E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

1t.org: এক বাগাড়ম্বর

তপন মিশ্র


আফ্রিকা মহাদেশে সাভানা তৃণভূমি।

বিশ্ব অর্থনীতি সংস্থা (ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম) এক লক্ষ কোটি অর্থাৎ এক ট্রিলিয়ন গাছ লাগানোর প্রচার শুরু করেছে। এই উদ্যোগের নাম 1t.org - ১টি.অরগ। গাছ লাগানো হবে পৃথিবীজুড়ে। এটা কোনো নতুন বিষয় নয়। ২০১৫ সালে একটি হিসাবে পাওয়া যায় যে, পৃথিবীতে এখন কমবেশি ৩ ট্রিলিয়ন বৃক্ষ আছে। মানুষ দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের ফলে যে কার্বন-ডাই-অক্সাইড বাতাসে ত্যাগ করছে তাকে শোষণ করতে হলে আরও ১.২ ট্রিলিয়ন গাছ লাগানো চাই। তাই আমাদের সহজে মনে হবে যে, এটি একটি অত্যন্ত সুচিন্তিত উদ্যোগ। বৃক্ষরোপণের 1t.org অভিযানের একজন বড় পৃষ্ঠপোষক হলেন আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প।     এমন ধারণা পৃথিবীতে একদম নতুন নয়। ১৯৭৭ সাল থেকে আফ্রিকা মহাদেশে গ্রিন বেল্ট আন্দোলন শুরু হয়। ফলে ২০১২ সাল নাগাদ প্রায় ৩০০ লক্ষ গাছ লাগানো হয়ে যায় (নটিংহাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত সমীক্ষা থেকে পাওয়া তথ্য)। এই গ্রিন বেল্ট আন্দোলনের উদ্যোক্তা কেনিয়ার প্রয়াত ওয়াঙ্গারি মুটা মাথাই ২০০৪ সালে বিশ্ব শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। পরে তিনি ইন্দিরা গান্ধী শান্তি পুরস্কারও পান। তারপর ২০০৬ সালে বিলিয়ন ট্রি কাম্পেন (একশত কোটি গাছ লাগানোর প্রচার) জাতিসঙ্ঘের পরিবেশ রক্ষা সংস্থা - ইউএনইপি (United Nations environmental Programme) শুরু করে। আয়োজকদের দাবি মতো এই পর্যায়ের শেষ গাছটি ২০০৭ সাল শেষের আগেই রোপিত হয়ে যায়। তার পর শুরু হয় ৭শত কোটি গাছ লাগানোর কর্মসুচি। এই লক্ষ্য পূরণ হয়ে যায় ২০০৯ সালের ডিসেম্বর মাসে অর্থাৎ কোপেনহেগেন ইউএনইপি-র সম্মেলনের (United Nations Climate Change Conference) আগে। এতো গেল হিসেবের গাছ, এর সঙ্গে আমাদের দেশের সরকার এবং আপনার আমার উদ্যোগেও কম গাছ লাগানো হয়নি। এ থেকে বোঝা যায় যে 1t.org কোনো নতুন ভাবনা নয় এবং পৃথিবীজুড়ে লক্ষ কোটি গাছ লাগানোর পরও গ্রিন হাউস গ্যাসের সমস্যার কোনো সুরাহা হয়নি বরং বৃদ্ধি পেয়েছে।

বিপদ কোথায়?

লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন অধ্যাপক-গবেষক সাইমন লুইস-এর নেতৃত্বে একটি গবেষণার ফল ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে ‘স্পিঞ্জার নেচার’ (Springer Nature) পত্রিকায় প্রকাশ করেন। গবেষণাপত্রের শিরোনাম: Restoring natural forests is the best way to remove atmospheric carbon। তাতে তারা বলছেন যে, একটি খালি জমিকে গাছ লাগানোর থেকে প্রকৃতির হাতে ছেড়ে দেওয়া ভালো। যদি  ক্রান্তীয় অঞ্চল হয় তাহলে ভূমিক্ষয় রোধ করা থেকে বাঁচানোর জন্য অতি সাবধানতা সহকারে প্রজাতি নির্বাচন করা দরকার। বনসৃজনের নামে ইউক্যালিপটাস বা সোনাঝুরির মতো গাছ লাগিয়ে ১০ বছর অন্তর গাছ কেটে আবার গাছ লাগানো লাভের থেকে ক্ষতি বেশি। এই ধরনের বাণিজ্যিক বৃক্ষরোপণের প্রয়াসকে তাঁরা ভ্রান্ত প্রয়াস (misdirected efforts) বলে অভিহিত করেন। তাহলে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় যে, বাণিজ্যিকভাবে বৃক্ষরোপণ কোনভাবেই বনসৃজনের পর্যায়ে পড়ে না।

