অবিনাশী হেনরিয়েটার সত্য কাহিনি ও অমানবিক মার্কিনি পুঁজিবাদ
তপন মিশ্র
হেনরিয়েটা ল্যাকস (Henrietta Lacks) ছিলেন আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ নিগ্রো (Afro-American)-দের মধ্যে একজন অতি সাধারণ মহিলা। তাঁর পূর্বপুরুষদের প্রায় ৫০০ বছর আগে ক্রীতদাস হিসাবে আফ্রিকা থেকে আমেরিকায় নিয়ে আসা হয়েছিল। ওঁদের পরিবারের সবাই তামাক চাষের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৫১ সালে হেনরিয়েটার অকাল মৃত্যু হয় মাত্র ৩১ বছর বয়সে তাঁর জরায়ুর নিচের অংশে এক মারণ টিউমার (Servical tumor)-এর কারণে। তখন সে পাঁচ সন্তানের মা। বাল্টিমোরের জনস হপকিনস মেডিকেল কলেজে চিকিৎসারত অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। তখন আমেরিকার সামান্য যে কয়টি হাসপাতালে কৃষ্ণাঙ্গদের চিকিৎসা হতো তার মধ্যে একটি ছিল এই জনস হপকিনস হাসপাতাল। মৃত্যুর ঠিক আগে তাঁর দেহ থেকে হেনরিয়েটা বা তাঁর পরিবারের অজ্ঞাতসারে জনস হপকিনস হাসপাতাল ও গবেষণাগারের চিকিৎসক এবং বিজ্ঞানী জর্জ গে টিউমার আক্রান্ত অঞ্চলের কলাকোষ সংগ্রহ করেন। সেই কোষ তিনি সফলভাবে ক্লোনিং করতে সক্ষম হন। ক্লোনিং হলো কোষের মতো আর একটা কোষ তৈরি করার পদ্ধতি। এমনিতেই মাইটোসিস পদ্ধতিতে যে কোষ বিভাজন হয় তাতে কোষের বৈশিষ্ট্যের কোনো পরিবর্তন হয় না। সফল ক্লোনিং-এর পর বেশ কিছু গবেষণাগারে হেনরিয়েটার সেল লাইন হস্তান্তরিত হয়। তাই হেনরিয়েটার কোষ এখনো জীবিত আছে পৃথিবীর বিভিন্ন গবেষণাগারে। ১৯৫১ সালে হেনরিয়েটার সরভিক্স থেকে কিছু কোষ সংগ্রহ করে ক্লোনিং-এর পর এই কোষ বছরের পর বছর ধরে জিইয়ে রেখে হাজার হাজার কোটি টাকা রোজগার করছে বেশ কয়েকটি বায়োটেকনোলজি সংস্থা। হেনরিয়েটা কৃষ্ণাঙ্গ হওয়ার কারণে অর্ধশতকেরও বেশি সময় ধরে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রাখা হয় ওঁদের পরিবারকে।
জনসমক্ষে এলো হেনরিয়েটার ঘটনা
হেনরিয়েটার কথা প্রথম জনসমক্ষে আসে ১৯৭৬ সালের মার্চ মাসে ডেট্রয়েট ফ্রি স্পেস ও রোলিং স্টোন পত্রিকায় মাইকেল রজার্সের লেখা The Double-Edged Helix নামে পরপর দুটি বৈজ্ঞানিক নিবন্ধের মাধ্যমে। এরপর ১৯৯৭ সালে ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং করপোরেশন (বিবিসি) অ্যাডাম কার্টিসের পরিচালনায় হে-লা কোষের ইতিহাস ও তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা অনেক ঘটনাকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্র (The Way of All Flesh) প্রদর্শিত হয় । তবে হেনরিয়েটাকে সকল স্তরের মানুষের কাছে সহজে পৌঁছে দেবার কৃতিত্ব অবশ্যই রেবেকার। ২০১০ সালে হেনরিয়েটার বঞ্চনার উপর রেবেকা স্কুল্ট নামে একজন চিকিৎসা বিজ্ঞানের লেখক একটি বই লেখেন যার নাম ‘The Immortal Life of Henrietta Lacks’। এই প্রবন্ধ কেবল হে-লা কোষের কথা নয় হেনরিয়েটার বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগঠিত প্রতিবাদের এক দলিল। কিন্তু তখনও হেনরিয়েটার পরিবার সুবিচার পায়নি।
হে-লা সেল লাইন কী ও কেন?
