E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

করোনা ও কর্মসংস্থান সম্পর্কে আইএলও’র প্রতিবেদন

লালন ফকির


জেনেভায় আইএলও’র সদর দপ্তর।

করোনা ভাইরাসে শুধু যে মানুষই আক্রান্ত হয়ে পড়েছে তাই নয়, বিভিন্ন দেশের, সে উন্নত অনুন্নত যাই হোক না কেন, অর্থনীতিও আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদদের মতে কোভিড ১৯-এর আক্রমণ শুরু হওয়ার ঠিক পূর্ব থেকেই আন্তর্জাতিক অর্থনীতি জর্জরিত হয়ে পড়েছিল। বিশেষত, মন্দাজনিত অর্থনৈতিক সঙ্কট গোটা বিশ্বকে গ্রাস করেছিল। বস্তুতপক্ষে, ২০০৮ সাল থেকে চলে আসা মহামন্দা আর এক মহামারীর চেহারা নিয়েছিল। করোনা ভাইরাসের আক্রমণ এই অর্থনৈতিক সঙ্কটকাল আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এই সঙ্কটের একটি দিক হলো, কর্মসংস্থানের অতি মাত্রায় সংকোচন।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) করোনা পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বিশ্ব কর্মসংস্থানের বর্তমান হালচাল সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদন তৈরি করে। এদের প্রতিবেদনের প্রধান ফোকাস ছিল, তরুণ বা যুব সমাজের আগামী কর্মসংস্থানের ওপর কোভিড ১৯ এবং লকডাউনের কুপ্রভাব। এক্ষেত্রে বিচার্য বিষয়ের মধ্যে যুব সমাজের প্রসঙ্গটি উপস্থিত থাকলেও প্রতিবেদনে অপেক্ষাকৃত দরিদ্র যুবসমাজের ওপর দৃষ্টিকে নিবদ্ধ করা হয়েছে। সম্ভবত এই কারণেই প্রতিবেদনে এই অংশের সম্বন্ধে বলা হয়েছে ‘লকডাউন জেনারেশন’ বা তালাবন্ধ প্রজন্ম।

কোভিড ১৯-এর আক্রমণ শুরু হওয়ার সময় থেকেই আইএলও কর্মসংস্থানের ওপর কোভিড পরিস্থিতির প্রভাব সম্পর্কে পর্যবেক্ষণ করে এসেছে। মহামারীর আগে থেকে চলতে থাকা মন্দার তুলনায় মহামারী ও লকডাউনের সময়কার অবস্থা যে আরও ভয়াবহ তা জোরের সাথে আলোচিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনটির মতে, চলতি বছরে বিদ্যালয় থেকে উত্তীর্ণ হয়ে যারা স্নাতকস্তরে প্রবেশ করেছেন বা যারা স্নাতক থেকে স্নাতকোত্তরে উত্তীর্ণ হয়েছেন তাদের ওপর কর্মহীনতার প্রভাব ব্যাপক। বিশ্বে আনুমানিক ৯৪ শতাংশ শ্রমশক্তির ঠিকানা হলো সেইসব জায়গা যেখানে কর্মক্ষেত্রগুলির বৃহৎ অংশ বন্ধ হয়ে আছে। এই সব জায়গায় যদি ১০.৭ শতাংশ কাজের সময় হ্রাস করা হয় তাহলে তা হবে ৩০ কোটি লোকের কর্মসংস্থান হ্রাসের সমান। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী তাদের নির্দেশ মতো করোনা রোগীদের যদি টেস্টিং এবং পৃথকবাসে রাখা হয় তাহলেও কর্মসংস্থানের অবনতি ঘটবে। প্রতিবেদনটিতে লেখা হয়েছে, ক্লোজারের ফলে যুব সমাজের মধ্যে বিভিন্ন স্থানে কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষত, আমেরিকা, ইয়োরোপ এবং মধ্য এশিয়ার দেশগুলিতে মোট কাজের ঘণ্টার নিরিখে যুব সমাজ ব্যাপকভাবে বঞ্চিত হয়েছে।