জার্মানির বন শহরে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আইইউসিএন (International Union for Conservation of Nature and Natural Resources)-এর সভায় দেশগুলি প্রাকৃতিক বনাঞ্চল ফিরিয়ে আনার কিছু প্রতিশ্রুতি দেয়। এর অন্য নাম ‘বন চ্যালেঞ্জ’ বা ‘ফরেস্ট ল্যান্ডস্কেপ রেস্টটরেশন অভিমুখ’ (FLR approach)। এখানে একবাক্যে সবাই স্বীকার করেন যে, বৃক্ষরোপণ থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রাকৃতিক অরণ্যকে রক্ষা করা বা ফিরিয়ে আনা। তাদের হিসাব মতো পৃথিবীজুড়ে সর্বমোট ৩৫০০ লক্ষ হেক্টর নষ্ট হয়ে যাওয়া বনাঞ্চলে অরণ্যের পুনঃসৃজনের লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে “বন চ্যালেঞ্জ”।

২০০০ থেকে ২০১৩ - এই ১৩ বছরে পৃথিবীর ৮ শতাংশ Intact Forest Landscapes (IFLs)  বা আদিম বনাঞ্চল নষ্ট হয়েছে। এর পরিমাণটা হলো ১০৪ মিলিয়ন হেক্টর। মোটামুটি হিসেবে দাঁড়ায় যে, প্রতিদিন প্রায় ২০,০০০ হেক্টর আদিম বনাঞ্চল ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে এই বনাঞ্চলের ভূমিকা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এই তথ্য গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচের।

আমাদের দেশের কথায় আসি। ওয়ার্ল্ড রিসোর্সেস ইন্সটিটিউট বলছে যে, ভারতে ২০১৪ থেকে ২০১৮ - এই ৫ বছরে ১ লক্ষ ২২ হাজার হেক্টারেরও বেশি প্রাকৃতিক বনাঞ্চল উন্নয়নের নামে নষ্ট করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে তারা খুব গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি তথ্য দিয়েছে। তারা বলছে: ব্রাজিল আগামীদিনে ১৯ মিলিয়ন হেক্টর বনসৃজনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যার ৮২শতাংশ নষ্ট হয়ে যাওয়া প্রাকৃতিক বনাঞ্চলে হবে। নাইজিরিয়া ১৫.৭ মিলিয়ন হেক্টর কৃষি বন (Agro forestry) সৃজনের কথা বলেছে। চীন দেশ ১.২শতাংশ ভূমিতে প্রাকৃতিক বনাঞ্চল ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা করছে। ভিয়েতনামের প্রতিশ্রুতি হলো, ১৪.৬ মিলিয়ন হেক্টরে প্রাকৃতিক বনাঞ্চল ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবে। আর ভারত বলছে যে, হারিয়ে যাওয়া প্রাকৃতিক বনের ৬২.৫ শতাংশ অংশে প্রাকৃতিক বনাঞ্চল ফিরিয়ে আনবে। আইইউসিএন-এর মতে ভিয়েতনামের উদ্যোগ সব থেকে বেশি পরিবেশবান্ধব।

অবৈজ্ঞানিক বনসৃজনের হিড়িক

ব্যাপক প্রচারের মধ্যদিয়ে এটা প্রমাণ করার চেষ্টা হচ্ছে যে, সংরক্ষণের ভাবনা জৈববৈচিত্র্য রক্ষা থেকে সরে গিয়ে কেবল কার্বন সিকুয়েস্ট্রেশন বা কার্বন শোষণের উপর কেন্দ্রীভূত হওয়া উচিত। পৃথিবীজুড়ে নানা কারণে কাঠের চাহিদা বাড়ছে। এখন স্বাভাবিকভাবেই মনে আসছে যে, একটি লোহা বা প্লাস্টিকের চেয়ারের তুলনায় একটি কাঠের চেয়ার অনেক বেশি পরিবেশবান্ধব। কারণ লোহা বা প্লাস্টিকের আসবাবপত্র তৈরিতে অনেক বেশি শক্তি, জল এবং আর্থিক বিনিয়োগ প্রয়োজন। তাই কর্পোরেটদের এখন খনি বা কারখানার থেকে বাণিজ্যিক অরণ্য সৃজনে বেশি উৎসাহ।

