অবশেষে তালিবান শাসনে আফগানিস্তান
লালন ফকির
সোভিয়েত ইউনিয়ন নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনী আফগানিস্তানের দখল নিয়েছিল ১৯৭৯সালে। তারপর ৪২ বছর অতিক্রান্ত। ১৯৯১ সালের পরে আফগানিস্তান ছেড়েছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। বর্তমানে আফগানিস্তানের কোথাও তাদের সামরিক বা অসামরিক ব্যক্তিদের দেখা মেলে না। কিন্তু তালিবানদের ব্যাপক উপস্থিতি রয়েছে সর্বত্র। সোভিয়েত ইউনিয়নের পরবর্তীকালে মার্কিনি সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে আফগানিস্তান। গত ৩০ আগস্ট আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনাদের নিয়ে শেষ বিমানটি কাবুল ত্যাগ করেছে। এরপরই কাবুল বিমানবাহিনীর দখল নিয়েছে সশস্ত্র তালিবানি বাহিনী।
মার্কিনি বাহিনী আফগানিস্তান পরিত্যাগের পূর্বে তাদের মজুত অস্ত্র ভাণ্ডার আফগান সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করে। অবশ্য তালিবানিরা এই সিদ্ধান্তে খুশি হয়নি। এইসব মার্কিনি অস্ত্রের তারাই দাবিদার ছিল। অবশ্য তারা যে এবারে ব্যাপকভাবে সোচ্চার ছিল, তা নয়। কারণ এই সময়কালে তারা মার্কিনি অস্ত্র বিপুল পরিমাণে সংগ্রহ করেছে। যার মধ্যে রয়েছে অনেক আধুনিক অস্ত্র। মার্কিনিরা ২০০১ সালে আফগানিস্তান দখল করেছে। এই বিশ বছরে মার্কিন প্রশাসন আফগানিস্তানকে সামরিক সাহায্য বাবদ ৮,৩০০ কোটি ডলার ব্যয় করেছে।
কাবুলে অবস্থিত মার্কিনি দূতাবাস অত্যন্ত বৃহৎ এবং আধুনিক। এটি নির্মাণে ব্যয়ের পরিমাণ ৮০ কোটি ডলার। মার্কিন প্রশাসন এটিকেও পরিত্যাগ করেছে। আগস্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে মার্কিন রাস্ট্রপতি জো বাইডেন ঘোষণা করেছেন আফগানিস্তানে মার্কিন কূটনীতিবিদদের সুরক্ষার জন্য অতিরিক্ত তিন হাজার মার্কিন সেনা মোতায়েন আছে। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-র যে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র কাবুলে ছিল তাও ধ্বংস করা হয়েছে। এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে মার্কিন সামরিক বিশেষজ্ঞরা জঙ্গি হামলা মোকাবিলায় আফগান বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিত।
মার্কিন প্রশাসন ঘোষণা করেছে যে, আফগান দূতাবাসে কর্মরত কূটনৈতিক কর্মচারীদের তারা কাতারে স্থানান্তরিত করবে। ইয়োরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত কিছু কিছু দেশও তাদের দূতাবাস কাবুল থেকে কাতারে স্থানান্তরিত করতে উদ্যোগী হয়েছে। মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের এক সপ্তাহ পূর্বে সিআইএ প্রধান টমাস বার্নসকে মার্কিন প্রশাসন কাবুলে তালিবানের অন্যতম শীর্ষ নেতা মোল্লাহ গাদির বারাডারের সাথে আলোচনার জন্য প্রেরণ করেছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে বারাডারকে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত করতে মার্কিন প্রশাসন উদ্যোগ নিয়েছিল।
বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত সংবাদ অনুযায়ী জানা যায় যে, বার্নাস কাবুলে এসে তালিবান নেতাকে অনুরোধ করেছিলেন যাতে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের তারিখ বাইডেনের অনুরোধ মতন কিছুদিন পিছিয়ে দেওয়া যায়। অবশ্য তালিবানরা এই অনুরোধে সম্মতি প্রদান করেনি। আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক মহলের কোনো কোনো অংশের পক্ষ থেকে ভিয়েতনাম থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের সাথে তুলনা করা হচ্ছে। কিন্তু সেই সময়ের তুলনায় বর্তমানে মার্কিন বাহিনী অনেক শক্তিশালী এবং তাদের মাথা নত করতে হয়েছে এমন শক্তির কাছে যাদের ক্ষমতা তুলনামূলক অনেক কম।