নবীন প্রজন্মের শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে বৈষম্য বহুমাত্রিক। এই অংশের শ্রমিকরা শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, আয় ও চাকরির উন্নতির প্রশ্নে বিবিধ সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রায় ১৭.৮০ কোটি নবীন কর্মীর মধ্যে প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৪ জন যেসমস্ত জায়গায় কর্মরত আছেন তা কোভিড ১৯-এর আক্রমণে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নবীন কর্মীদের শতকরা ৭৭ভাগ অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত। তুলনায় পরিণত বয়স্করা শতকরা ৬০ ভাগ স্থায়ী চাকরিতে কর্মরত। শিক্ষাগত, প্রযুক্তিগত এবং কর্মরত অবস্থায় প্রশিক্ষিত হবার সুযোগ থেকে নবীন শ্রমিকদের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ বঞ্চিত হয়ে চলেছে। আইএলও, ইউনেস্কো এবং বিশ্ব ব্যাঙ্কের পক্ষ থেকে যৌথভাবে সংগঠিত এক জনমত সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, শতকরা ৯৮ ভাগ মতদাতাই বলেছেন যে, অধিকাংশ কর্মক্ষেত্র বন্ধ হয়ে আছে। এই ধরনের দুই তৃতীয়াংশ কেন্দ্রে অনলাইনের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। অনুন্নত দেশগুলিতে শিক্ষার মান এবং ছাত্রদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা কম থাকায় এই ধরনের প্রশিক্ষণের যথাযথ মান রক্ষা করা যাচ্ছে না বলে সমীক্ষায় মন্তব্য করা হয়েছে।

আইএলও এবং গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন ডিসেন্ট জবস্ ফর ইউথ সংস্থার পক্ষ থেকে এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, কোভিড ১৯ শুরু হওয়ার পূর্বে প্রতি ৬ জন নবীন শ্রমিকের মধ্যে ১ জনকে জোর করে কাজ থেকে বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কর্মরত নবীন শ্রমিকদের ২৩ শতাংশের ক্ষেত্রে তাদের কাজের সময় বাধ্যতামূলকভাবে কমিয়ে দিয়ে তাদের অর্ধ বেকারে পরিণত করা হয়েছে। নবীন প্রজন্মের শ্রমিকদের অর্ধেকের মধ্যে সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে যে, তারা কোভিড ১৯ সংক্রান্ত অতিমারীর জন্য বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন, মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। যত সংখ্যক নবীন প্রজন্মের শ্রমিকদের মধ্যে সমীক্ষা করা হয়েছে তাদের প্রতি ৬ জনের মধ্যে একজন জানিয়েছে যে, তাদের কাজ বর্তমানে নেই। মহিলা মতদাতাদের শতকরা ৬০ভাগ এবং পুরুষদের শতকরা ৫৩ ভাগ তাদের কর্মসংস্থানের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে খুবই উদ্বিগ্ন এবং হতাশ। নিজেদের চাকরির ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা থেকে তারা অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছে।

আইএলও-র পর্যবেক্ষকদের মতে, কাজের সময় হ্রাস পাওয়ার বড় কারণ হলো জনস্বাস্থ্যের সাথে সম্পর্কিত কোয়ারেন্টাইন এবং লকডাউন। তাছাড়া কোভিড পরীক্ষা প্রভৃতি কারণেও কাজের সময় হ্রাস পেয়েছে। এসবের জন্য শতকরা ৫০ ভাগ কাজের ক্ষতি হয়েছে বলে সমীক্ষক দলের পর্যবেক্ষণ। দক্ষিণ কোরিয়ার দৃষ্টান্তকে সামনে রেখে আইএলও-র সমীক্ষায় বলা হয়েছে, এখানে পরীক্ষা ও চিহ্নিতকরণের ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপের ফলে অতিমারীকে প্রতিহত করা গেলেও কাজের সময় হ্রাসের প্রবণতাকে প্রতিহত করা যায়নি।

