আমেরিকার বর্ণবিদ্বেষ-বিরোধী আন্দোলনের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব জন লুইস-এর জীবনাবসান
আমেরিকার বর্ণবিদ্বেষ বিরোধী ও নাগরিক আন্দোলনের অন্যতম প্রতীক জন লুইস সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিগ্রো মুক্তি আন্দোলনের প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র-এর অন্যতম সহযোগী জন লুইস দীর্ঘদিন ধরেই অগ্ন্যাশয়ের ক্যান্সারে ভুগছিলেন। ১৭ জুলাই হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা সহ বিশিষ্টরা। শোক জানানো হয় মার্কিন কংগ্রেসের পক্ষ থেকেও।
৬০-এর দশকে নাগরিক অধিকার বা ‘সিভিল রাইটস’ আন্দোলনের সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন জন লুইস। মার্টিন লুথার কিং-এর নেতৃত্বে কালো মানুষদের ভোটাধিকারসহ একাধিক গণতান্ত্রিক অধিকারের ইস্যুতে দেশ জুড়ে যাঁরা ঝড় তুলেছিলেন জন লুইস তাঁদের মধ্যে কনিষ্ঠতম। সিভিল রাইটস আন্দোলনের ‘সিংহ’ বলে অভিহিত করা হতো তাঁকে।
কালো মানুষের নিপীড়ন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ শ্বেতাঙ্গ মানুষের ইতিহাসে এক দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত। তাঁদের ভোটাধিকারের দাবিতে ৬০-এর দশকের মাঝামাঝি আয়োজিত হয় এক প্রতিবাদী পদযাত্রা। মাত্র ২৫ বছর বয়সে, ১৯৬৫ সালের ৭ মার্চ সেলমা থেকে আলাবামা প্রদেশের রাজধানী মন্টগোমারি পর্যন্ত ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ ওই পদযাত্রার নেতৃত্ব দেন জন লুইস এবং রেভারেন্ড উইলিয়াম। পূর্বঘোষিত অহিংস এই কর্মসূচিতে ন্যাশনাল আরবান লিগ, নিগ্রো আমেরিকান লেবার কাউন্সিল, কংগ্রেস অব রেশিয়াল ইকুয়ালিটি সহ বেশ কয়েকটি সংগঠন যুক্ত ছিল। জন লুইস সে সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নন ভায়োলেন্ট কো-অর্ডিনেশন কমিটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সংগঠক ছিলেন। দাবিসমূহের পক্ষে বহু প্রচার সভা সংগঠিত করার পর ৭ মার্চ, রবিবার শুরু হয় নারী শিশু সহ ৬০০ মানুষের প্রতিবাদী মিছিল। পরে আলাবামা নদীর ওপরের ব্রিজ ধরে জন লুইসের নেতৃত্বে এগোতে থাকা শান্তিপূর্ণ মিছিলের ওপর চড়াও হয় ওঁত পেতে থাকা আলাবামা প্রদেশের পুলিশ। টিয়ার গ্যাস ছোঁড়ে মিছিলে। ঘোড়সওয়ার পুলিশ লেলিয়ে দেওয়া সহ মিছিল আটকাতে যাবতীয় বল প্রয়োগ করে প্রশাসন। ভাগচাষির ছেলে লুইস হিংসার প্ররোচনায় পা দেননি। মিছিলে অংশ নেওয়া মানুষের মনোবল ভাঙতে মুহূর্তে সামনে থাকা জনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পুলিশ। মিছিলের সামনে থাকা যুবক লুইস প্রাণঘাতী আক্রমণের সামনে শত প্ররোচনাতেও ছিলেন স্থিতধী, অচঞ্চল। তাঁর হাত দুটি ছিল বাদামী রঙের কোটের পকেটে ঢোকানো। পুলিশের উপর্যুপরি নির্মম আঘাতে মাটিতে রক্তাপ্লুত অবস্থায় লুটিয়ে পড়েন তিনি। অংশ নেওয়া নারী শিশুরাও পুলিশি হিংসা থেকে সেদিন রেহাই পাননি। গোটা আমেরিকা জাতীয় টেলিভিশন সম্প্রচারে প্রত্যক্ষ করে, কিভাবে বর্ণবিদ্বেষী হিংস্র প্রশাসনের লাঠির ঘায়ে মাথার খুলি ফাটানো হয় নিগ্রো তরুণ লুইসের। রক্তাক্ত লুইস সহ অন্যদের ওপর পুলিশকে নির্বিচারে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখে শিহরিত ও ক্ষুব্ধ হয় মার্কিন বিবেক। বর্ণ বিদ্বেষের প্রাতিষ্ঠানিক বর্বরতার এই নিদর্শনকে নাৎসি জমানার সঙ্গে তুলনা করা শুরু হয়। পত্র পত্রিকায় নিন্দার ঝড় ওঠে। মিছিল সেদিনের মতো থেমে গেলেও প্রতিবাদের বার্তা আমেরিকা জুড়ে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে।