মার্কিন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন প্রত্যাহার পর্ব শেষে জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত এক ভাষণে পলায়ন পর্বকে এক ‘অসাধারণ সাফল্য’ বলে আখ্যাত করেছেন। জো বাইডেন অবশ্য আফগানিস্তানের বর্তমান বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির বিশেষ করে কাবুল বিমানবন্দরে অশান্তির জন্য পূর্বতন মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের আফগান নীতিকে দায়ী করেছেন। তাঁর মতে আফগানিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ নেই। দশ বছর পূর্বেই আফগানিস্তান থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চলে আসা উচিত ছিল।
মার্কিন রাষ্ট্রপতি যাই বলুন না কেন, আফগানিস্তানে তালিবান শাসন প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব মার্কিন প্রশাসন এড়িয়ে যেতে পারে না। আফগানিস্তান থেকে প্রগতিশীল সরকারকে উৎখাত করতে একের পর এক মার্কিন রাষ্ট্রপতি বা সরকার বিপজ্জনক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। তালিবানদের সৃষ্টি করেছে মার্কিন প্রশাসন। আফগানিস্তানের জনসংখ্যার উল্লেখযোগ্য অংশ পাশতুল সম্প্রদায়ভুক্ত হলেও অন্যান্য জনজাতি গোষ্ঠীর মানুষও রয়েছেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো তাজিক, হামারা, উজবেক, আরমান, তুর্কমেন, বালুচ, পাশাই, নুরিস্তানি, বুজুরে, আরব, কিরগিজ, মদার ও অন্যান্য গোষ্ঠী।
প্রসঙ্গত, তালিবান এক স্বতন্ত্র গোষ্ঠী। এরা গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে পাঁচ বছর ক্ষমতায় ছিল, তখন এদের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের বহু প্রমাণ রয়েছে। বিশেষত, আধুনিকতার বিন্দুমাত্র স্পর্শকে এরা স্বীকার করতে রাজি নয়। মহিলাদের প্রতি এরা প্রচণ্ড নৃশংস। বিদেশিদের প্রতিও এরা অত্যন্ত বিপজ্জনক। এদের সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ সারা বিশ্বে অত্যন্ত পরিচিত। বর্তমানে আফগানিস্তানে যে তালিবান মন্ত্রীসভা গঠিত হলো তাদের মধ্যে একাধিক ব্যক্তি রয়েছেন যার মধ্যে মহম্মদ হামা আবদুল হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি তালিবান প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা মহম্মদ ওমরের ডান হাত বলে পরিচিত। নিরাপত্তা পরিষদের তালিকায় দুধর্ষ তালিবান কমান্ডার হিসাবে পরিচিত। দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছেন সিরাজুদ্দিন হুক্কানি। ইনি আলকায়দা এবং জৈশ ই মহম্মদ ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। এক দশক ধরে নিরাপত্তা পরিষদের নিষিদ্ধ তালিকাভুক্ত গোয়েন্দা প্রধান হয়েছেন আবদুল হক ওয়ামিক। ইনি আফগানিস্তানে আলকায়দা এবং ভিনদেশি জঙ্গির প্রশিক্ষণ শিবির পরিচালনা করেছেন। তালিবান বিরোধীদের সাথে নিষ্ঠুর আচরণের জন্য কুখ্যাত হয়েছেন। নিষিদ্ধ তালিকায় দীর্ঘদিন রয়েছেন বিলা আহমেদ হুক্কানি, যিনি উদ্বাস্তু মন্ত্রীর পদে আসীন হয়েছেন। ইনি ওসামা বিন লাদেনের একজন ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি। অনেক হামলার সাথে সরাসরি যুক্ত, নিষিদ্ধ তালিকায় রয়েছেন দীর্ঘদিন, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী পদে আসীন হয়েছেন মহম্মদ ইয়াকুব। পূর্বের তালিবান রাজত্বে নিরাপত্তা পরিষদের কালো তালিকার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন তিনি।
এই প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে যে, আগামী কয়েক সপ্তাহে তালিবান নেতাদের তালিকা নতুন করে তৈরি করা হবে। নিরাপত্তা পরিষদের তালিবান মন্ত্রীসভার ৩৩ জনের মধ্যে ২০ জনই আছেন যারা ইয়োরোপের বিভিন্ন দেশে জঙ্গি কার্যকলাপের জন্য নিষিদ্ধ। বেশ কয়েকজন মন্ত্রীর নামে এফবিআই-এর নোটিশও রয়েছে। এই প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রসংঘের তালিকাটিকে পরিবর্তন করা হয়েছিল। তা নিয়ে ধারাবাহিক বৈঠক চলার সম্ভাবনা রয়েছে। পরিষদের স্থায়ী এবং অস্থায়ী উভয় ধরনের সদস্যরাই এখানে অংশগ্রহণ করেছে।