হেনরিয়েটা ল্যাকসের ক্যান্সারের কোষ কৃত্রিম উপায়ে গবেষণাগারে বাঁচিয়ে রাখার পদ্ধতিকে ‘HeLa cell line (হে-লা কোষসারণি)’ বলা হয়। জনস হপকিনস হাসপাতালের দ্বারা সংগৃহীত হলেও এই কোষ চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণার কাজে ব্যবহৃত হয়েছে বহুলভাবে। বেশ কয়েকটি পেটেন্টও হয়েছে হেনরিয়েটার কোষ ব্যবহার করে সংগঠিত গবেষণাগুলি থেকে। ক্যান্সারে মারা যাওয়ার আগে কৃষ্ণাঙ্গ এই মহিলার টিউমার থেকে নেওয়া টিস্যু হলো প্রথম মানব কোষ যা গবেষণাগারে নির্দিষ্ট খাদ্য ও পরিবেশ তৈরি করে ক্রমাগত বংশবৃদ্ধির বা পুনরুৎপাদন করার ব্যবস্থা করা হয়। হে-লা কোষগুলি আধুনিক টিকা এবং ঔষধ তৈরির গবেষণায় বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে ভিত্তি হিসাবে কাজ করেছে। পোলিও ভ্যাকসিন, এক্স-রে সম্পর্কিত পরীক্ষা, ক্যান্সার চিকিৎসা, সালমোনেলা জীবাণু সংক্রমণ এবং এইচআইভি নিরাময়ে চিকিৎসার জন্য জেনেটিক ম্যাপিং এবং এমনকী কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন তৈরি সহ অগণিত বৈজ্ঞানিক ও চিকিৎসাক্ষেত্রে উদ্ভাবনকে সম্ভব করে তুলেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এর ব্যবহার হয়েছে বাণিজ্যিকভাবে। কোনো ওষুধ বা টিকা আবিষ্কারের পর সরাসরি কোনো প্রাণীদেহে প্রয়োগের আগে এই কোষসারণির উপর ব্যবহার করে তার কার্যকারিতা দেখা হয়। এমনকী মহাকাশে এই কোষকে নিয়ে তার উপর শূন্য মাধ্যাকর্ষণের কি প্রভাব পড়তে পারে সেই পরীক্ষাও করা হয়েছে।
‘হে-লা’ কোষ লাইনের বিশেষ একটি গুণ থাকায় তা এখনও অমর আছে। এই কোষ লাইনের রয়েছে এইচপিভি’র (হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস)-র বিশেষ শক্তিশালী স্ট্রেন। এইচপিভি’র প্রায় ১০০ ধরনের স্ট্রেন আছে। এই স্ট্রেনটি হে-লা কোষকে অনেক দিন বেঁচে থাকতে সাহায্য করে। সাধারণভাবে উপযুক্ত পরিবেশ থাকলেও শরীর থেকে সরিয়ে নেওয়ার পর কোষ বেশিদিন বাঁচে না। হে-লা কোষ সারণি গবেষণাগারে বিশেষ তৈরি করা পরিবেশে কেবল বেঁচেই থাকে না বরং সংখ্যায়ও বাড়ে। এই বিশেষ গুণের সদ্ব্যবহার করে একে গবেষণাগারে কালচার করা বা সংখ্যায় বৃদ্ধি করা যায়। কালচার করা এই কোষ দেহের বাইরে বেঁচে থাকতে পারে অনির্দিষ্টকালের জন্য।
হে-লা কোষের আর একটি বৈশিষ্ট্য থাকায় হেনরিয়েটার কোষ লাইন-কে অস্বীকার করতে পারেনি বায়োটেকনলজি সংস্থাগুলি। তা হলো আফ্রো-আমেরিকান মার্কার ডিএনএ। এটি ডিএনএ-র এমন একটি বৈশিষ্ট্য যার মধ্য দিয়ে আফ্রিকা থেকে আসা কোষকে শনাক্ত করা যেতে পারে। এমনকী আফ্রিকা এবং আমেরিকানদের যৌন মিলনের ফলে যে সন্তান হবে তাদের মধ্যেও এই ডিএনএ মার্কার খুঁজে পাওয়া যায়।
