E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

জর্জ ফ্লয়েড হত্যা

বর্ণবাদী হিংস্রতা

শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়


প্রায় একমাস পেরিয়ে গেলেও আমেরিকার সর্বোচ্চ জনসংখ্যার রাজ্য মিনেসোটা মিনিয়াপোলিস-এ কৃষ্ণাঙ্গ যুবক জর্জ ফ্লয়েড (৪৬) হত্যার বিরুদ্ধে দুনিয়া জুড়ে প্রতিবাদ আন্দোলনের তীব্রতা কমেনি একটুও। মার্কিন মুলুকে তা গণতন্ত্রের দাবিসহ বাঁক নিচ্ছে আরও বৃহত্তর সামাজিক-রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার আঙ্গিকে। ফ্লয়েড হত্যার পর অভূতপূর্ব সব ঘটনা ঘটছে। যেমন শুরুতেই হোয়াইট হাউস ঘিরে প্রতিবাদমুখর স্বতঃস্ফূর্ত জমায়েতের আঁচ থেকে বাঁচাতে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প-এর বাঙ্কারে আশ্রয় নেওয়া বা পেন্টাগন-এর অবরুদ্ধ হয়ে পড়ার মতো ঘটনা। আর সম্প্রতি ওয়াশিংটন ডিসি-তে হোয়াইট হাউসের নাকের ডগায় সপ্তম মার্কিন রাষ্ট্রপতি অ্যান্ড্রু জনসন-এর মূর্তিকে বর্ণবিদ্বেষের প্রতীক হিসেবে ‘চিহ্নিত’ করেছে জনতা। তারপর চলেছে দড়ি লাগিয়ে ‘...রাজা হবে খানখান’ স্টাইলে প্রতিবাদীদের সাম্প্রতিক টানা হ্যাঁচড়া। যা এখন আর বিস্ময়কর ঠেকছে না। আবার আফ্রিকার বহুদেশে মার্কিন দূতাবাস থেকে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু সম্পর্কে বিবৃতি দিয়ে বলা হচ্ছে, ‘কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়’। বব ডিলানের মতো ব্যক্তিত্ব এই নৃশংসতার বিরুদ্ধে মুখ খোলাতে সব মিলিয়ে প্রতিবাদের মাত্রায় ঘটে যাচ্ছে গুণগত পরিবর্তন।

প্রসঙ্গত, গত ২৫ মে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা প্রদেশের মিনিয়াপোলিসে পুলিশি বর্বরতার জেরে প্রকাশ্য দিবালোকে জনবহুল রাস্তায় নিরস্ত্র অবস্থায় সদ্য কাজ হারানে কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিন নাগরিক জর্জ ফ্লয়েড খুন হন পুলিশের হেফাজতে। জনৈক পথচারীর তোলা এই মধ্যযুগীয় নৃশংসতার ঘটনাটির ভিডিও ফুটেজ সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হতেই ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে বিশ্ব জনমত। প্রতিবাদে উত্তাল নাগরিক অবাধ্যতার ঢেউ আমেরিকার সমস্ত শহরের গণ্ডি পেরিয়ে গোটা পৃথিবীর রাজপথে পথে এখন বহমান। কারণ প্রশাসন নিয়ন্ত্রিত বর্ণবিদ্বেষের প্রাণঘাতী ঘটনা পুঁজিবাদী দুনিয়ায় কোনো ব্যতিক্রমী নজির নয়। তবে মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পাঁচ মাস আগেই ঘটে চলা এই লাগাতার অবস্থান-বিক্ষোভকে গভীর তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল।

ভিডিও ফুটেজটিতে দেখা গেছে, একটি অভিযোগের প্রেক্ষিতে গ্রেপ্তার করে পুলিশি হেফাজতে নিরস্ত্র জর্জ ফ্লয়েড’কে মাটিতে ফেলে শ্বেতাঙ্গ মার্কিন পুলিশ আধিকারিক ডেরেক শভিন তাঁর গলায় হাঁটু দিয়ে চাপ দিতে থাকেন। প্রতিরোধহীন অবস্থায় প্রায় ৮ মিনিট ৪৬ সেকেন্ড ধরে জর্জ ফ্লয়েড কোনোক্রমে কয়েকবার বলেন ‘আই ক্যান নট ব্রিদ’ (আমি শ্বাস নিতে পারছি না)। কিছুক্ষণ পরে তাঁর মৃত্যু ঘটে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে। ওই পুলিশ আধিকারিকের তিন সহকর্মীর উপস্থিতিতেই এই হিংসার ঘটনা ঘটে। এই নৃশংস ঘটনার পর অভিযুক্ত পুলিশ আধিকারিক ডেরেক শভিন ও তার তিন সঙ্গী সকলেই অভিযুক্ত হয়েছে খুন এবং খুনের ঘটনায় যুক্ত থাকার দায়ে।


