আমেরিকার একমেরুত্বের অভিযানের চ্যালেঞ্জ
মৃদুল দে
রাশিয়া ইউক্রেন যূদ্ধের আগে বেজিঙে বৈঠকে পুতিন-শি জিন পিং।
ত্রাসে, প্রতিহিংসাপরায়ণতায় এখনও অনেক উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশকে কাবু করতে সক্ষম হলেও সাম্রাজ্যবাদ শিরোমণি আমেরিকার লক্ষ্য একমেরুত্বের চিরস্থায়ী পৃথিবী কার্যকরী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। সামাল দিতে যুদ্ধ, নিষেধাজ্ঞা নামক আর্থিক যুদ্ধাস্ত্র আরোপ, ষড়যন্ত্র, ৮০টি দেশে ৭৫০ সামরিক ঘাঁটি, সামরিক খাতে বিরাট ব্যয়বৃদ্ধি ঘটালেও এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার অভিযান সমস্ত ক্ষেত্রে বিরাট বাধা ও প্রতিরোধের সম্মুখীন হচ্ছে। যেসব দেশকে অনুগত রাখতে সক্ষম হয়েছে, সেখানকার বেশিরভাগ গণতান্ত্রিক ও নিপীড়িত মানুষের যুদ্ধ, আগ্রাসন ও সাম্রাজ্যবাদী একমেরুত্বের অভিযানের বিরুদ্ধে এই সংহতির নতুন নতুন দিক উন্মোচিত হয়।
কোভিড মোকাবিলা
করোনা ভাইরাস গোটা দুনিয়াকে ক্ষয়ক্ষতি ও আতঙ্কে কাঁপিয়ে তুলেছে। শতাধিক বছর আগে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস সংক্রমণের ভয়ঙ্করতায় গোটা দুনিয়া কেঁপে উঠেছিল। তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা, চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণা, চিকিৎসা ও প্রতিষেধক ব্যবস্থা আজকের তুলনায় কার্যত কিছুই ছিল না। অত পরিসংখ্যান ব্যবস্থাও ছিল না। বিভিন্ন হিসাবে বলা হয়, ১৯১৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২ বছরের মধ্যে ২.৫ কোটি থেকে ১০ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়, আক্রান্ত হয়েছিল প্রায় ৫০ কোটি। বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের হয়ে ইয়োরোপে যুদ্ধে যোগদানকারী ভারতীয় সৈনিকরা জাহাজে দেশে ফেরার পর হু হু করে বেড়ে যায় সংক্রমণ। ১ কোটির বেশি ভারতীয়র মৃত্যু হয়েছে - সব হিসেবে ন্যূনতম সংখ্যায় বলা হয়েছে। দারিদ্র্য, দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি, সেসময়ের খরায় কাবু ভারত, ব্রিটিশ শাসকরা তার মোকাবিলায় গা করেনি, ফলে হু হু করে বৃদ্ধি পায় মৃত্যু সংখ্যা। কোনো দেশ এই সংক্রমণ থেকে বাদ যায়নি।
একশ’ বছরে আরও অনেকবার ভাইরাস সংক্রমণ হয়েছে, এত ব্যাপকতা ও তীব্রতা ছিল না। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর গোড়ায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং সংক্রমণ বিশেষজ্ঞরা ভবিষ্যতের সংক্রমণ মোকাবিলায় প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও পরিষেবায় সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে বার বার সতর্ক করে দেয়। নয়া উদারীকরণে প্রায় গোটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, যেখানে বেসরকারি এবং বৃহৎ কোম্পানিগুলির হাতে বিভিন্ন দেশ ঢালাও দিচ্ছে, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও ওষুধ উৎপাদনের যাবতীয় সরকারি ব্যবস্থা বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া হয়, তখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সতর্কবাণীতে কোনো দেশের সরকার আমল দেয়নি। তার জন্য বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও আধুনিক চিকিৎসা ও গবেষণার এত উন্নতি সত্ত্বেও কোভিড-১৯ সংক্রমণে সাধারণ মানুষকে বিরাট মূল্য গুণতে হয়েছে এবং এখনও সেই ক্ষতির প্রভাব চলছে।
বর্তমান দুনিয়ায় অর্থনৈতিক, সামরিক, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির দিক থেকে সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোভিড মোকাবিলায় সবচেয়ে বেশি ব্যর্থ যে, ৩৩ কোটি মানুষের দেশে ৮ কোটি ৫৯ লক্ষ আক্রান্ত এবং দশ লক্ষেরও বেশি মৃত্যু। ব্যর্থতায় এর পরেই মার্কিন প্রশাসনের অনুগত দুই দেশ ব্রাজিল ও ভারত। পশ্চিমের উন্নত দেশগুলিও এক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্টে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ সংক্রমণে প্রকৃত মৃত্যু সংখ্যা ভারতে সরকার - ঘোষিত সংখ্যার চেয়ে আটগুণ বেশি, অর্থাৎ মৃত্যু সংখ্যা ৪০ লক্ষের বেশি, কোনো কোনো