বিশ্বজুড়ে বাড়ছে উগ্র দক্ষিণপন্থার বিপদ
অর্ণব ভট্টাচার্য
পৃথিবী জুড়ে ক্রমাগত প্রভাব বৃদ্ধি করছে উগ্র দক্ষিণপন্থী শক্তি। একদিকে উন্নত পুঁজিবাদী দেশ জার্মানি কিংবা বিশ্ব পুঁজিবাদের চালিকাশক্তি আমেরিকা, অন্যদিকে উন্নয়নশীল দেশ ভারত কিংবা তুরস্কে উগ্র দক্ষিণপন্থার গণভিত্তি যেভাবে তৈরি হয়েছে তা যথেষ্ট উদ্বেগের বিষয়। গত জুন মাসে জার্মানিতে একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে, অধিকাংশ জনগণ মূল স্রোতের সবক’টি রাজনৈতিক দলের উপরই ক্ষুব্ধ। ক্ষমতাসীন দলগুলির প্রতি জনগণের অনাস্থার সুযোগ নিচ্ছে চরম দক্ষিণপন্থী শক্তি। বর্তমানে জার্মানিতে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট, গ্রিন পার্টি ও লিবারেলদের জোট সরকার রয়েছে, যাদের কিনা জনসমর্থন মাত্র ৩৮ শতাংশ। দক্ষিণপন্থী দল অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি একাই ২০ শতাংশ সমর্থন অর্জন করে ফেলেছে, যা জার্মানির বর্তমান শাসক জোটের যেকোনো দলের তুলনায় বেশি। বর্তমানে অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি গত দশ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ জনসমর্থন অর্জন করে ফেলেছে এবং জার্মানির পূর্ব অংশে এই দল সবচেয়ে শক্তিশালী। সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে যে, জার্মানির মাত্র ২৫ শতাংশ মানুষ সরকারের কাজে সন্তুষ্ট। ৭৭ শতাংশ মানুষ বলেছেন যে, সামগ্রিকভাবে দেশে যে পরিস্থিতি চলছে তাতে তারা উদ্বিগ্ন। এখন জার্মানির মানুষের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে মূল্যবৃদ্ধি, পরিবেশ বিপর্যয় এবং বিদেশ থেকে অভিবাসী আগমন। উগ্র দক্ষিণপন্থী শক্তি এই অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তাকে কাজে লাগিয়ে জাতিবিদ্বেষ, অভিবাসীদের প্রতি ঘৃণা এবং ইসলামের প্রতি বিতৃষ্ণাকে পরিকল্পিতভাবে জনগণের মধ্যে জাগিয়ে তুলছে। শাসকজোটের অর্থনৈতিক নীতির প্রতি মানুষের কোনো আস্থা নেই, কেননা সেগুলি তাদের সংকটের প্রধান কারণ। অন্যদিকে বিকল্প অর্থনৈতিক নীতিকে সামনে রেখে জার্মানিতে আন্দোলন গড়ে তোলার মতো কোনো শক্তিশালী বাম ও প্রগতিশীল দল নেই। এই অবস্থার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে নিজেদের জনসমর্থন বাড়াচ্ছে চরম দক্ষিণপন্থী দলগুলি। এদিকে ফ্রান্সে সম্প্রতি এক আরব বংশোদ্ভূত নাবালক গাড়ি চালককে পুলিশ গুলি করে হত্যা করার পর সেদেশে যে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়েছিল তা সেদেশে ক্রমবর্ধমান জাতিগত বৈষম্য ও বিদ্বেষের দিকে ইঙ্গিত করছে। ফ্রান্সের বর্তমান শাসক জোট অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলার ক্ষেত্রে সরকারি নীতির ব্যর্থতা আড়াল করতে উগ্র জাতীয়তাবাদী, বর্ণবিদ্বেষীদের সাথে আপস করছে। এতে আখেরে লাভ হচ্ছে উগ্র দক্ষিণপন্থীদের। তাদের নেত্রী মেরিন লা পেন ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন।
লাতিন আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনাতেও পরিস্থিতি মৌলিকভাবে আলাদা কিছু নয়। এখানেও মধ্যপন্থী শাসক পেরোনিস্ট দলের প্রতি জনগণের ক্ষোভ ক্রমবর্ধমান। তীব্র মূল্যবৃদ্ধি রোধ করা সহ সামগ্রিক অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করতে শাসকের ব্যর্থতাকে পুঁজি করে তাই সামনে উঠে এসেছে চরম দক্ষিণপন্থী রাজনীতিবিদ জেভিয়ার মিলেই। বর্তমানে আর্জেন্টিনায় বিগত বছরের তুলনায় মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে ১১৫ শতাংশ, ২৫ শতাংশ মানুষ দরিদ্র। দেশীয় মুদ্রা পেসোর ব্যাপক অবনমন ঘটেছে। সামগ্রিকভাবে যে আর্থিক দুর্দশা