বৈষম্যপীড়িত বিশ্ব ও মানবোন্নয়ন প্রসঙ্গ
লালন ফকির
বর্তমান বিশ্বে অর্থনৈতিক বৈষম্যের প্রসঙ্গটি বহু আলোচিত। বিশেষত, বিগত শতাব্দীর আশির দশকের শুরু থেকে অর্থাৎ বিশ্বায়নের পর্বে এই বৈষম্য ক্রমবর্ধমান। এই আর্থিক বৈষম্য একদিকে যেমন একটি দেশের সাথে আর একটি দেশের মধ্যে রয়েছে, তেমনই রয়েছে একটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে। আবার একটি দেশের বিভিন্ন অংশের মধ্যে বৈষম্য রয়েছে। পুঁজিবাদের স্বাভাবিক নিয়মে বৈষম্যের সৃষ্টি এবং তার বাড়বাড়ন্ত ঘটে। তবে লগ্নিপুঁজির বাড়বাড়ন্তের যুগে এই প্রসঙ্গটি অর্জন করেছে এক নতুন মাত্রা।
বিগত কয়েকবছর ধরে মানব উন্নয়নকে পর্যন্ত এই বৈষম্য নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে চলেছে। এবং বিষয়টি বিশ্বের অর্থনীতিবিদ সমাজতত্ত্ববিদদের কাছেও আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। প্রসঙ্গটি সম্পর্কে আলোচনার পূর্বে মানব উন্নয়ন সম্পর্কে দু-চার কথা বলা প্রয়োজন।
বিগত শতাব্দীর আশির দশকের আগে পর্যন্ত একটি দেশের বৈষয়িক উন্নতির মাপকাঠি হিসাবে মাথা পিছু জাতীয় আয়কেই প্রধান মাপকাঠি রূপে চিহ্নিত করা হতো। অর্থাৎ একটি দেশ উন্নত কি উন্নত নয়, তা সংশ্লিষ্ট দেশটির মাথাপিছু জাতীয় আয়কে বিচার করে করা হতো। কিন্তু এই মাপকাঠির সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে নানান ধরনের সমালোচনা উঠতে শুরু করে। কারণ, জাতীয় আয়ের গড় হিসাব নির্দিষ্ট করার সময় দেশটির ধনী-দরিদ্রকে আলাদা করে বিচার করার ব্যবস্থা ছিল না। দেশের সবথেকে ধনী মানুষটির আয় এবং গরিব মানুষের আয়ের যোগফলের গড় নির্ণয় করে মাথাপিছু জাতীয় আয় নির্দিষ্ট করা হতো। এর ফলে প্রকৃত আর্থিক অবস্থা কখনই বোঝার সুযোগ ছিল না। দ্বিতীয়ত, এই পদ্ধতিতে জাতীয় আয় নির্ধারণের ফলে দেশের জাতীয় আয় সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষের আর্থ-সামাজিক জীবনে কীভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে তা বোঝার কোনো সুযোগ ছিল না। অর্থাৎ যে দেশের জাতীয় গড় আয় অনেক বেশি তাদের দেশের জনগণের জীবন যাত্রার মানও উন্নত হবে—এরকম নয়।
এই ধরনের অনেকরকম অসঙ্গতি বা বিকৃতির প্রসঙ্গ বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিবিদ এবং সমাজতত্ত্ববিদরা নির্দিষ্ট করেন। বলাই বাহুল্য এদের অধিকাংশই হলেন বামপন্থী মনোভাবাপন্ন বা মার্কসবাদী চিন্তার অধিকারী। এদের চাপেই শেষ পর্যন্ত ১৯৯১ সাল থেকে রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিয়ন্ত্রণে ইউনাইটেড নেশনস ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের (ইউএনডিপি) পরিচালনায় মানব উন্নয়নসূচক তৈরি হয়। এর ভিত্তিতে ১৯৯১ সালে প্রথম মানব উন্নয়ন রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এই রিপোর্ট প্রকাশনার ক্ষেত্রে এই উপমহাদেশের দুই অর্থনীতিবিদ ডঃ মকবুল হক এবং ডঃ অমর্ত্য সেন মহাশয়দের উদ্যোগ ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
প্রথম মানব উন্নয়ন সূচক নির্মাণের ক্ষেত্রে যে সমস্ত বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল তার মধ্যে ছিল স্বাক্ষরতার হার, নারীদের শিক্ষার হার, প্রসূতি মৃত্যু, কর্মসংস্থানের সূচক প্রভৃতি। তারই ভিত্তিতে নির্মিত হয়েছিল মানব উন্নয়ন সূচক। পরবর্তীকালে অর্থাৎ নব্বই দশকের মাঝামাঝি এই সূচকের সাথে নতুন কিছু বিষয় যুক্ত হয়। বিশেষত, মহিলাদের জন্য যেমন কর্মসংস্থানের প্রসঙ্গ, শিশু মৃত্যুর হার প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত হয়। এগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করে নির্মাণ করা হয় মানব উন্নয়নে সূচক-দুই।
গত শতাব্দীর শেষের দিকে ঘোষিত হয় স্থিতিমূলক উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলস (এসডিজি) এখানে মানব উন্নয়নের বিভিন্ন দিকের লক্ষ্যমাত্রা আগামী দশ-পনেরো বছরের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়। এর মধ্যে ছিল নিরক্ষরতা দূরীকরণ, নিরাময়যোগ্য রোগের মৃত্যুহার হ্রাস করা, নারীদের ক্ষমতায়ন প্রভৃতি বিষয়।