বৃক্ষরোপণের অতি উৎসাহের মধ্যে আমাদের আশঙ্কা যে, বাংলার তো বটেই, সারা পৃথিবীর তৃণভূমির অস্তিত্ব সঙ্কটের মধ্যে চলে যাবে। মনে রাখা দরকার যে, অভিব্যক্তির ধারায় বৃক্ষ প্রজাতিগুলির তুলনায় ঘাস জাতীয় উদ্ভিদ অনেকটা  আধুনিক। এদের বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখার ক্ষমতা অভূতপূর্ব। পৃথিবীর খাদ্য উৎপাদনকারী উদ্ভিদগোষ্ঠীর মধ্যে ধান, গম, ভুট্টা, আখ ইত্যাদি ধরনের প্রজাতি ঘাস জাতীয়। একটি তৃণভূমির জীববৈচিত্র্য ও কার্বন ধারণের ক্ষমতাও কম নয়। তৃণভূমি মাটিতে যতটা জল সংরক্ষণ করতে পারে সৃজিত বন তা পারে না। কারণ বৃষ্টি পড়লে তার আঘাত অনেকটাই ঘাসের স্তর আত্মভূত করে নেয়। স্তিমিত জলের স্রোত ধীরে ধীরে ঘাসের গুচ্ছমূলদ্বারা তৈরি অসংখ্য ছিদ্র দিয়ে মাটির নিচে সহজে যেতে পারে।

ঠিকই তৃণভূমির তুলনায় বৃক্ষ আচ্ছাদনের আদর বেশি। কিন্তু তৃণভূমির উপর নির্ভরশীল রয়েছে যে সমস্ত তৃণভোজী প্রাণী তাদের বেঁচে থাকা কঠিন হলে সম্পূর্ণ খাদ্যশৃঙ্খল ওলটপালট হয়ে যাবে। একারণে প্রতিটি বনাঞ্চলে তৃণভূমি না থাকলে অরণ্য বাস্তুতন্ত্র সম্পূর্ণ হয় না। একারণেই তো আফ্রিকা মহাদেশের যে অর্ধেকের বেশি অঞ্চলে সাভানা তৃণভূমি রয়েছে সেখানেই বন্যপ্রাণের বৈচিত্র্য অনেক বেশি। আফ্রিকার মাসাইল্যান্ডের আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এটাই প্রমাণ করে। আমাদের দেশের এবং আমাদের রাজ্যের তরাই-ডুয়ার্স তৃণভূমি এখন অবলুপ্তির পথে। বৃক্ষরোপণের লম্ফঝম্ফে যে-টুকু বেঁচে আছে তা যেন হারিয়ে না যায়। বাস্তুতন্ত্রের বৈচিত্র্যই জীববৈচিত্র্যের গোড়ার কথা।  আমাদের রাজ্যসহ দেশের বেশকিছু অংশে চা এবং কফি চাষ তৃণভূমির অনেক ক্ষতি করেছে। আর যেন তা না হয় সে দেখতে হবে।