হিসেবে ৫০ লক্ষ। বিভিন্ন দেশের সরকারি হিসেবে মৃত্যু সংখ্যা ৬৩ লক্ষ, বিশ্বে কোভিডে প্রকৃত মৃত্যু এই সংস্থার হিসেবে মোট দেড় কোটি। মোদী সরকারের কাজে যেমন বেকারি, দারিদ্র্য, মানবাধিকার লঙ্ঘন, সাম্প্রদায়িকতা ও হিংসাত্মক ঘটনা ইত্যাদি ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার রিপোর্ট ও পরিসংখ্যানকে মোদী সরকার অস্বীকার করার একটা রেওয়াজের মধ্য দিয়ে চলছে। কোভিড মৃত্যুর ক্ষেত্রেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুসৃত পদ্ধতি ত্রুটিপূর্ণ বলে মোদী সরকারের পক্ষ থেকে নিজেদের অপদার্থতা ঢাকার চেষ্টা হয়েছে।
সদ্যোজাত সোভিয়েত ইউনিয়নও মারাত্মকভাবে ফ্লু ভাইরাস সংক্রমণে আক্রান্ত হয়েছিল, বহু মৃত্যু হয়, এমনকী কয়েকজন শীর্ষ নেতাও। দুর্ভিক্ষ ও যুদ্ধের বিরাট ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে বিপ্লব ও এই গ্রহে নতুন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উদ্ভব, যাকে অঙ্কুরেই ধ্বংস করার জন্য ১৪টি সাম্রাজ্যবাদী দেশ সশস্ত্র গৃহযুদ্ধে তখন লিপ্ত। এই যুদ্ধে জয়ী হবার পর অন্যান্য অগ্রাধিকারের মধ্যে সোভিয়েত দেশ প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, দেশের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা পরিকাঠামো পনেরো বছরের মধ্যে ঢেলে সাজায়। যেকোনো ভাইরাস, ব্যাধি ও ভাইরাস সংক্রমণ একারণে মোকাবিলার ক্ষেত্রে নতুন নজির পৃথিবীতে সৃষ্টি করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। চীনের ১৪০ কোটি মানুষের দেশের শূন্য - কোভিড অভিযান প্রায় সফল। মৃত্যুর সংখ্যা এ পর্যন্ত ৫,২৬৬।
কোভিড সংক্রমণের মোকাবিলায়ও সমাজতান্ত্রিক চীন ইতিহাসে নজির তৈরি করেছে, যা স্বীকৃত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও সব দেশে। বেইজিং, সাংহাই সহ বড়ো বড়ো শহরে সর্বশেষ সংক্রমণও নিয়ন্ত্রণে, স্বাভাবিকত্বে আমেরিকার ব্যর্থতা ঢাকতে প্রথমেই তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই ভাইরাসের জন্মদাতা বলে চীনকে গালমন্দ করে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দেয় অর্থ বরাদ্দ বন্ধ করে দেয়, প্রথমে এই সংক্রমণকে আমলই দেয়নি, এমনকী আমেরিকার খ্যাতনামা সংক্রমণ-বিশেষজ্ঞদের পরামর্শও হেলায় উড়িয়ে দিয়েছে। চীনের সাফল্যের সঙ্গে কোনভাবে এঁটে উঠতে না পেরে সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে দিয়ে বলানো হয়েছে, চীনের উহানের পরীক্ষাগার থেকে এই ভাইরাস ছড়িয়ে যাবার বিষয়টি আবার দেখা হবে। এই ষড়যন্ত্রের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে চীন বলেছে, এই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আন্তর্জাতিক সেরা বিশেষজ্ঞরা চীনে এসে সবরকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যে তত্ত্ব ও অভিযোগ বাতিল করেছে, চাপের মধ্যে আমেরিকার রাজনৈতিক মতলব চরিতার্থ করতে এই সংস্থা সেই ডাঁহা মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছে।
এই সংক্রমণ স্তিমিত হবার পর এখন সর্বত্র চতুর্থ তরঙ্গের প্রভাব পড়ছে, তীব্রতা এখনও অপরিজ্ঞাত। কবে ইতি ঘটবে, তারও কোনো দিশা দিতে পারছেন না বিশেষজ্ঞরা। ২০২০-২০২১ সালে সব দেশে লকডাউন হয়েছে সংক্রমণরোধে, কিন্তু প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবার কাঠামোর কোনো পরিবর্তন ঘটায়নি, বরাদ্দও দেয়নি, সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার নিতান্তই অপ্রতুল অবস্থারও কোনো উন্নতি ঘটায়নি।
ইতিমধ্যে টিকা আবিষ্কৃত হয়েছে। সেটা নিয়ে চলছে লালে লাল হবার করপোরেট ব্যবসা। দুনিয়ার বহু মানুষ অর্থের অভাবে এই সুযোগ থেকেও বঞ্চিত। চীন এক্ষেত্রেও বিভিন্ন দেশের কাছে সৃষ্টি করেছে প্রশংসনীয় নজির। সব দেশে এই টিকা বিনামূল্যে সর্বজনীন করার বিশ্বজনীন দাবিও অগ্রাহ্য হয়েছে।
কলম্বিয়ার নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি গুস্তাভো পেত্রো এবং উপ-রাষ্ট্রপতি ফ্রান্সিয়া মার্কেজ।