রাষ্ট্রসংঘে ভারতীয় মিশনের স্থায়ী প্রতিনিধি টি এস তিরুমূর্তি সম্প্রতি প্রদত্ত এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘আফগানিস্তানের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী দেশ ভারত এবং সে দেশের মানুষের বন্ধু রাষ্ট্র হিসাবে বর্তমান পরিস্থিতি আমাদের উদ্বেগের কারণ। গত দু’দশকে যে ইতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল তা এখন অনিশ্চয়তার মুখে। আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত। এই পরিস্থিতিতে আফগান মেয়েদের কণ্ঠস্বর এবং আফগান শিশু ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষদের স্বার্থে ভারত সোচ্চার হবে।’ ভারতীয় প্রতিনিধির কথায় ‘সংখ্যালঘুদের অধিকার এবং শিশুদের আশা-আকাঙ্ক্ষার দিকগুলি উপেক্ষিত না হয়।’ বিশ্বের সমস্ত মানবাধিকার কর্মীরা যাতে এ ব্যাপারে বিনা বাধায় রাষ্ট্র সঙ্ঘের সাথে যোগাযোগ করতে পারে এবিষয়ে তারা দাবি জানিয়েছে ভারতকে। ভারত চায় আফগান সরকার দেশের সমস্ত গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী জনগণের সরকার হবে।
আফগানিস্তান তালিবান দখলে চলে যাওয়ার ক্ষেত্রে পাকিস্তান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। আফগানিস্তানে নারীদের ক্ষমতায়নের প্রধান মুখ হয়ে উঠেছিলেন দুই নারী। এদের একজন হলেন পপ গায়িকা আরিয়ানা সঈদ এবং অপরজন হলেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জনপ্রতিনিধি তথা আফগান সংসদের সদস্য আনারকলি কৌর হোনারয়ার। তালিবান আতঙ্কে উভয়েই দেশছাড়া হয়েছেন। শুধু তাই নয় উভয়েই ভারতের সাহায্য চেয়েছেন।
ইনস্ট্রাগ্রামে ছবি পোস্ট করে আরিয়ানা জানিয়েছিলেন, নিরাপদে কাবুল ছেড়েছেন। সংবাদমাধ্যমের কাছে তিনি জানিয়েছেন তালিবানের মতন সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের বাড়বাড়ন্তের জন্য অন্যতম দায়ী পাকিস্তান। তাঁর অভিযোগ হলো তালিবানদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে পাকিস্তান। এর অনেক প্রমাণ রয়েছে। এই বক্তব্যোর ন্যায্যতা রয়েছে। মার্কিন প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদতে পাকিস্তানের মাটিতে পাক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে।
তালিবানদের নিয়ন্ত্রণে আফগানিস্তান চলে যাওয়ায় সেখানে মানবাধিকার গুরুতরভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে। এ তথ্য দিয়েছেন রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার পরিষদের প্রধান মিশেল বাশেলে। রাষ্ট্রসঙ্ঘের বিশেষ অধিবেশনে তিনি বলেছেন, তালিবানকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে পাকিস্তান। তিনি বলেছেন তালিবানকে নির্দেশ দিচ্ছে পাকিস্তান। ওদের ঘাঁটি পাকিস্তান। সেখানেই প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এই বক্তব্য সঠিক।
তবে আফগানিস্তানের দখল নেওয়াকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের বিশেষ সুবিধা হয়েছে। বিশেষত‘ আঞ্চলিকভাবে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে তালিবানদের অবস্থানকে তারা ব্যবহার করবে। বিশেষত, ভারতের বিরুদ্ধে এই সুযোগকে তারা ব্যবহার করবে। আফগান মন্ত্রীসভায় তালিবান সহযোগী হিসাবে হুক্কানি গোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করা এবং তাকে গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের দায়িত্ব দেওয়া ভারতের কাছে এক অশনি সঙ্কেত।
পূর্বোক্ত পরিস্থিতিতে একথা বলা চলে যে, আফগানিস্তানে তালিবান শাসন প্রতিষ্ঠার প্রসঙ্গটি আগামীদিনে এই উপমহাদেশে বহুমুখীন জটিলতা সৃষ্টি করবে। ভারতও এই বৃত্তের বাইরে নয়।