আরব দুনিয়ায় আবার সাংবাদিক হত্যা
লালন ফকির
আল জাজিরা পত্রিকার সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহ’র হত্যা, পুনরায় আরব দুনিয়ার রাজনৈতিক মহলে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। গত ১১ মে ইজরায়েল সেনাবাহিনী কর্তৃক প্রবীণ প্যালেস্তিনীয় সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহ নিহত হন। এই ঘটনা পুনরায় আরব দুনিয়ায় ইজরায়েলি সেনাবাহিনীর মানবাধিকার বিরোধী কার্যকলাপের স্বাক্ষর বহন করে চলেছে। এই হত্যাকাণ্ড মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নৃশংস অত্যাচার উন্মোচন করেছে। নিহত সাংবাদিক শিরিন একজন সম্ভবত মার্কিন নাগরিক, আলজাজিরা প্রচার মাধ্যমের টেলিভিশনে কর্মরত ছিলেন। কাতার তাঁর কর্মস্থল ছিল এবং ১৯৯৭ সাল থেকে তিনি বর্তমান কর্মস্থলে কাজ করেছেন। এক বেতার বার্তায় তিনি জানিয়েছিলেন যে, তিনি তাঁর ভয়ভীতি অতিক্রম করেছেন এবং সাহসের সাথে তিনি কাজ করে চলেছেন। ফলে এখন তিনি জনগণের দুঃখদুর্দশার প্রকৃত চিত্র বিশ্বের নিকট তুলে ধরতে সক্ষম হচ্ছেন।
আন্তর্জাতিক প্রায় সব প্রচার মাধ্যমেই প্যালেস্তিনীয় এই সাংবাদিকের হত্যাকাণ্ডের সংবাদ বিশেষ মর্যাদা দিয়ে প্রচার করা হয়। ইজরায়েলি সেনাবাহিনীর দ্বারা আলজাজিরা সাংবাদিকের হত্যাকাণ্ডকে ‘নৃশংস’ ‘অমানবিক’ বলে চিহ্নিত করে একে প্যালেস্তিনীয়দের পিতৃভূমি ফিরে পাওয়ার লড়াই বলে বিভিন্ন দেশের সংবাদমাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত এক প্রস্তাবে এই হত্যাকাণ্ডকে ‘অসামরিক’ ‘নিষ্ঠুরতম’ আখ্যা দিয়ে এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ সংগঠিত করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
ইজরায়েলি কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে প্রথমে এই হত্যাকাণ্ডের জন্য প্যালেস্তিনীয় প্রতিরোধ বাহিনীকে দায়ী করা হয়েছিল। কিন্তু নিহত সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহ’র সহকর্মীদের তীব্র প্রতিবাদের পর তারা এই অবস্থান থেকে পিছিয়ে আসেন। শিরিন তাঁর মৃত্যুকালীন জবানবন্দীতে বলেন যে, তাঁর উপর যখন গুলি চালানো হয় তখন অধিকৃত ইজরায়েলি সেনাবাহিনীর সদস্যরা ব্যতীত ঘটনাস্থলে আর কেউ ছিল না। এছাড়া হত্যালীলার যে ভিডিও ফুটেজ প্যালেস্তাইনের পক্ষ থেকে দেখানো হয় তাও শিরিনের বক্তব্যকে সমর্থন করে।
ইজরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নাফটালি স্টোনস্ প্রাথমিকভাবে এই হত্যাকাণ্ডের দায়কে অস্বীকার করলেও শেষ পর্যন্ত প্যালেস্তিনীয় কর্তৃপক্ষের চাপের কাছে নতিস্বীকার করে তারা হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে।
নিহত সাংবাদিকের শেষকৃত্য উপলক্ষে সমবেত জনগণের ওপর ইজরায়েলি বাহিনী লাঠিচার্জ করে। তাঁর বাসভূমি জেরুজালেমে জানানো হয় যে, ইজরায়েলি বাহিনী তাঁর প্রতি উপযুক্ত মর্যাদা প্রদর্শন করেনি। সাংবাদিকের মৃতদেহটি কফিনে করে নিয়ে এসে রাখা হয় এবং একে কেন্দ্র করে উত্তেজনা দেখা যায়।
এক প্রাপ্ত সংবাদে দেখা যায় যে, বর্তমান বছরে প্রায় ৬০ জন প্যালেস্তিনীয়কে হত্যা করা হয়েছে। এপ্রিল মাসের মধ্যভাগ থেকে ইজরায়েলি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে প্যালেস্তিনীয়দের পক্ষ থেকে ব্যাপক বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয়েছে।