১২-১৭ জুন সুইৎজারল্যান্ডের জেনেভায় বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মন্ত্রী পর্যায়ের সভায় এই টিকার মেধাস্বত্ব অধিকার পাঁচ বছরের জন্য স্থগিত রাখার গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের বড়ো অংশীদার চীন। ২০২০ সালের মে মাসেই ঘোষণা করেছিল উন্নয়নশীল দেশগুলির টিকার সহজলভ্যতা সুনিশ্চিত করবে চীন। ১২০টি দেশে এবং বহু আন্তর্জাতিক সংস্থাকে চীন ২২০ কোটি ডোজ কোভিড-১৯ টিকা দিয়েছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার এই সিদ্ধান্ত এই সহায়তা বাড়াতে আরও সাহায্য করবে। আমেরিকা এখনও ডুবে আছে আত্মসন্তুষ্টিতে, শিথিল সংক্রমণরোধ ব্যবস্থা এই ভাইরাসের ওমিক্রন বৈশিষ্ট্যেও। অথচ যত মৃত্যু, তার মধ্যে রয়েছে ৪০ ভাগ পুরোপুরি টিকাগ্রহীতা। বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তনের বর্ধমান বিপদ, পারমাণবিক অস্ত্রের ঝুঁকি, কোভিড-১৯ সংক্রমণ প্রতিরোধ ইত্যাদি গুরুতর বিশ্বজনীন সমস্যায় যে সংহতি জরুরি, আমেরিকা ও সাম্রাজ্যবাদীরা মুখে যা-ই বলুক, কাজে তার সম্পূর্ণ বিপরীত। অপছন্দের দেশ এবং অপছন্দের শাসক হলে তাদের বিরুদ্ধে চরম শত্রুতা থেকে একচুলও নড়চড় নেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। তার জন্য ব্যবহৃত গোটা মিডিয়া। ঘরে বাইরে একারণে মার্কিন প্রশাসনকে ক্রমবর্ধমান প্রতিবাদ, সমালোচনা ও বিরোধিতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। আমেরিকা তার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে প্রকৃত অর্থে মিত্রদেরও কোনো দেশের আস্থা-বিশ্বাস জন্মাতে পারছে না।
অন্য সংক্রমণ
বর্ণবিদ্বেষী-ঘৃণা সৃষ্টির গোষ্ঠী এবং এ সম্পর্কিত অপরাধ গত ২০ বছরে আমেরিকায় বেড়েছে দ্বিগুণ, ট্রাম্প প্রশাসনের সময়ে বেড়েছে বেশি। এটাও এখন সংক্রমণ। আমেরিকার অভ্যন্তরে এক মেরুতে পুলিশি নিপীড়ন এবং চরম দক্ষিণপন্থী, শ্বেতাঙ্গ-শ্রেষ্ঠত্বের রাজনীতি ও বর্ণবিদ্বেষী হামলার দাপট বাড়ছে, বাড়ছে প্রতিদিন অবাধে বন্দুকের ব্যবহার ও নিরাপত্তাহীনতা। অন্যদিকে বিপরীত মেরুতে মানবাধিকার, জীবনজীবিকা ইত্যাদি নানা দাবিতে বিভিন্ন অংশের মানুষের প্রতিবাদ-বিক্ষোভও বাড়ছে। দেড় দশকের মন্দা, চার দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, সামাজিক সুরক্ষায় বড়ো রকমের কাটছাঁট, উচ্চহারে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্যবৃদ্ধি, যুদ্ধ ও দেশে দেশে যুদ্ধজনিত নিষেধাজ্ঞা, বহু সমস্যায় প্রশাসন জর্জরিত। শাসকদলের মধ্যেও গোলমাল। বছরের শেষে নভেম্বরে প্রতিনিধিসভা ও সেনেটের নির্বাচন্, প্রাক্-সমীক্ষায় বিপাকে শাসকদল। বন্দুকে গণহত্যার উপর্যুপরি ঘটনার বিরুদ্ধে দেশজুড়ে বিক্ষোভের জেরে সরকারি উদ্বেগ ছাড়া আর কিছু নেই। এরই মধ্যে বন্দুক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার আইনি সংশোধন নিয়ে মার্কিন কংগ্রেসে অচলাবস্থা, দৈত্যাকার বন্দুক ব্যবসাকে চটাতে সবসময় অক্ষম এই ব্যবসার পৃষ্ঠপোষক প্রশাসন।
চতুর্দিকে বিড়ম্বনা
২০২০ সাল থেকে আমেরিকাকে ছাড়িয়ে ইয়োরোপিয়ান ইউনিয়নের সবচেয়ে বড়ো বাণিজ্যিক শরিক চীন। চাপেই ইয়োরোপিয়ান মিত্ররা আমেরিকার সঙ্গে আছে, অল্পবিস্তর মতভেদও মাঝেমধ্যে প্রকাশ করে যেমন ইরান, চীন ইস্যুতে। ইউক্রেন নিয়েও অনেকে অস্বস্তিতে। ষোল বছর, বিশেষত গত আটবছর ধরে ইউক্রেনকে সামনে দাঁড় করিয়ে রাশিয়াকে কর্তৃত্বের আঘাতে জব্দ করতে গিয়ে এখন ইউক্রেন যুদ্ধে বাইডেন প্রশাসন উভয় সঙ্কটে। সামরিক জোট ন্যাটোকে আমেরিকা সাময়িকভাবে একসঙ্গে রেখে দিয়েছে, ইয়োরোপীয় ইউনিয়নকেও শাসানিতে কঠোর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা হয়েছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে আর্থিক নিষেধাজ্ঞা ও অবরোধ বাড়ানোর ব্যর্থতা এবং নিজেদের হাসফাঁস দশা এখন প্রকট। রাশিয়ার তেল ও গ্যাসের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল ইয়োরোপ যুদ্ধের এই দীর্ঘসূত্রতায় সঙ্কটে কাঁপছে। সব দেশ গমের জন্য সঙ্কটে, কারণ গমের মূল সরবরাহকারী রাশিয়া, এরপর ইউক্রেন। বিশ্বব্যাঙ্ক আসন্ন ‘মন্দা ও মুদ্রাস্ফীতি’ বিষয়ে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছে। তেল ও গ্যাসোলিনের দাম সর্বত্র বেড়েছে, আমেরিকায় চড়া হারে। আমেরিকানরা নিরাপত্তা,আর্থিক সমস্যা, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা, কর্মসংস্থান ইত্যাদি নিয়ে ভুগছে, অথচ ইউক্রেনের জন্য আমেরিকা ২০১৪ সাল থেকে প্রতি বছর প্রায় ৪২ কোটি ডলারের অস্ত্র ও নানা সাহায্য করছে, ৫,৫০০ কোটি ডলার সামরিক ও অন্যান্য সহায়তার কর্মসূচি নিয়েছে। রাশিয়াকে টেনে যুদ্ধে যেতে বাধ্য করার পর ১১ মার্চ দিয়েছে ১,৩৬০ কোটি ডলার, এছাড়াও ঢালাও পাঠানো চলেছে সরাসরি ও নানা এজেন্সি মারফত অর্থ, অস্ত্র, বহুবিধ সামরিক সাহায্য, সবই মার্কিন নাগরিকদের অর্থে।
ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়ার যুদ্ধে মার্কিনী বিপর্যয়ের পর হীনবল ভেবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার কড়া মাশুল গুণতে হচ্ছে আমেরিকাকে। শাঁখের করাত - চালাতেও পারছে না, রাশিয়ার ওপর আর্থিক নিষেধাজ্ঞাও তুলতে পারছে না, আবার আফগানিস্তান যুদ্ধের মতো কেঁদে বাঁচি বলে ছেড়ে বেরিয়েও আসতে পারছে না। ন্যাটো, ইয়োরোপীয় ইউনিয়নকে তাতিয়ে যুদ্ধ বাধিয়ে বিপাকে পড়ে ইউক্রেনের নয়া-নাৎসি অধীনতার ইউক্রেন সরকারকেও বলতে পারছে না যে, যেমন হেনরি কিসিঞ্জারের পরামর্শ, যা হয়েছে তার ওপর রাশিয়ার সঙ্গে মিটমাট করে নাও; রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা তাতে উঠবে, ডলারের এখনকার বিপদ কাটবে, দরদাম ঠিক থাকবে; তেল, সার, জ্বালানি ও খাদ্যের সঙ্কট কমবে, আমেরিকা ও ইয়োরোপের যুদ্ধের খরচও কম হবে, শান্তি প্রতিষ্ঠায় ও ক্ষয়ক্ষতি বন্ধের উদ্যোগের জন্য আমেরিকা তার-পক্ষে-বিরল-কৃতিত্বও এই মওকায় প্রচার করতে পারবে। কিন্তু সেই বাস্তবতা পদদলিত করার ফল ভোগ করতে হচ্ছে দুনিয়াকে, আমেরিকাকেও। যুদ্ধের চারমাসে ইউক্রেন খুবই বিপদ্দশায়। সোচনীয় হার কমাতে আরও অস্ত্র, আরও অর্থ ভিক্ষা করছে ঘুরিয়ে আমেরিকার কাছে। শুরু হয়েছে দোষ চাপানোর পালা। স্বয়ং প্রেসিডেন্ট বাইডেন গোড়ায় সতর্কবার্তা না শোনার জন্য ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টকে দায়ী করেছেন। এই যুদ্ধে বেশিরভাগ মানুষ ও জনবহুল চীন, ভারত সহ প্রায় অর্ধেক দেশ আমেরিকার পক্ষে নেই। ধ্বংস রোধ এবং শান্তির জন্য, মুদ্রাস্ফীতিসহ খাদ্য ও তেলের দাম কমানোর জন্য যুদ্ধকে প্রশমিত ও মিটমাট করে আনার বদলে উলটে একচ্ছত্র স্বেচ্ছাচারী সৌদি আরবে প্রেসিডেন্ট বাইডেন ছুটে গেলেন, তেলের দাম কমানো এবং রাশিয়াকে তেল দুনিয়া থেকে কোণঠাসা করার জন্য রাজি করাতে। সৌদি আরব নিজের আর্থিক বিপাকের ভয়ে রাজি হয়নি। দেশেও বাইডেনের সমালোচনা - কেন তিনি ভিক্ষার জন্য স্বৈরতন্ত্রী সৌদি আরব ছুটলেন!
তিনমাস আগে ন্যাটো এবং ইয়োরোপীয় ইউনিয়নের সদর দপ্তর বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে বিক্ষোভে দাবি উঠেছিল - রাশিয়ার তেল আমদানি বন্ধ করো, রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা বাড়াও। গত ২০ জুন এখানেই ট্রেড ইউনিয়নের ডাকে ৮০ হাজার মানুষের বিক্ষোভে দাবি ওঠে, মজুরি বৃদ্ধিতে খরচ করো অস্ত্রে নয়, বন্ধ করো ন্যাটো। লন্ডন ও ইয়োরোপের অন্যান্য শহরেও দাবির মুখ এভাবে ঘুরে গেছে।
চীনের দুই জাহাজ তত্ত্ব
ভিডিও সংযোগে গত নভেম্বরে চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে একান্তে কথা বললেন বাইডেন। আনুষ্ঠানিক ভালোই আলোচনা হয় যাতে দু‘দেশের মধ্যেকার বিরোধের পরিণামে উভয় দেশ এবং দুনিয়ায় যেন বিপর্যয় না হয়।
সভায় চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং চীন-মার্কিন সম্পর্ককে সমুদ্রে চলমান দুই বৃহৎ জাহাজের সঙ্গে তুলনা করে বলেছিলেন যে: "দু'পক্ষেরই জাহাজের হাল শক্ত করে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যাতে দুটি জাহাজ ঢেউ ভেঙে দিক এবং গতি না হারিয়ে এগিয়ে যেতে পারে, জাহাজে কারো সঙ্গে কারোর সংঘর্ষ না হয়। দুটি জাহাজের নিরাপদ পরিক্রমার জন্য পারস্পরিক মর্যাদা, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং উভয়ের জয়ের জন্য সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ নীতি হিসেবে থাকবে। কিছু উত্থান-পতন সত্ত্বেও মোটের উপর দু'দেশের সম্পর্ক দুটি দেশেরই উন্নতি ঘটিয়েছে এবং পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক হয়ে ওঠে। দুই জাহাজের সংঘর্ষ এড়াতে উভয়পক্ষ উভয়ের সামাজিক ব্যবস্থা ও বিকাশের পথকে সম্মান দেবে। দু'পক্ষেরই উচিত কোনো বিরোধ বা মোকাবিলার লাইন না নেওয়া। ৫০ বছরের এই সম্পর্কে দুটি দেশ এবং গোটা দুনিয়া উপকৃত হয়েছে। শান্তিপূর্ণ আন্তর্জাতিক পরিবেশ বজায় রাখতেও এই সম্পর্ক প্রয়োজন। তাহলে জলবায়ু পরিবর্তন, কোভিড-১৯ অতিমারীর মতো বিশ্বব্যাপী চ্যালেঞ্জের কার্যকরী সমাধানের পথে যাওয়া সম্ভব হবে। সহযোগিতাই দুই জাহাজের এগিয়ে যাওয়ার একমাত্র লাইন। পারস্পরিক উপকারের জন্য দ্বিপাক্ষিক বিকাশের উৎস হল দুটো জাহাজই যেন গতি না হারায়। পৃথিবীর আর্থিক সমৃদ্ধির অর্ধেকই তৈরি করে এই দুই দেশ। দু'দেশের মধ্যে মতপার্থক্য হওয়া স্বাভাবিক। গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে তা যেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে না যায় অর্থাৎ দুটি জাহাজের সংঘর্ষের অবস্থা যেন তৈরি না হয়। তাইওয়ান, হংকং, তিব্বত, সিনজিয়াঙ এবং সামুদ্রিক সীমানার ইস্যু চীনের সার্বভৌমত্বেরই প্রশ্ন। এসব মূল মূল বিষয়ে আপসের কোনো স্থান নেই এবং বাইরের শক্তির হস্তক্ষেপ চীন কখনোই মেনে নেবে না। পারস্পরিক ভুল বোঝাবুঝি এবং ভুল হিসেব-নিকেশ কমানো অপরিহার্য যাতে দুটি বৃহৎ জাহাজ একে অপরের মধ্যে ভেঙে ঢুকে পড়তে না পারে। দুনিয়াকে বিভিন্ন শিবির বা প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীতে ভাগ করলে গোটা দুনিয়া ভুগবে। যা-ই হোক, পৃথকভাবে ও যৌথভাবে বিকাশের জন্য আমেরিকা-চীন দু'দেশের কাছেই দুনিয়াটা বিরাট বড়ো।"
প্রেসিডেন্ট বাইডেনও সহযোগিতার কথা বলেছেন কিন্তু গত মে মাসে এশিয়া সফরে চীনের বিরুদ্ধে একই অভিযোগের পুনরাবৃত্তি করলে চীন তা শতাব্দীর সেরা মিথ্যা চার আখ্যা দেয়।
বাইডেনও প্রকৃত অবস্থান আড়াল করে বলেছেন। পরে এ পর্যন্ত অন্য সুর। চীন রাশিয়ার বিরুদ্ধে যায়নি, ইউক্রেনকেও দোষারোপ করেনি। উল্টে চীনা প্রবাদ দিয়ে পরোক্ষে আমেরিকাকে অনেকটা দুষে বিদেশমন্ত্রী বলেছেন, তিনফুট বরফ জমতে একটা শীতল দিনের বেশি দিন দরকার হয়। অর্থাৎ অনেকদিনের ঘটনার পরিণামে এই যুদ্ধ।
বাইডেন নানাভাবে চাইলেন, ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার বিরুদ্ধে চীনকে অবস্থান নিতে, সেখানে জোর ধাক্কা খেলেন। মার্কিন-বিশ্বস্ত ভারতকেও রাশিয়ার বিরুদ্ধে বাগে আনার চেষ্টা করে অসফল, কারণ রাশিয়ার সহায়তা বন্ধ হলে ভারতের সমূহ সমস্যা।
বাইডেনের চীনাতঙ্ক রোগ
চীনের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে চীন-বিরোধী সামরিক জোট জাপান-ভারত-অস্ট্রেলিয়া-আমেরিকা সভা করতে মে মাসের শেষ সপ্তাহে জাপান ছুটে গেলেন বাইডেন। টোকিও শহরে আমেরিকা-বিরোধী বিক্ষোভের মধ্যে সভা হয়, অস্ট্রেলিয়ায় সরকার পরিবর্তন হতে যাচ্ছে, আমেরিকার প্রস্তাবে তারা দ্বিধাগ্রস্ত। দক্ষিণ কোরিয়া ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক খুব উন্নত। এটাতে হাত দিতে সাহস করেননি বাইডেন, দক্ষিন কোরিয়াকে চীনের বিরুদ্ধে সরব করতে ব্যর্থ। সিওলে ২৩ মে বাইডেন দুর্ভেদ্য নিরাপত্তায় গ্র্যান্ড হায়াত হোটেলে তিনি ছিলেন, কিন্তু বাইরে কয়েক হাজার মানুষের বিক্ষোভ চলে। এই দুই দেশের বিভিন্ন সংগঠন মার্কিন সামরিক ঘাঁটি ও পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েনের বিরুদ্ধে এবং দীর্ঘকাল থেকে আমেরিকার যুদ্ধ-নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ সংগঠিত করে আসছে। এশিয়ার ওপর কতৃত্ব এবং চীনকে আটকে রাখতে চীন-বিরোধী আর্থিক নিষেধাজ্ঞা, অন্যান্য চাপ, চীন-বিদ্বেষী কুৎসা ও পদক্ষেপগুলি ট্রাম্প জমানার পর প্রেসিডেন্ট বাইডেন অনেক বেশি বাড়িয়ে চলেছেন। নিজেদের নাক কেটে হলেও চীনকে আটকানোই এখন আমেরিকার মূল বিদেশনীতি।