এই প্রেক্ষিতে ভোটাধিকারের দাবিতে মার্কিন নাগরিকরা দেশের প্রতিটি প্রান্তে পথ অবরোধ, ধরনা এবং মিছিলের মধ্য দিয়ে তোলেন অহিংস অবাধ্যতার ঢেউ। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র পরবর্তীতে আবার প্রতিবাদী পদযাত্রা শুরুর ডাক দেন। পরে ফেডারেল কোর্টের আদেশে পদযাত্রার বাধা সরে গেলে ২৫ হাজার প্রতিবাদী মানুষ মার্টিন লুথার কিং-এর নেতৃত্বে তা সম্পূর্ণ করেন। জনমত আরও তীব্র হয় কালো মানুষের ভোটাধিকারের পক্ষে। পরিস্থিতির চাপে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি লিন্ডন জনসন মার্কিন কংগ্রেসের ভোটাধিকার সংক্রান্ত বিল পাশ করাতে বাধ্য হন। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র-এর সার্বিক ঐতিহাসিক ভূমিকা সত্ত্বেও রক্তস্নাত জন লুইসের অনড় জেদি কিন্তু অহিংস মনোভাবের জয়গাথা মার্কিন নাগরিক আন্দোলনের ইতিহাসে অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে ‘রক্তাক্ত রবিবার’ (ব্লাডি সানডে) নামে অভিহিত হয়। তাঁর সামগ্রিক অবদানের জন্য ২০১১ সালে দেশের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান পেয়েছেন তিনি।
আলবামা প্রদেশের ট্রয় শহরে ১৯৪০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি জন্ম হয় জন-এর। ছোটবেলায় স্কুলে লাইব্রেরি কার্ড চেয়ে পাননি তিনি, গায়ের রঙ কালো হবার জন্য। ওই ঘটনা তার মনে প্রবল আলোড়ন তৈরি করে। কালো মানুষদের ওপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের পথ খুঁজতে খুঁজতে তিনি কিশোর বয়সে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র-এর বক্তব্য শোনেন এবং উজ্জীবিত হন। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে এরপরই সক্রিয় কর্মী ও সংগঠক হয়ে ওঠেন তিনি। ট্রয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচিত কৃষ্ণাঙ্গ ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে তাঁর রাজনৈতিক উত্থান শুরু হয়। পরবর্তীকালে আশির দশকে তিনি মার্কিন কংগ্রেসের সদস্য নির্বাচিত হন একাধিকবার।
জন লুইস ছিলেন একজন আজীবন প্রতিবাদী ব্যক্তিত্ব। ২০১৬ সালে মার্কিন শহর অরল্যান্ডোতে জনৈক বন্দুকবাজের গুলিতে ৪৯ জনের মৃত্যুর প্রতিবাদে আগ্নেয়াস্ত্র সংবরণের আইনি ব্যবস্থা নেবার দাবিতে মার্কিন কংগ্রেসের অধিবেশন কক্ষে মাটিতে বসে পড়তে দেখা যায় তাঁকে, অন্য প্রতিবাদী সাংসদদের সঙ্গে। জর্জ ডবলিউ বুশের কার্যকলাপের প্রতিবাদ করেছেন তিনি। সাংসদ হবার আগে ষাটের দশকে বহুবার জেলে গেছেন, আন্দোলনের জেরে পুলিশ তাঁকে রক্তাক্ত করেছে অসংখ্য বার। কোনও কিছুই টলাতে পারেনি তাঁকে। অবিচল থেকেছেন অবস্থানে। তার পরিচয় পাওয়া গেছে বারবার। মিনিয়াপোলিসে কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েড-এর সাম্প্রতিক হত্যার ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছেন তিনি। দেশ জোড়া উত্তাল বর্ণবাদী হিংসাবিরোধী লাগাতার আন্দোলনকে স্বাগত জানিয়েছেন। তবে সেরা প্রশংসা পেয়েছেন আলাবামার সেলমা শহরের সেই শেরিফ-এর কাছ থেকে, যিনি একদা গণ্ডগোলের ‘পালের গোদা’ বলে কটাক্ষ করে বারবার পুলিশ লেলিয়ে দিয়েছিলেন জন-এর ওপর। পরবর্তীকালে তিনি সংবর্ধিত করেন জন লুইস-কে। শহরের প্রতীকী চাবি তুলে দেন লুইস-এর হাতে। সংবর্ধনা সভায় তিনি (শেরিফ) বলেন, জন লুইস হলেন আমার দেখা পৃথিবীর সবচেয়ে সাহসী মানুষ।