প্যালেস্তিনীয় আন্দোলনের ইতিহাসে সাংবাদিক শিরিনের জন্মস্থান জেনির এক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান রয়েছে। ২০০২ সালের ৯ এপ্রিল জেনি ইজরায়েলি বাহিনী প্যালেস্তিনীয় অস্থায়ী উদ্বাস্তু শিবিরে অভিযান চালায়। এই অভিযানে ৪৭ জন প্যালেস্তিনীয় নিহত হন। এদের মধ্যে নারী এবং শিশুও ছিল। বিশ বছর পূর্বের এই ঘটনার স্মৃতি আজও অম্লান। ২০০২ সালের পর প্রতি বৎসর এই দিনটি প্যালেস্তিনীয়রা স্মরণ করেন।
চলতি বছরে ইজরায়েলি সেনাবাহিনী এই দিনটির উদ্যাপন রুখতে জেনিনে নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে কঠোর করে। ফেব্রুয়ারি মাসে জেনিনে অভিযান চালিয়ে ২৫ জন সক্রিয় কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ বছর জেনিনে অবস্থানরত প্যালেস্তিনীয়দের সাথে ইজরায়েলি সেনাবাহিনীর সংঘর্ষ হয়েছে। এই ঘটনায় তিন জন প্যালেস্তিনীয় নিহত হয়েছেন।
এই প্রেক্ষিতে বিগত কয়েকমাস ধরে জেনিনের মধ্যে সংঘাত ঘটে চলেছে। একে কেন্দ্র করে ইজরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ইজরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীকে অধিকৃত অঞ্চলকে রক্ষা করতে পূর্ণ মদত দেওয়া হয়। একে ব্যবহার করে অধিকৃত অঞ্চলে বিপুল সংখ্যক নিরাপত্তা বাহিনীর জওয়ান মোতায়েন করা হয়।
শিরিন কিছুদিন আগেই নিরীহ প্যালেস্তিনীয় এবং সংবাদ সংগ্রহে ব্যস্ত সাংবাদিকদের ইজরায়েলি সেনার হয়রানি ও দুর্ব্যবহার বন্ধের পক্ষে মত প্রকাশ করেছিলেন। তার পরই আক্রমণ নেমে আসে তাঁর উপর।
বিগত ৭০ বছরের নিহত প্যালেস্তিনীয় সাংবাদিকদের তালিকা প্রকাশ করা হয় কিছুদিন আগেই। এই তালিকা প্রকাশ করা হয় ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর জার্নালিজম (আইএফজে)-এর পক্ষ থেকে। এই তালিকা প্রকাশ হওয়ার পরই শিরিনের উপর আক্রমণ নামিয়ে আনা হয়। প্যালেস্তিনীয় জার্নালিস্ট সিন্ডিকেট (পিজেএস)’র পক্ষ থেকে এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো হয়। পিজেএস’র হিসাব অনুযায়ী ১৯৬৭ সাল থেকে ৮৬ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন ইজরায়েলি আগ্রাসনে। তাদের হিসাব অনুযায়ী ইজরায়েল ১৯৬৭ সাল থেকে ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক, গাজা দখল করে আছে।
রাষ্ট্রসংঘের মানবাধিকার কমিশন এই হত্যাকাণ্ডে তীব্র ক্ষোভ জানিয়েছে। এক প্রতিবাদপত্রে তারা জানিয়েছে যে, মার্কিন সেনাবাহিনী এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। প্যালেস্তিনীয় বিদেশ মন্ত্রক জানিয়েছে যে, আন্তর্জাতিক ক্রিমিনাল কোর্টের রায়ে এই হত্যাকাণ্ডের প্রবল প্রতিবাদ জানানো হয় এবং দোষীদের শাস্তি দাবি করা হয়। পিজেএস জানিয়েছে যে, ইতিপূর্বেও তারা আইসিসি’র কাছে এই ধরনের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে, কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। প্যালেস্তিনীয় সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে, এই ধরনের ৪২টি ঘটনা আইসিসি-কে জানানো হয় কিন্তু কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি।
আসলে প্রকৃত বিষয় হলো ইজরায়েলের পিছনে রয়েছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ সমর্থন যার জোরে তারা যে কোনো ঘটনা ঘটাতে পিছপা হয় না। যতদিন তাদের মূল পৃষ্ঠপোষক হিসেবে আমেরিকা থাকবে ততদিন তাদের সাতশো খুন মাফ। সুতরাং, মার্কিন বিরোধিতা এবং প্যালেস্তিনীয়দের প্রতি সংহতি আন্দোলন জোরদার করতে হবে বিশ্বজুড়েই। শিরিনের হত্যাকাণ্ডও এই দিক নির্দেশ দিচ্ছে।