ভারত সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পরীক্ষা এবং চিহ্নিতকরণের কাজ অনেক কম হয়েছে। এর ফলে এইসব দেশের সরকারকে লকডাউন, কোয়ারেন্টাইন এবং কনটেনমেন্ট এলাকা ঘোষণার ওপর নির্ভর করতে হয়েছে।এর সাথে বাড়ি থেকে কাজ প্রক্রিয়াও করোনা ভাইরাস প্রতিরোধের উপায় হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। আইএলও-র সমীক্ষায় অবশ্য বলা হয়েছে, পরীক্ষা ও চিহ্নিতকরণের বিশেষ কোনো প্রভাব কর্মক্ষেত্রে কাজের ঘণ্টার ওপর পড়েনি। যে সব দেশে ব্যাপকভাবে পরীক্ষা ও চিহ্নিতকরণের কাজ হয়েছে সেখানে জিডিপি’র ওপর এর প্রভাব পড়েছে মাত্র ১ শতাংশেরও কম।এমনকি কোথাও কোথাও তা অতিরিক্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতেও সাহায্য করেছে।

সমীক্ষায় বলা হয়েছে যে, কোভিড ১৯ অতিমারী এমন সময়ে নবীন প্রজন্মের (১৯–২৪ বছর বয়সী) শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের সুযোগের ওপর আক্রমণ হেনেছে যখন সামগ্রিকভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকুচিত হচ্ছে। ২০০৭-০৮ সালের অর্থনৈতিক মহামন্দার ফলে কর্মসংস্থান এমনিতেই সংকুচিত হয়েছিল। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০০৭ সালে মহামন্দার পূর্বে বিশ্বে বেকারির হার ছিল ১২.৩ শতাংশ। ২০১৯ সালে বৃদ্ধি পেয়ে তা হয়েছে ১৩.৬ শতাংশ। কোভিড ১৯ এই পরিস্থিতিকে আরও ভয়ঙ্কর করে তুলেছে। ৬৪টি দেশ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায় যে, কোভিড ১৯ আক্রমণ শুরু হওয়ার পূর্বে নবীন প্রজন্মের শ্রমিকরা ৭১ শতাংশ বেশি হারে বেতন পেত। নিম্ন বেতনভুক্ত ক্ষেত্র যেমন খাদ্যশস্য, আবাসন, খুচরা ও পাইকারি ব্যবসা প্রভৃতি ক্ষেত্রে কর্মসংস্হানের প্রশ্নে কোভিড ১৯ দ্বারা আক্রমণ বেশি মাত্রায় হয়েছে। আন্তর্জাতিকস্তরে পরিযায়ী শ্রমিকদের ৭০ শতাংশেরই বয়স ৩০ বছরের কম। এরা কোভিড ১৯-এর পর্বে কাজ হারিয়ে নিজ বাসভূমে প্রত্যাবর্তনের পর নতুন করে কাজের সুযোগ পাচ্ছে না।

ভারতে সিএমআইই’র তথ্য অনুযায়ী ১৪ কোটি মানুষ কাজ হারিয়েছেন। ভারতে পরিযায়ী শ্রমিকদের গড় বয়স ২৫ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। এখানে তথ্যপ্রযুক্তি, তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর পরিষেবা, নির্মাণ শিল্প সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক কর্মসংকোচন ও ছাঁটাই শুরু হয়েছে। কোভিড ১৯ নিরাময়ের টিকা উদ্ভাবিত হবে, কিন্তু বিশ্ব অর্থনীতি, বিশেষত পুঁজিবাদী অর্থনীতির যে ক্ষতি সাধন হয়েছে তার নিরাময় হওয়া মুশকিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না।