ঘনীভূত হয়েছে আর্জেন্টিনায় তার প্রেক্ষাপটে চরম দক্ষিণপন্থীরা ঘৃণার রাজনীতির ওপর ভর করে প্রচার করছে। ওই দেশে এদের লক্ষ্যবস্তু নারীর সমতা, পরিবেশ সুরক্ষা, সামাজিক প্রকল্প, বিজ্ঞান চেতনা, সংস্কৃতি ও শিক্ষা। আগামী বছর সে দেশে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। প্রাথমিক পর্যায়ে সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে সমস্ত প্রগতিশীল শক্তির কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে উগ্র দক্ষিণপন্থী জেভিয়ার মিলেই।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প পরাস্ত হলেও, উগ্র দক্ষিণপন্থী শক্তি সেদেশে নানাভাবে সক্রিয় রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থায় এই চরম দক্ষিণপন্থীদের যথেষ্ট প্রভাব আছে। এর ফলে বিভিন্ন নাগরিক অধিকার ও মহিলাদের অধিকার রক্ষা, বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে অত্যন্ত পশ্চাৎমুখী, অগণতান্ত্রিক ও প্রতিক্রিয়াশীল সিদ্ধান্ত নিচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোর্ট। বিশেষ করে আফ্রিকান বংশোদ্ভূত আমেরিকানদের সাথে যে বিভিন্ন সময় চরম বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয় তার প্রতিকার করতে কোর্ট কোনো সদর্থক ভূমিকা তো পালন করছেই না, উলটে যে সমস্ত পুলিশ অফিসার কৃষ্ণাঙ্গদের হত্যাকাণ্ডে জড়িত তাদের হয় মুক্তি দেওয়া হচ্ছে নতুবা লঘু দণ্ড দিয়ে রেহাই দেওয়া হচ্ছে। জাতিগত সাম্য প্রতিষ্ঠার বদলে জাতিগত বৈষম্যকে উৎসাহিত করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোর্ট। কিছুদিন আগে ছাত্রদের শিক্ষা সংক্রান্ত ঋণ মকুব করার একটি প্রয়াস গ্রহণ করা হলে তাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট সরাসরি নাকচ করে দিয়েছে। রক্ষণশীল এবং নয়া উদারবাদী নীতিতে বিশ্বাসী মার্কিনি বিচার ব্যবস্থা মহিলাদের অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে এখনও অত্যন্ত নেতিবাচক ভূমিকা পালন করে চলেছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত আমেরিকার ১৪ টি রাজ্যে গর্ভপাত নিষিদ্ধ। ধর্মীয় বিশ্বাসের নামে এভাবে নারীদের অধিকার খর্ব করার যে ব্যবস্থা এদেশে আছে তা আধুনিকতার সাথে কোনভাবেই খাপ খায় না। এই ধরনের মধ্যযুগীয় মানসিকতা যা কিনা সযত্নে লালন পালন করা হচ্ছে মার্কিন মুলুকে, তা ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো চরম প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতিবিদকে এখনো সে দেশের রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক করে রেখেছে।
এবছর তুরস্কের নির্বাচনে উগ্র দক্ষিণপন্থীদের সহায়তায় সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারের সমর্থন আদায় করে আবার রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হয়েছেন রক্ষণশীল ও স্বৈরাচারী শাসক এরদোগান। এরদোগানের নেতৃত্বাধীন জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি চরম দক্ষিণপন্থী দল ইসলামিস্ট নিউ ওয়েলফেয়ার পার্টির সমর্থন আদায় করার জন্য তাদের সাথে চুক্তি করেছিল যে, ক্ষমতায় এলে মহিলাদের এবং এলজিবিটি গোষ্ঠীর অধিকার খর্ব করা হবে। আর এই সবটাই করা হয়েছে নৈতিক মূল্যবোধের বিকৃতি রোধ করার নামে। এই প্রথম তুরস্কের নির্বাচনে এই ইসলামপন্থী দলটি পাঁচটি আসন দখল করেছে। এই নির্বাচনে চরম দক্ষিণপন্থী ভিকট্রি পার্টি মূলত সিরিয়া থেকে আসা অভিবাসীদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রচার চালিয়ে জনসমর্থন আদায় করেছে। তুরস্কের বিরোধী জোটেও দক্ষিণপন্থী ইসলামিস্ট ফেলিসিটি পার্টি ও