হে-লা এবং জৈব-নৈতিকতার প্রশ্ন
চিকিৎসা শাস্ত্রের নৈতিকতা বা জৈব-নৈতিকতা (Bioethics) অনুযায়ী কোনো ব্যক্তির সম্মতি ছাড়া তার দেহে এমন কিছু কারও করা উচিত নয় যা তার ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যের সঙ্গে এবং বাণিজ্যিক ব্যবহারের সঙ্গে যুক্ত। জনস হপকিনস হাসপাতালের চিকিৎসক যিনি হেনরিয়েটার দেহ থেকে কলাকোষ অপসারণ করেন এবং তাঁদের গবেষণার কাজে ব্যবহার করেন, তিনি এই কাজের মধ্যদিয়ে ল্যাকসের শরীরের গোপনীয়তা লঙ্ঘন করেছেন। দীর্ঘ সময় ধরে এই বিষয়টি লোকচক্ষুর আড়ালে রাখা সম্ভব হয় কারণ হেনরিয়েটা ছিলেন পিছিয়ে-পড়া কৃষ্ণাঙ্গ পরিবারের সদস্যা।
২০২০ সালে ‘The Medical Ethics of HeLa Cells (2020-2021)’ নামে একটি প্রবন্ধে এলিজাবেথ প্রাট লেখেন (DigitalCommons@Cortland) যে, যে সময়ে এই ঘটনাটি ঘটছে সেই সময়ে (১৯৫১ সালে) চিকিৎসাশাস্ত্রে নীতিগত প্রশ্ন সম্পর্কে কোনো আইন ছিল না। তাই কেউ কেউ মনে করেন যে, হেনরিয়েটার দেহের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘিত হয়েছে বলে দাবি করা যায় না।
আমেরিকায় ১৯৭৪ সালে বেলমন্ট রিপোর্ট নামে একটি নীতি প্রণয়ন করা হয় যার মধ্যদিয়ে বায়োমেডিক্যাল গবেষণায় মানবদেহ এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ব্যবহারের বিষয়গুলি সম্পর্কে নীতি নির্ধারণ করা হয়। এর ভিত্তিতে ওই বছরই ন্যাশনাল রিসার্চ অ্যাক্ট তৈরি হয়। এই নীতি প্রণয়নের পরেও হেনরিয়েটা সুবিচার পাননি।
২০২০ সালের ১ সেপ্টেম্বর নেচার পত্রিকা সম্পাদকীয়তে বিষয়টি তুলে ধরে। সম্পাদকীয়টির শিরোনাম ছিল ‘Henrietta Lacks: science must right a historical wrong’। ২০২০ সাল ছিল হেনরিয়েটার জন্মের শতবর্ষ। এই উপলক্ষে লেখা প্রবন্ধে বলা হয়ঃ “হেনরিয়েটা ল্যাকসের শতবর্ষে গবেষকদের অবশ্যই আরও বেশি কিছু করতে হবে যাতে ভবিষ্যতে সম্মতি ছাড়া মানবকোষ নেওয়া না যায়।”
আরও অনেক ঘটনা
হেনরিয়েটা ল্যাকসের মতো বিভিন্ন মানুষের থেকে চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের দ্বারা সংগৃহীত কলাকোষের কারণে ক্ষতির শিকার হয়েছে হাজার হাজার মানুষ। বিশ্বজুড়ে হাজার হাজার মানুষের কোষ সংগ্রহ করে তৈরি হয়েছে বায়োব্যাঙ্ক। জনস হপকিনস হাসপাতালের চিকিৎসকরা হেনরিয়েটা ল্যাকসের সার্ভিকাল কোষগুলিকে তাঁর অজান্তেই নিয়ে যাওয়ার ৭০ বছরেরও বেশি সময় পরে, তাঁর বংশধরদের একজন আইনজীবী Thermo Fisher Scientific Inc. - নামে একটি বায়োটেকনোলজি কোম্পানির সাথে একটি সমঝোতায় পৌঁছতে সক্ষম হয়। এসব হয়েছে তার কারণ হলো হেনরিয়েটা বর্ণবাদী চিকিৎসা ব্যবস্থার শিকার ছিল।