এরপরই কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের প্রতি অত্যাচারের প্রতিবাদে, সহমর্মিতায় মুখর হয় সভ্য দুনিয়া। ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটারস’ শিরোনামে শুরু হয় আন্দোলন। যিনি কখনও কোনও বিক্ষোভ সমাবেশে যোগ দেননি তেমন বহু মানুষ, এমনকি শ্বেতাঙ্গ মহল্লাগুলি থেকেও যোগ দিয়েছেন তাঁর বাড়ির কাছাকাছি চলতে থাকা বিক্ষোভস্থলে। তেমনই এক শ্বেতাঙ্গ মহিলা বলেছেন, ‘কালো মানুষেরা যখন লড়ছেন ক্রমাগত, তখন চুপ করে থাকতে থাকতে আমি ক্লান্ত’। এমনই সব ‘অস্বস্তিকর’ খবর ক্রমাগত উঠে আসছে পুঁজিবাদের পক্ষে থাকা ট্রাম্প ভজনায় অভ্যস্ত ‘দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’ সহ বিভিন্ন সংবাদপত্রে। আবার অভিবাসী শ্রমিকদের বড় অংশও যোগ দিচ্ছেন এই ‘প্রটেস্ট ফর রেশিয়াল জাস্টিস’ নামের সমাবেশগুলিতে।

প্রবল চাপের মুখে মার্কিন সরকার ঘটনার পরপরই পুলিশ প্রশাসনে সংস্কার আনার তোড়জোড়ের কথা প্রকাশ্যেই জানিয়েছেন। বলেছেন ট্রাম্পও। কিন্তু মার্কিন নাগরিকদের ক্ষোভ তাতে প্রশমিত হচ্ছে না। বৈষম্য এবং বর্ণবিদ্বেষ সংক্রান্ত পরিস্থিতি সে দেশে এমন এক উচ্চতায় পৌঁছেছে যে, আমেরিকার আমজনতার যাবতীয় ক্ষোভের সামগ্রিক বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে চলতে থাকা প্রতিবাদ সমাবেশগুলির মধ্য দিয়ে। এমনটাই বলছেন সমাজবিদ থেকে মার্কিন মনস্তত্ত্ব নিয়ে কাজ করা বিশিষ্টজনেরা।