আজকাল পতিত জমি (waste land) কথাটি খুব চালু হয়েছে। সরকারি সংজ্ঞা অনুযায়ী যে জমি উৎপাদনযোগ্য নয় বা যে জমির উৎপাদন ক্ষমতা তলানিতে তাহাই পতিত জমি। এগুলিতে মূলত আমাদের অপছন্দের ঝোপঝাড় জন্মায়। এখন প্রশ্ন আসে কিসের উৎপাদন? বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে যে পরিমাণ শর্করা তৈরি হয় এবং তার সঙ্গে মাটি থেকে শোষিত খনিজ লবন যুক্ত করলে মোট যে জৈবভর (biomass) তৈরি হয় সেটাই তার উৎপাদন ক্ষমতা বা উৎপাদনশীলতা। উৎপাদন ক্ষমতাকে কেবল তার ব্যবহারযোগ্য অংশের জৈবভর হিসাবে বিবেচনা করলে পৃথিবীতে অনেক প্রজাতির অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখে পড়বে। কোনো জমির উপযোগিতা শূন্য হয় না। গ্রাম ও শহরের অনেক গরিব মানুষের দৈনন্দিন রান্নার জন্য যে তাপ শক্তি বা জ্বালানির প্রয়োজন তার জোগান আসে এই ঝোপঝাড় থেকে। এই হিসাবে দেখলে ঝোপঝাড়ের উৎপাদনশীলতা কোনোমতেই একটি বৃক্ষের তুলনাই কম নয়। গ্রামে এবং শহরে এমনকি কলকাতা শহরেও এই  ঝোপঝাড়গুলি বেশ কিছু উদ্ভিদ প্রজাতি, ছোটো স্তন্যপায়ী প্রাণী, সরীসৃপ, পাখি ইত্যাদির আবাসস্থল বা বলা যেতে পারে বেঁচে থাকার শেষ সম্বল (last Refugio)।

আসল উদ্দেশ্যটা কি?

বনসৃজনের বিশ্বায়নের মধ্য দিয়ে ট্রাম্পের উদ্দেশ্য, বোলসোনারোর উদ্দেশ্য এবং মোদী-শাহীর উদ্দেশ্যের মধ্যে কোনো ফারাক নেই। আগামীদিনে পৃথিবীজোড়া বায়ুমণ্ডলের ক্রমবর্ধমান কার্বন-ডাই-অক্সাইড কমানোর জন্য প্যারিস চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ২০১৫ সালে। এই চুক্তির আগে প্রত্যেকটি দেশ একটি করে মুচলেখা, যাকে সংক্ষেপে আইএনডিসি (Intended Nationally Determined Contributions) জমা দেয়। অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশও একটি আইএনডিসি জমা দেয়। এখানে উল্লেখিত অনেক কথার মধ্যে দুটি বিষয় উল্লেখ করলে বোঝা যাবে দুয়ে দুয়ে চার কি করে হয়। প্রথমত, ভারত সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে আগামী ১৫ বছরের মধ্যে প্রায় ৩ বিলিয়ন টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড বনসৃজনের মধ্য দিয়ে শোষিত হবে। দ্বিতীয়ত, এই বনসৃজন হবে পিপিপি (Private Public Partnership) মডেল অর্থাৎ কর্পোরেটদের সঙ্গে সহযোগে। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার যে, দেশের আইন অনুযায়ী অরণ্যের মধ্যে বৃক্ষরোপণের কোনো অধিকার বেসরকারি সংস্থার নেই। এই কাজ কেবল করতে পারে বনবিভাগ এবং সুনির্দিষ্ট ওয়ার্কিং প্ল্যানের মধ্য দিয়ে। সেখানে পিপিপি মডেল অনুযায়ী কোনো কর্পোরেট সংস্থাকে অরণ্যভূমিতে বৃক্ষরোপণের অনুমতি দেওয়া যায় কিভাবে? বেশ কয়েকটি বনভূমির বেসরকারিকরণের কোনো প্রচ্ছন্ন উদ্দেশ্য সরকারের নেই তো? আসল কথা হলো, প্রাকৃতিক বনের কিছু অংশে বাণিজ্যিক বন (commercial forestry)-এর ব্যবস্থা করা। এই প্রক্রিয়ায় যেমন অরণ্যের উপর নির্ভরশীল মানুষের জীবনজীবিকা বিপন্ন হবে তেমনই অরণ্য তার পরিবেশ মঙ্গলকারি চরিত্র হারাবে। প্রকৃতিকে লুঠ করে মুনাফার সুযোগ আরও প্রসারিত করাই মূল উদ্দেশ্য।

পরিকল্পিত বৃক্ষরোপণই লক্ষ্য

কোথায় হবে বৃক্ষরোপণের কাজ?  জাতিসঙ্ঘের ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল সংস্থা (FAO) একটি হিসাবে বলছে, সারাবিশ্বে এখনও ৯০০০ লক্ষ হেক্টর পতিত জমি আছে যেখানে এই গাছ লাগানো যেতে পারে। কয়েক বছর আগে ওয়ার্ল্ড রিসোর্সেস ইন্সটিটিউটে’র বিজ্ঞানীরা স্যাটেলাইট ইমেজ সহ তথ্য পেশ করেন যে, সারা পৃথিবীতে এখনও ২০০ কোটি হেক্টর জমি আছে যেখানে গাছ লাগানো যেতে পারে।