হেনরিয়েটার পরিবার এবং থার্মো ফিশারের মধ্যে চুক্তি প্রাথমিকভাবে বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে খারিজ করার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু চিকিৎসাশাস্ত্রের বিশেষজ্ঞরা বলেন যে, এই চুক্তি না’হলে চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণার উপর ভবিষ্যতে আরও চাপ সৃষ্টি হতে পারে । তাই এই চুক্তি সম্পাদন করে ঐতিহাসিক ত্রুটির কিছুটা সংশোধন করা দরকার।
১৯৭৬ সালে, জন মুর নামে একজন ব্যক্তি hairy cell leukaemia-র নামে এক মারণ রোগের জন্য ইউসিএলএ নামে এক নামী প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা করাচ্ছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসক ডেভিড গোল্ডে চিকিৎসার প্রয়োজনে তাঁর প্লীহা অপসারণ করেন। তাঁর অস্ত্রোপচারের সাত বছর পরে, মুর বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাঁকে যে সম্মতিপত্রে সই করানো হয়েছে তাতে তাঁর কাছ থেকে সংগ্রহ করা দেহের যে কোনো অংশের সেল লাইনের অধিকার ইউসিএলএ-এর রয়েছে। পরে জানা যায় যে, চিকিৎসক গোল্ডে মুরের প্লীহার কোষগুলিকে সেল লাইন সংরক্ষণ করে বাজারজাত করেছেন এবং তা পেটেন্ট করে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। এই পেটেন্টের মূল্য ছিল বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।
মুরের কাছে আদালতে যাওয়া ব্যতীত আর কোনো বিকল্প ছিল না কারণ তাঁর চিকিৎসক, গোল্ডে ইতিমধ্যে তাঁর কোষগুলির পেটেন্ট করে নিয়েছিলেন। ১৯৮৪ সালে মুর, গোল্ডে এবং ইউসিএলএ-এর বিরুদ্ধে মামলা করেন এবং কোষগুলিকে তাঁর সম্পত্তি হিসাবে দাবি করেন। প্রাথমিকভাবে, আদালত মুরের মামলাটি গ্রহণ করেনি। পরে মুর ক্যালিফোর্নিয়ার সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন। অবশেষে আদালত রায় দেয় যে, আদালত বিশ্বাস করে যে - গোল্ডে মুরের কাছ থেকে সঠিকভাবে সম্মতি নেননি। পরে আদালত ক্ষতিপূরণের আদেশ দেয়। মুর ছিলেন একজন শ্বেতাঙ্গ আমারেকার নাগরিক।
স্পষ্টতই হেনরিয়েটার কোষ লাইনকে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা টার্গেট করেছিল কারণ সে কৃষ্ণাঙ্গ ছিল। ১৯৫১ সালে বর্ণবিদ্বেষবাদ এতোটাই ব্যাপক ছিল যে, কোনো কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তির স্বাধীনতাকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা কার্যত অসম্ভব ছিল। সাদা চামড়ার আধিপত্য আসলে পুঁজিবাদীদের একটি কৌশল যার মধ্য দিয়ে শোষণের নতুন পদ্ধতি বিকশিত করতে তারা সদা সচেষ্ট। পুঁজিবাদী স্বাস্থ্যব্যবস্থা যে নৈতিকতার উপর ভিত্তি করে তা হলো মুনাফা কেন্দ্রিক। এই নৈতিকতা বিজ্ঞানের বিভিন্ন ধারাকে ব্যবহার করে পুঁজির বিকাশের জন্য। মানবতা এখানে মূল্যহীন।