গুড পার্টি রয়েছে। তবে এবারের নির্বাচনে যার সমর্থন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে তুরস্কের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে তিনি ছিলেন চরম দক্ষিণপন্থী এটিএ জোটের প্রার্থী সিনান ওয়ান, যিনি অত্যন্ত রক্ষণশীল এবং তীব্র অভিবাসী বিরোধী। তুরস্কের বর্তমান আর্থিক সংকটের প্রেক্ষাপটে কুর্দ জাতিগোষ্ঠী ও সিরিয়ান উদ্বাস্তুদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষকে ক্রমাগত উৎসাহিত করে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মন জয় করার কাজে সফল এরদোগান ও তাঁর জোট সঙ্গীরা। তবে এটা লক্ষ্য করার মতো বিষয় যে, তুরস্কের নির্বাচক মণ্ডলীর একটা বিরাট অংশ এরদোগানের নেতৃত্বাধীন সরকারের ব্যর্থতা এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু বিগত সময়ে এরদোগান যেভাবে গণমাধ্যমে দখলদারি কায়েম করেছেন, বিচারালয় থেকে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে নিজের পছন্দের লোক বসিয়েছেন, তাতে তার পক্ষে জাতীয় রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়ে গেছে। রক্ষণশীলদের সমর্থন আদায়ের জন্য ধর্ম নিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়ে যান এরদোগান। উস্কে দেন উগ্র জাতীয়তাবাদী আবেগ। আর সেই পথেই শেষমেষ তার সাফল্য নিশ্চিত করেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্প থেকে বলসোনারো, এরদোগান থেকে মোদি - চরম দক্ষিণপন্থীদের রাজনৈতিক কৌশল পৃথিবী জুড়ে একটা প্যাটার্ন অনুসরণ করছে, যেখানে মানুষের অর্থনৈতিক সংকটজনিত অনিশ্চয়তা এবং এই সংসদীয়-গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ব্যর্থতার প্রতি ক্ষোভকে জাতিগত ও ধর্মীয় বিদ্বেষের দিকে পরিচালিত করে গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শাসন ব্যবস্থার প্রতি গভীরভাবে সন্ধিহান করে তোলা হচ্ছে। বৃহৎ পুঁজিপতিদের সহায়তায় গণমাধ্যম থেকে বিচার ব্যবস্থা - সর্বত্র নিজেদের ব্যাপক নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব স্থাপন করার মাধ্যমে এই কাজ করে চলেছে চরম দক্ষিণপন্থী শক্তি। সমাজে বিদ্যমান শ্রেণিগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করা এবং জোটবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যে দুর্বলতা রয়েছে বিশ্বের অধিকাংশ দেশে, তার ফলে ক্রমশ শক্তি সঞ্চয় করছে চরম দক্ষিণপন্থী শক্তি। শ্রেণিগত পরিচিতিকে পেছনে ঠেলে জাতি বা ধর্ম সম্পর্কিত পরিচয়কেই প্রধানতম পরিচয় হিসেবে তুলে ধরা এবং ‘‘অপর’’ কোনো জাতি বা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে শত্রুপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করার যে রণকৌশল গ্রহণ করেছে চরম দক্ষিণপন্থী শক্তি তার বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে একাধারে মতাদর্শগত এবং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক লড়াই চালানোটাই একমাত্র বিকল্প পথ। ব্রাজিলের বলসোনারো এই সময়কালে নির্বাচনে পরাস্ত হয়েছেন। লাতিন আমেরিকার আরও কয়েকটি দেশে বাম ও প্রগতিশীল শক্তি অগ্রগতি ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। গ্রিসে কমিউনিস্ট পার্টি নির্বাচনে ভাল ফল করেছে। ভারতেও প্রাদেশিক স্তরের কয়েকটি নির্বাচনে উগ্র দক্ষিণপন্থী সাম্প্রদায়িক শক্তি পরাস্ত হয়েছে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে বিশ্ব রাজনীতির ভারসাম্য দক্ষিণপন্থার অনুকূলে। একে বদলাতে হলে শ্রেণি সংগ্রাম তীব্রতর করতে হবে। সংস্কৃতি জগতেও কার্যকর পদক্ষেপ ও প্রচার করে যেতে হবে ধারাবাহিকভাবে।