বিশিষ্ট গবেষক এবং বিশেষজ্ঞদের মতে মানব উন্নয়নের সামনে প্রধানত দু’টি চ্যালেঞ্জ সমুপস্থিত। এর একটি হলো কাঠামোগত পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ এবং দ্বিতীয়টি হলো মৌলিক চ্যালেঞ্জ। প্রথম ক্ষেত্রে সমস্যাটি হলো নিম্নমানের উৎপাদনশীলতার ক্ষেত্র থেকে আধুনিক এবং অধিক উৎপাদনশীলতার ক্ষেত্রে পুঁজির বিনিয়োগ বৃদ্ধি। দ্বিতীয় সমস্যাটি হলো মানবসম্পদ এবং পরিকাঠামো নির্মাণের লক্ষ্যে অধিক বিনিয়োগ না হওয়া। মানব উন্নয়নের সামনে এটি একটি বড়ো ধরনের চ্যালেঞ্জ।
বিশেষজ্ঞদের মতে মানব উন্নয়নের সামনে আরও বেশকিছু মাত্রার চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এরমধ্যে অন্যতম হলো অসাম্য বা বৈষম্যের সমস্যা। অসাম্য বৃদ্ধি অনেকক্ষেত্রেই স্বাধীনতার ক্ষেত্র বা পছন্দ নির্বাচনের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে থাকে। মাথাপিছু জিডিপি নির্ধারণের ক্ষেত্রে বৈষম্যের সূচক হলো ‘গিনি কৈফিসিয়েন্ট’ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ১৯৮৮ সালে এই সূচক ছিল ০.৬৮, কিন্তু ২০১৩ সালে তা ০.৬২ হয়। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, বিভিন্ন দেশের মধ্যে বৈষম্য ক্রমবর্ধমান। আন্তর্জাতিকস্তরে বৈষম্য বৃদ্ধির মূলে রয়েছে উচ্চদক্ষতা সম্পন্ন আধুনিক প্রযুক্তি। বিশেষজ্ঞদের ধারণা প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও প্রয়োগ অনেক ক্ষেত্রেই বৈষম্য বৃদ্ধির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এছাড়াও স্থায়ী উন্নয়নের অভাব, আবহাওয়ার পরিবর্তন এবং বৈষম্যের কারণে উন্নয়নের ধারণার মধ্যে পরিবর্তন প্রয়োজন বলে বিশেষজ্ঞদের একাংশের ধারণা। এদের মতে মানব উন্নয়নকে বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে বিচার করা প্রয়োজন, যাতে একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করা যায়। এরজন্য উন্নয়নের ধারা এমনভাবে পুনর্বিন্যাস করতে হবে যাতে তা বৈষম্য দূর করতে পারে, উন্নয়ন স্থিতিমূলক হতে পারে এবং ক্ষমতায়নের পক্ষে তা ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে।
মানব উন্নয়নের ক্ষেত্রে সামাজিক ক্ষেত্রে সরকারি ব্যয়বরাদ্দ ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি করার প্রসঙ্গটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। লগ্নিপুঁজির পথ ধরে বর্তমান পুঁজিবাদী দেশগুলিতে এই ক্ষেত্রটি ব্যাপকভাবে আক্রান্ত। বিশেষত খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষা, অপুষ্টি দূরীকরণ প্রভৃতি জরুরি ক্ষেত্রে সরকারি বিনিয়োগ শুধু এক জায়গাতে আটকে রয়েছে তাই নয়, অনেক ক্ষেত্রে বিনিয়োগ ক্রমহ্রাসমানও বটে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে বেসরকারিকরণের দাপট। এসব ক্ষেত্রে সরকার তার ভূমিকা হ্রাস করছে, পুরোপুরি প্রত্যাহার করে নেওয়ার পর বেসরকারি সংস্থাগুলি সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। এদের একমাত্র লক্ষ্য হলো মুনাফা, অতিমুনাফা অর্জন। ফলে দরিদ্র মানুষেরা মানব উন্নয়নের প্রয়োজনীয় উপাদানগুলি থেকে পিছিয়ে পড়ছে।
বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের অন্যতম শিকার হলেন নারী সমাজ। বিশিষ্ট অধ্যাপক ডঃ অমর্ত্য সেন এবং জাঁদ্রেজে এক পুস্তকে ভারতে দলিত মহিলাদের অবস্থান বলতে গিয়ে বলেছেন : ‘‘একজন দলিতশ্রেণির গরিব ছাত্রী যে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখে, তাকে বিদ্যালয়স্তর থেকেই শিক্ষা অর্জনের জন্য কঠোর সংগ্রাম করতে হয়। শুধু তাই নয় সমাজে মহিলা, দলিত এবং গরিব হওয়ায় তাকে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা হয়’’। অর্থাৎ তিন ধরনের বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির সে শিকার হচ্ছে।
পূর্বোক্ত প্রেক্ষাপটে একথা বলা প্রয়োজন যে, মানব উন্নয়ন সূচকে বিভিন্ন দেশের মধ্যে যে বৈষম্য রয়েছে তাকে দূর করতে এবং রাষ্ট্রসঙ্ঘের নির্ধারিত সহস্রাব্দ লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে সমাজ থেকে বৈষম্য দূরীকরণ একান্তই প্রয়োজন এবং পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় তা প্রায় অসম্ভব। তাই বিকল্প সমাজতন্ত্র নির্মাণের লক্ষ্যে সংগ্রাম গড়ে তোলা এক্ষেত্রে একান্তই জরুরি।