আফ্রিকান-আমেরিকান মানুষদের উপর ঘটে চলা বিভিন্ন ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণের খতিয়ান মার্কিন মুলুকের পুরনো ক্ষতের জায়গা। আব্রাহাম লিঙ্কন, যিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ রাষ্ট্রপতি, তাঁর জমানায় কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকারের পক্ষে যে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা থাকার অঙ্গীকার করা হয়েছিল তা আজও অধরা। শুধু আমজনতার মধ্যে থাকা কৃষ্ণাঙ্গ মানুষই নন, মার্কিন মুলুকে পল রোবসন-এর মতো বিশ্ববন্দিত গায়ক বা মহম্মদ আলি’র মতো সর্বকালের অন্যতম সেরা মুষ্টিযোদ্ধাকেও কৃষ্ণাঙ্গ হবার জেরে হেনস্তা এবং অত্যাচারের শিকার হতে হয়েছে। শাসকের নিঃশব্দ ইশারায় তাদের ওপরেও প্রাণঘাতী হামলা ঘটেছে। কোনোক্রমে বেঁচেছেন তাঁরা। দক্ষিণপন্থী শাসকের কবজায় থাকা আজকের মার্কিন মুলুকে যা ঘটছে তা বহুদিনের অত্যাচারের অবদমিত বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করা হচ্ছে। পেরিয়ে আসা আধা দশকের সংখ্যাতত্ত্ব বলছে পরিস্থিতি ভয়াবহ। ২০১৪ সাল থেকে ঘটা কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর গুলি চালানোর ঘটনা সমূহের কাটাছেঁড়ার মধ্য দিয়ে উঠে আসছে উদ্বেগজনক তথ্য। আমেরিকায় পুলিশি নির্যাতনে মৃত্যুর সংখ্যা (১৮ থেকে ৪৪ বছর বয়সীদের ক্ষেত্রে) গত বছরে পেরিয়েছে এক হাজারের সীমানা, যেখানে মৃতের তালিকায় কৃষ্ণাঙ্গরা সংখ্যায় বেশি। আবার আমেরিকার তুলনায় ১০০ মিলিয়ন মানুষ বেশি বাস করেন এমন দেশ ব্রাজিলে, পুলিশি অত্যাচারে মৃত্যুর জন্য যা কুখ্যাত বলে প্রচার আছে সেখানে এই সংখ্যাটা আঠারোশো পেরিয়েছে। দৃশ্যতই মার্কিনীদের সঙ্কটটা গভীরতর। মার্কিন মুলুকে ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টি’ যতই মাথা উঁচু করে থাকুক না কেন, আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বিবিসি পরিসংখ্যান দিয়ে দেখিয়েছে যে পুলিশি অত্যাচারে কালো মানুষের জীবন হানি ঘটানোর পর ব্যবস্থা নেবার বাস্তবতা মাথা হেঁট করে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। ওই প্রতিবেদনের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ঘটনাগুলিতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অভিযুক্ত শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসাররা বেকসুর খালাস পেয়ে যাচ্ছেন খুনের অভিযোগ থেকে। অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের পুনর্বহাল করা হচ্ছে।

পুলিশের ভাবমূর্তি আমেরিকায় এখন এতটাই মলিন যে, জনপ্রিয় অনলাইন ভিডিও গেম ‘ফরট নাইট’-এর গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে যে পুলিশের গাড়ি ছিল, সেটা সরিয়ে দেওয়া হয়েছে রাতারাতি। আর তা নিয়ে তুমুল আলোচনা, হাসিঠাট্টা সোশ্যাল মিডিয়াতেও। ট্রাম্প-এর দশাও করুণ। একটি টিকটক ভিডিওতে মার্কিন তরুণরা আহ্বান জানিয়েছেন, ট্রাম্প-এর প্রচার সভার টিকিট সবাই কিনুন, কিন্তু কেউ যাবেন না! বয়কট করুন! ঘটছে এমনতর সব অভিনব ঘটনা। বিক্ষোভরত মানুষের মধ্যে করা একটি সমীক্ষার ফলাফল বলছে, মাত্র চার শতাংশ মানুষ দেশের গণতন্ত্রে সন্তুষ্ট। মূলত নাগরিক বিক্ষোভে ট্রাম্প সেনা পাঠানোয় মানুষ তার জমানার এহেন মূল্যায়ন করেছে। কিন্তু সমাজবিদরা বলছেন আরও ভিন্নতর প্রেক্ষিতের কথা। তাঁদের মতে, মার্কিন নাগরিকদের সাম্প্রতিক বিক্ষোভে চেনা ছকের বাইরের আদল দেখা যাচ্ছে। তা অনেকটা লাতিন আমেরিকার ঘরানার মতো, অর্থাৎ রাষ্ট্রের রীতিনীতি বদলে দেবার আহ্বানে দৃপ্ত। এতদিন উত্তর আমেরিকার আন্দোলনগুলি ছিল, ‘দেশের সংবিধান এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতির প্রতি আস্থাশীল’, ‘বাস্তবমুখী’, ‘নির্দিষ্ট লক্ষ্য কেন্দ্রিক’ এবং তার মধ্যে খুব কম সংখ্যকই ছিল ‘দেশব্যাপী সংঘটিত’, আর সেগুলি ‘সপ্তাহ পেরিয়েছেও খুব কম’। কিন্তু এখন সবটাই উলটো।