কিন্তু উপরের স্যাটেলাইট থেকে দেখে কি সব সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়? সিদ্ধান্ত নিতে হলে ভূমির আসল অবস্থা (ground truth) দেখতে হয়। এবং তার সঙ্গে দেখতে হয় এলাকার মানুষের চাহিদা। কোথায় কি প্রজাতি আছে, তার মধ্যে কোন্‌টা মানুষ চাইছে এবং কেন চাইছে তা দেখা দরকার। একটি নির্দিষ্ট প্রজাতি ভাল মনে হলে কেবল সেটাই লাগানো উচিত তা নয়। যে কোনো ধরনের একই প্রজাতির রোপণ পরিবেশরক্ষার পরিপন্থী। সেই অঞ্চলের প্রজাতির মিশ্রণ (species mix) একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তারজন্য চাই সেই অঞ্চলের প্রজাতি সমীক্ষা। এক্ষেত্রে এলাকার মানুষের অভিজ্ঞতা মূল্যবান। এই সমস্ত কিছুর পর বৃক্ষরোপণের জন্য প্রজাতি নির্বাচন করলে প্রকৃতিরুষ্ট হওয়ার সম্ভবনা কম।

একথা মেনে নেওয়া ভাল যে, বৃক্ষরোপণ মানে বনসৃজন নয়। অরণ্যের বহু বৈশিষ্ট্যের মধ্যে একটি বৈশিষ্ট্য হলো বৃক্ষের উপস্থিতি। পৃথিবীতে এমন অনেক বনাঞ্চল আছে যেখানে বৃক্ষের পরিমাণ অত্যন্ত কম, কিন্তু তাই বলে বন্যপ্রাণের অভাব নেই। বনসৃজনের কাজটি প্রকৃতির হাতে ছেড়ে দেওয়া ভাল। আমাদের কাজ প্রকৃতির বনসৃজনের প্রক্রিয়াতে বাধা না দেওয়া। যদি কোনো প্রাকৃতিক কারণে অরণ্য নষ্ট হয় তাহলে প্রকৃতি নিজের উদ্যোগেই আবার নিজের জায়গায় ফিরে আসে যা বিজ্ঞানের ভাষায় রেজিলেন্স (resilience) বলা হয়। সেই প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে আমরা কিছু সাহায্য করতে পারি মাত্র। এই পদ্ধতিকে assisted natural regeneration বলা হয়। এই পদ্ধতির রূপায়ণে কোনো বিশেষ প্রযুক্তি বা জ্ঞানের প্রয়োজন পড়ে না। এর জন্য প্রাকৃতিক পদ্ধতিকে অনুধাবন করে তাকে নকল করার দক্ষতা অর্জন করতে হ্য়। বনাঞ্চলের অনেক মানুষের এই দক্ষতা দেখা যায়।

আমাদের রাজ্যে এবং দেশে অনেক জমি এখনও আছে যেখানে আমরা বৃক্ষরোপণ করতে পারি। বিশেষ করে খনি বা তেমন কিছু কাজে ব্যবহারের পর পরিত্যক্ত জমি। কিন্তু সেই জমি চিহ্নিত করা জরুরি। কোনোভাবেই এই জমি মুনাফাখোর কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া ঠিক হবে না। এদের পরিবেশেরক্ষার প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা না থাকায় এই সমস্ত জমির বাণিজ্যিক বৃক্ষরোপণের জন্য ব্যবহার করার সম্ভাবনা অনেক বেশি। আগামীদিনে বৃক্ষরোপণের কাজ মূলত দুটি বিষয়ের উপর কেন্দ্রীভূত হওয়া আবশ্যক। প্রথমটি হলো, মানুষের জীবিকার চাহিদা এবং অন্যটি সেই অঞ্চলের বাস্তুতান্ত্রিক (ecological) চাহিদা। বলাইবাহুল্য যে, এর বাইরে কোনো ধরনের চাহিদা পূরণের চেষ্টা আমাদের পরিবেশের লাভের পরিবর্তে ক্ষতি করবে।