করে। উভয় দেশের মধ্যে সীমানা রয়েছে। উভয় দেশের ধর্ম একই।
তালিবান নেতার এই মন্তব্যের পরই অপর এক শীর্ষ তালিবান নেতা সুহেল সাহরেল বিবিসি’র সাথে সাক্ষাৎ করে বলেছেন যে, ‘একজন মুসলিম হিসাবে কাশ্মীরের বা ভারতের বা অন্যান্য মুসলমানদের স্বার্থে আমাদের অবস্থান গ্রহণের অধিকার আছে।’ অবশ্য কিছুটা কৈফিয়তের সুরে তিনি বলেছেন, যে এর জন্য কোনো দেশের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভিযান সংগঠিত করার পরিকল্পনা তাদের নেই। তিনি একই সাথে জানিয়েছেন, যে কোনো দেশের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালানো তালিবানদের নীতি নয়।
তালিবানদের শীর্ষস্থানীয় অন্যতম নেতা আলাস হাক্কানি অবশ্য পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-র সাথে হাক্কানি গোষ্ঠীগুলির সামরিক সম্পর্ক রচনা এবং এই সম্পর্কের পরিণতিতে তালিবানরা যে কোনো সময় কাশ্মীরে হস্তক্ষেপ করতে পারে - এই আশঙ্কাকে বাতিল করে দিয়েছেন। তিনি আরও বলেছেন যে, এ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে বিশেষত ভারতের প্রচার মাধ্যমে যা প্রচারিত হচ্ছে তা ‘অমূলক’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।
কিন্তু অনেক রাজনৈতিক ভাষ্যকারের মতে বিষয়টি খুব সহজ সরল বলে মনে করার কারণ নেই। ডেভিড দেবাদাস নামক একজন প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ’র মতে, তালিবানদের এই ভাষ্যকে পূর্ণ বিশ্বাসে গ্রহণ করা ঠিক হবে না। এক দশক পূর্বেই পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর সাহায্যে কাশ্মীরে তালিবানি হস্তক্ষেপ ঘটানোর উদ্যোগ হলেও তা বাতিল হয়েছে নিশ্চিতভাবে বলা যাবে না। বিশেষত লস্কর-ই-তৈবা এবং জইশ-ই-মহম্মদ যারা কাশ্মীরি জেহাদিদের সাথে প্রথম থেকেই রয়েছে, তারা এখনও সক্রিয় এবং সাম্প্রতিক যে হত্যাকাণ্ডগুলি সংগঠিত হয়েছে তার সাথে যুক্ত। এদের উভয়ের সাথে তালিবান এবং আইএসআই-এর সুসম্পর্ক রয়েছে। এই উভয় গোষ্ঠীকে ভারতীয় উপমহাদেশে আলকায়দা বলা হয়ে থাকে। আফগান রাজনীতিতে যারা ভারত বিরোধী বলে পরিচিত, তাদের সাথে এদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। সুতরাং, আফগানিস্তানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন কাশ্মীরের বর্তমান পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করবে না তা একেবারে বলা যায় না।
কাশ্মীরের বর্তমান পরিস্থিতির ভবিষ্যৎ গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে আফগানিস্তানের সম্পর্ক যেমন রয়েছে তেমনই ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বাস্তবতাও এর সাথে যুক্ত। ২০১৯ সালের ৫ আগস্টের ঘটনা পূর্বেই উল্লেখিত হয়েছে। এই ঘটনা কাশ্মীরের জনগণের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা তৈরি করেছে। আরএসএস-বিজেপি চক্র ভারতীয় রাজনীতিতে যে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের বিষময় প্রক্রিয়া শুরু করেছে, তা ইসলামিক মৌলবাদকে উৎসাহিত করেছে। সুতরাং, কাশ্মীর পরিস্থিতির মোকাবিলায় একদিকে যেমন সামরিক নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, তেমনই অন্যদিকে জম্মু-কাশ্মীরের সাংবিধানিক অবস্থা ২০১৯ সালের ৪ আগস্টের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। জম্মু-কাশ্মীরে অবিলম্বে বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়া দরকার। কাশ্মীরের জনগরণের মধ্যে আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলা দরকার। দেশের অভ্যন্তরে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে মতাদর্শগত সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে। এভাবেই কাশ্মীরের বর্তমান সময়ের মোকাবিলা করা যাবে।