বাইডেন ও তাঁর বাহিনীর মুখে সর্বক্ষণ চীন চীন চীন - যেন চীনের ভূত দেখছে সকলে। আমেরিকার কাছে একটার পর একটা চীনের ওপর নিষেধাজ্ঞার পদক্ষেপ যেন বুমেরাং হয়ে ফিরছে। ওইসব নিষেধাজ্ঞায় অসুবিধা হলেও চীনকে কাবু করা যায়নি। চীনে ‘মানবাধিকার’-এর প্রশ্ন তুলে চীন থেকে দূষণহীন সৌরবিদ্যুৎ কোষ বা সোলার মডিউল আর নেবে না এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকেই নেবে বলে মার্কিন প্রশাসন ঘোষণা করেছে। চীনা মডিউলগুলি কিনেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি পুনরায় তা বর্ধিত দামে বিক্রি করছে। এরকম নানা বিষয় ঘিরে প্রশ্ন উঠছে আমেরিকায়। ‘মানবাধিকার’-কে আমেরিকার একচেটিয়াকরণের বিরুদ্ধে চীন অবিরত তীর নিক্ষেপ করে যাচ্ছে। উত্তর নেই আমেরিকার।
তাইওয়ান নিয়ে জলঘোলা
১৯৪৯ সালে চীন বিপ্লবের সময় উৎখাত শাসক চিয়াং কাইসেক সৈন্য সামন্ত নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় চীন ভূখণ্ডের দ্বীপ ফরমোজা বা তাইওয়ানে আশ্রয় নেয়। ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রসঙ্ঘ চীনকে স্বীকৃতি দিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য করতে বাধ্য হয় এবং তাইওয়ানের প্রতিনিধিকে রাষ্ট্রসঙ্ঘ থেকে অপসারণ করা হয়। ১৯৪৯ সাল থেকে আটকে রেখে ১৯৭১ সালে প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার চীনের পূর্ণ কূটনৈতিক স্বীকৃতি দিয়ে তাইওয়ানকে চীনের অংশ হিসাবে মেনে নিয়ে ‘এক চীন’ নীতি ঘোষণা করেন। এই নীতি বজায় রেখেই সম্পর্কে কাঁটা দিতে কয়েকমাস পর মার্কিন কংগ্রেস তাইওয়ানকে ‘আত্মরক্ষামূলক অস্ত্রসাহায্য’ করবে বলে আইন পাশ করে। সেই থেকে এ প্রশ্নে চীন-মার্কিন বিরোধ। বাইডেন প্রশাসন কখনও ‘এক চীন’ নীতির কথা বলে, কখনও এ প্রশ্নে চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধেরও হুমকি দেয়। সর্বশেষ ১০ জুন অস্বস্তিকর ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে দৃষ্টি বা ফোকাস সরিয়ে চীনের ওপর নিবদ্ধ করতে তৎপর মার্কিন প্রশাসন তাইওয়ান এবং ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় চীনকে কোণঠাসা করার ওপর বেশি জোর দিচ্ছে।
১০ জুন সিঙ্গাপুরে একটি সভার সময় আমেরিকা ও চীনের প্রতিরক্ষা সচিবের সঙ্গে একান্ত আলোচনায় মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব লয়েড অস্টিন খানিকটা হুমকির সুরেই তাইওয়ান নিয়ে চীনকে আর-না-এগুতে বললে চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী কড়া ভাষায় প্রকাশ্যে তার জবাব দেন; ‘তাইওয়ান স্বাধীনতা ঘোষণা করলে চীন যুদ্ধ শুরু করতে ইতঃস্তত করবে না; কেউ যদি তাইওয়ানকে চীন থেকে বিচ্ছিন্ন করে নেবার ঔদ্ধত্য দেখায়, যে মূল্যই হোক চীন তার সামরিক জবাব দেবে; তাইওয়ানের স্বাধীনতার চক্রান্ত হলে সেই চক্রান্ত চীন গুঁড়ো গুঁড়ো করে দিয়ে চীনের ভূখণ্ডের একীকরণ দৃঢ়ভাবে রক্ষা করবে; তাইওয়ান চীনেরই... চীনকে আটকানোর জন্য তাইওয়ানকে ব্যবহার করা কখনই বরদাস্ত করা হবে না।’’ তার আগে জাপান সফরের সময় প্রেসিডেন্ট বাইডেন হুঁশিয়ারি দেন যে, চীন তাইওয়ান আক্রমণ করলে আমেরিকা সামরিকভাবে তাইওয়ানকে রক্ষা করার জন্য দাঁড়াবে; আবার এটাও বলেছেন, আমেরিকার ‘এক চীন নীতি’ থেকে তাঁর প্রশাসন সরে যাচ্ছে না। এই দ্বিচারিতা শক্তিধর আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের সমস্যা-জর্জর অবস্থানের পরিচয়।
চীনের বিরুদ্ধে আমেরিকার সর্বাত্মক ছক ও অভিযান পৃথিবীর সবাই মেনে নিতে পারছে না, মার্কিনী চাপে ন্যাটো চীনকে ‘নিরাপত্তার হুমকি’ হিসাবে বর্ণনা করেছে। কিন্তু অন্যান্য দেশ ছাড়াও ইয়োরোপের শীর্ষ দেশগুলি আমেরিকার সঙ্গে যে সম্পূর্ণ একমত নয় সেটাও প্রকাশ্যে আসছে। বিনিয়োগ, বাণিজ্য ছাড়াও নতুন নতুন মহাকাশ বিজ্ঞান ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনে সমাজতান্ত্রিক চীন সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার সঙ্গে সমানে সমানে পাল্লা দিচ্ছে, কখনও কখনও টেক্কাও দিচ্ছে। এজন্য আমেরিকার বিশ্ব আধিপত্যের সামনে চীনকে তারা বাধা বলেই ধরে নিয়েছে। পশ্চিমী মিডিয়াগুলিতে চীন-বিরোধী প্রচার তীব্র করা হয়েছে, আড়াল করা হচ্ছে দু’শো বছর ধরে বিশেষত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিভিন্ন দেশে আমেরিকার একতরফা হস্তক্ষেপ, আগ্রাসন ও যুদ্ধনীতি। লাতিন আমেরিকার প্রায় একই সুর - ঘড়ি ওল্টানো যাবে না। তারা দ্বিতীয় স্বাধীনতার প্রয়াসী।
আমেরিকা মহাদেশের শীর্ষ প্রধানদের ব্যর্থ সম্মেলন