ঘটনাপ্রবাহে বেকুব বনে যাওয়া পুঁজিবাদের হেডকোয়ার্টারের অন্যতম মুখপাত্র ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল আরও কবুল করেছে যে ওয়াশিংটন ডিসি-তে তাঁবু গেড়ে থাকা মানুষের বিক্ষোভ এখন পুলিশের বাজেট বরাদ্দ ছাঁটাই করে স্বাস্থ্য, আবাসন ও শিশু কল্যাণ খাতে বাড়ানোর দাবিতে মুখর। তবে কোথাও কোথাও প্রথমদিকে এই সমস্ত প্রতিবাদ-বিক্ষোভ হিংস্র হলেও বেশিরভাগ অংশই শান্তিপূর্ণ ছিল। ট্রাম্প যতই হুমকি দিন না কেন মিলিটারি নামিয়ে পরিস্থিতি বাগে আনবেন, কর্মহীন, গরিব শ্রমজীবী মানুষ যারা এই বিক্ষোভের অন্যতম সূচিমুখ — তারা বিষয়টিকে অন্য খাতে বইয়ে দিয়েছেন। তাদের স্লোগান উঠে আসছে বৈষম্যের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের নীরবতার প্রসঙ্গ, গণতান্ত্রিক এবং সামাজিক অধিকারের প্রসঙ্গ। তাই পুলিশের সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধের সংখ্যাও এখন কমে গেছে বলে সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে। দেশের অ্যাটর্নি জেনারেল জানাচ্ছেন, ভাঙচুর আর চড়াও হবার ঘটনায় অভিযোগ নথিবদ্ধ করার ব্যাপারে আগে পুলিশ বাহিনীর মধ্যে যে উৎসাহ ছিল, এখন তা অনেকটাই কমে গেছে। কিন্তু এই ডামাডোলের মধ্যেই আটলান্টা প্রদেশে ১২ জুন ঘটেছে পুলিশের গুলিতে ২৭ বছর বয়সী কৃষ্ণাঙ্গ যুবক রেশারড ব্রুক-এর মৃত্যুর ঘটনা। ক্ষোভের আগুনে তাই ঘি পড়েছে আরও।

প্রশাসনিক সংস্কারের নামে যে প্রসাধনী সংস্কার পুলিশি পরিকাঠামোয় মার্কিন সরকার আনার দাবি করছে অহরহ, তা নিয়ে ব্যঙ্গ উঠে আসছে আমেরিকার বিশিষ্ট মননের পক্ষ থেকেও। দক্ষিণপন্থী শাসকের বিভেদমূলক পদক্ষেপসমূহের বিষফলের বীজ মার্কিন প্রশাসনের মধ্যে মহীরুহের আকার ধারণ করেছে বলে অভিযোগ। তাই নরেন্দ্র মোদীর ভারতে রোহিত ভেমুলা সহ দলিত এবং সংখ্যালঘু মানুষের মৃত্যুর ও হত্যার ঘটনার সঙ্গে সাযুজ্য দেখতে পাচ্ছেন অনেকেই।

তাই ট্রাম্পের প্রশাসনিক সংস্কারকে ব্যঙ্গ করে কেউ কেউ বলছেন, ট্রাম্প কি তবে পুলিশকে মিলিটারিতে পরিণত করতে চান? এদিকে সাদাদের প্রতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ ইয়োরোপ জুড়েও হরহামেশাই শোনা যায়। শোনা যায় কৃষ্ণাঙ্গ মানুষকে পুলিশি নির্যাতনের অজস্র ঘটনার কথাও। প্রশ্নগুলো সহজ তবে উত্তর দেওয়া মানা। ২০১৬ সালের নোবেলজয়ী সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব বব ডিলান জর্জ ফ্লয়েড-এর মৃত্যুর ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন তীব্রভাবে। ঘটনায় আলোড়িত নোবেল বিজেতা ডিলান ২০১৬ সালের পর এই প্রথম নিজস্ব ওয়েবসাইটের বাইরে কোনো সংবাদ মাধ্যমে সাক্ষাৎকারে মুখ খুললেন। ৭৯ বছর বয়স্ক মিনেসোটায় বেড়ে ওঠা এই গায়ক বলেছেন, ‘‘It sickened me no end to see George tortured to death like that,... It was beyond ugly. Let's hope that justice comes swift for the Floyd family and for the nation.’’