উত্তর, দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকা এবং ক্যারিবিয়ান দেশগুলির মধ্যে ঐক্যসাধনের মধ্যদিয়ে ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্কটময় ভাবমূর্তি মেরামতির জন্য একবছর ধরে বাইডেন প্রশাসন চেষ্টা করে আসছে। কোভিড পরিস্থিতির জন্য এই দেশগুলির প্রধানদের সম্মেলন দু’বছর হয়নি, ৯ম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ৬-১০ জুন লস এঞ্জেলেস শহরে, যেখানে লাতিন আমেরিকার মানুষের বসবাস বেশি।
এই নবম সম্মেলনের আহ্বায়ক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। এ ধরনের সম্মেলনের প্রথম আয়োজন হয় ১৯৯৪ সালে - পৃথিবীতে সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের পরে এবং বিশ্বশক্তির ভারসাম্য পুরোপুরি আমেরিকাসহ সাম্রাজ্যবাদীদের অনুকূলে পরিবর্তনের পর। বিশ্বের অপ্রতিদ্বন্দ্বী অধিপতি হিসেবে আমেরিকার তৎপরতা তখন থেকে প্রেসিডেন্ট ক্লিন্টন প্রশাসনের সময় শুরু হয়েছে যুগোস্লাভিয়া ও পূর্ব ইয়োরোপে। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামিতে এই সম্মেলন করেন বিশ্বে ও আমেরিকা মহাদেশে অপ্রতিদ্বন্দ্বী মার্কিন আধিপত্যের আবহাওয়ায়।
পরিযায়ী সমস্যা, কোভিড মোকাবিলায় পরবর্তী সম্মেলনের আগে স্বাস্থ্যব্যবস্থা মজবুত করা, জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ, ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস এবং সহযোগিতার বিষয়গুলি গুরুত্বপূর্ণ হলেও শেষ পর্যন্ত কোনটাই গুরুত্ব পায়নি। সম্মেলনের প্রাক্কালে নিকারাগুয়া, কিউবা, ভেনেজুয়েলাকে না ডাকা নিয়ে বিভিন্ন দেশ ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকে, এই ক্ষোভের মধ্যে বিপর্যয়ের ছাপ নিয়ে সম্মেলন সমাপ্ত হয়। মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট বাইডেন প্রশাসনের পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও তিনটি দেশকে না ডাকার জন্য প্রতিবাদ জানিয়ে সম্মেলন বয়কট করেছেন। একই ক্ষোভে হন্ডুরাস, গুয়াতেমালা, এল সালভাদোর, বলিভিয়া ও কয়েকটি ক্যারিবিয়ান দেশের প্রধানরা উপস্থিত হননি। লাতিন আমেরিকার সঙ্গে অনৈক্য - এরকম দুর্বিপাকে পড়ে লাতিন আমেরিকার সবচেয়ে বড়ো দেশ ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট, ট্রাম্প-ভক্ত কুখ্যাত বোলসোনারোর শরণাপন্ন হন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। সম্মেলনে রওনা হবার আগে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট সংবাদমাধ্যমে বলে যান, ট্রাম্পের কাছ থেকে প্রেসিডেন্ট বাইডেন জয় চুরি করে নিয়েছেন। ব্রাজিলে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আসন্ন, বোলসোনারোর পরাজয়ের বিষয়ে সব মিডিয়ার সমীক্ষা প্রায় নিশ্চিত। সেজন্য ট্রাম্পের মতো ব্রাজিলের এই ট্রাম্প-ভক্তও নির্বাচন পদ্ধতির ত্রুটি নিয়ে এখনই প্রচার শুরু করেছেন, যাতে ফলাফলের পর ট্রাম্পের মতো গোলমাল বাঁধানো যায়। অস্বস্তিকর বুঝেও বাইডেন পৃথক আলোচনা করার আশ্বাস দিয়ে তাঁকে নিয়ে এলেও ব্রাজিল প্রেসিডেন্ট তাঁর বাইডেন-বিরোধী অবস্থান থেকে একচুলও সরেননি।
সম্মেলনের পর আর একটি মোক্ষম জবাব। ৫ কোটি মানুষের কলম্বিয়া রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ১৯ জুন বামপন্থী প্রার্থীকে জয়ী করে নতুন ইতিহাস তৈরি করেছে এবং সমুচিত জবাব দিয়েছে আমেরিকার লুট ও আগ্রাসী নীতির। ৬০ বছর ধরে সশস্ত্র উপায়ে নানা সংগঠন মার্কিনপুষ্ট অত্যাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াই করে অনেক আত্মত্যাগ করেছে। নিহত হয়েছে ২লক্ষ ৬১ হাজার, তার মধ্যে ২লক্ষ ১৪ হাজার সাধারণ মানুষ, গৃহচ্যুত হয়েছে ৫০ লক্ষেরও বেশি মানুষ। এই জয় গোটা লাতিন আমেরিকাকে উদ্বুদ্ধ করেছে। জয়ী প্রার্থী সর্বপ্রথম সম্মান জানান কলম্বিয়ার বিশ্ববন্দিত লেখক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মারক্যুইজকে, স্মরণ করেন তাঁর অসাধারণ সৃষ্টি বইটির ‘One Hundred Years of Solitude’।
একসময়, গত দেড়শো বছর ধরে লাতিন আমেরিকার ও মধ্য আমেরিকার ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বময় আধিপত্য মার্কিন প্রশাসনের সুরক্ষায় থেকে মার্কিন কোম্পানিগুলি লুট করেছে সেখানকার সব প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদ এবং নৃশংস শোষণ ও অত্যাচার করে জনগণের ওপর। কলম্বিয়া তার অন্যতম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত ও কমিউনিস্ট জুজু দেখিয়ে মার্কিন প্রশাসন সব নির্বাচিত সরকারকে ষড়যন্ত্রে ও সামরিক হস্তক্ষেপে উৎখাত করে সেখানে তাঁবেদার দানবীয় সরকার বসায়। খুন হয় বিভিন্ন দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ। এই দগদগে ক্ষত শুকোবার নয়। অনেক আগেই নয়া-উদারীকরণে আমেরিকার প্রথম পরীক্ষাগার ছিল দক্ষিণ আমেরিকা। ১৯৮০-তে চরম আর্থিক দুরবস্থার সময়, ভয়াবহ কোভিড সংক্রমণের মোকাবিলায় আমেরিকা তাদের পাশে দাঁড়ায়নি। এখন ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, চিলি, পেরুসহ বিভিন্ন দেশের মূল বাণিজ্য শরিক চীন। মধ্য আমেরিকাতেও। মার্কিন প্রশাসনের আতঙ্ক তাতে বাড়ছে। সম্মেলনেও তা উচ্চারিত। আমেরিকার দেশগুলিও মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে মার্কিন প্রশাসন থেকে। ৩৫টি দেশের মধ্যে ২৩টি দেশের প্রধানরা উপস্থিত ছিলেন, অনেকেই ক্ষোভ উগড়ে দেয় তিনটি দেশকে না ডাকার জন্য। সবচেয়ে বেশি সরব হয় আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট। ক্ষুদ্রতম দেশ বেলিজ-ও আমেরিকার বিরুদ্ধে সম্মেলনে উগরে সব ক্ষোভ ও জ্বালা।
২০০৯ সালের এপ্রিলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় আসার পর ওবামার উপস্থিতিতে ত্রিনিদাদে অনুষ্ঠিত আমেরিকার দেশগুলির সম্মেলনে ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো সাভেজ ওবামার হাতে তুলে দেন ১৯৭১ সালে প্রথম প্রকাশিত একটি বই যার শিরোনাম বাংলা তর্জমায় দাঁড়ায় ‘‘লাতিন আমেরিকার অনাবৃত শিরা: একটি মহাদেশের ওপর পাঁচ শতাব্দীর লুণ্ঠন’’ (Open Veins of Latin America: Five Centuries of the Pillage of a Continent) লেখা উরুগুয়ার এক সাংবাদিকের - এডুয়ার্ডো গালিয়েনো। তিনি এখন বিখ্যাত লেখক সাহিত্যিক। সাভেজের বর্ণনায়, এটি লাতিন আমেরিকার প্রকৃত ইতিহাসের অক্ষয় মনুমেন্ট। চিলি, আর্জেন্টিনা, কলম্বিয়া, উরুগুয়াতে সামরিক শাসন তখন বইটি নিষিদ্ধ করে লেখককে জেলে পুরেছিল। অনেক নির্যাতনেও তিনি ছিলেন অচঞ্চল, দেশ-বিদেশ থেকে আজীবন পেয়েছেন অজস্র সম্মান। সাভেজের বই উপহারের পর ২২টি ভাষায় ২০ লক্ষ এই বই বিক্রি হয়। ২০১৪ সালে মর্যাদার শীর্ষে লেখক প্রয়াত হন। বইতে অনাবৃত শিরার ব্যাখ্যা - সোনা-রূপা-কোকো-ফল- তুলা-রবার-কফি-তেল-লোহা-নিকেল-ম্যাঙ্গানিজ-তামা ও নানা খনিজ সম্পদ যা ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদীরা লুট করেছে।
বহুমেরুত্বের অনিবার্য চ্যালেঞ্জ
সেজন্য, এই মনুমেন্টের সামনে মাথা উঁচু করে কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্টের দাঁড়ানোর সাধ্য হয়নি। ইয়োরোপের ঔপনিবেশিকদেরও একই দশা।
লাতিন আমেরিকা, মধ্য আমেরিকার মানুষ পুঁজির আদিম এই সঞ্চয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই বর্বরতা, লুট, হত্যাকাণ্ডের কথা কখনই ভুলবে না, তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে নবম সম্মেলনে।
দুনিয়া এক জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই, অধিপতি তথা বিশ্ব পুলিশের ভূমিকায় অবতীর্ণ আমেরিকা যেভাবে চাইছে সেইভাবে ঘুরছে না। হিমসিম খাচ্ছে পুঁজিবাদের কাণ্ডারী ও তাদের পণ্ডিতরা। স্বস্তি ও সংস্কারের কোনো ওষুধ কাজ করছে না, ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য মারাত্মক বেড়েই চলেছে। তাতে কোনো হাত পড়ছে না। ২০০৮ সাল থেকে টানা পরপর বিশ্ব আর্থিক সঙ্কট থেকে পরিত্রাণের কোনো কার্যকরী সুরাহা কেউ দেখাতে পারছে না। বর্তমান চরম দক্ষিণপন্থী, সন্ত্রাসবাদ, মৌলবাদ, নয়া নাৎসিবাদ, ধর্মোন্মত্ততা, যুদ্ধ-সংঘর্ষ তারই ফলশ্রুতি; এই বিধ্বংসী ব্যুহ না ভেঙে মার্কিন প্রশাসন সাম্রাজ্যবাদী অভীষ্টে এই বৃত্তেই আবদ্ধ হয়ে সঙ্কট বাড়িয়ে তুলছে যখন তার একমেরুত্ব চ্যালেঞ্জহীনতা থেকে এখন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন।