E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

কমিউনিস্ট পার্টি অফ ব্রিটেন-এর ৫৬তম পার্টি কংগ্রেসের আহ্বান

‘সংকট হলো পুঁজিবাদ, সমাজবাদের পথ ধরো’


নিজস্ব সংবাদদাতাঃ ‘সংকট হলো পুঁজিবাদ, সমাজবাদের পথ ধরো’ - ব্রেক্সিট-পরবর্তী সময়ে এই আহ্বান জানিয়ে সম্প্রতি লন্ডনে আয়োজিত হলো কমিউনিস্ট পার্টি অফ ব্রিটেন (সিপিবি)’র ৫৬ তম কংগ্রেস। পার্টির সদর দপ্তর রাস্কিন হাউসে এই কংগ্রেস আয়োজিত হয়। ব্রিটেনের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ১৪০ জন প্রতিনিধি এই কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলেন। মানবতা প্রতিদিন যে সমস্ত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে তার বিশ্লেষণ, সে সম্পর্কে বিতর্ক এবং তার উপযুক্ত জবাব দেবার প্রস্তাবিত পথ প্রসঙ্গে বামপন্থী হস্তক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা এবং গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে আলোচিত হয়েছে এই কংগ্রেসে।

ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির এই কংগ্রেস গত এক দশকের নিরিখে বৃহত্তম বলে ধরা হচ্ছে, তার কারণ গত পার্টি কংগ্রেস যা তিন বছর আগে অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তার তুলনায় পার্টির সদস্য সংখ্যা প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ বেড়েছে।

বিদেশ থেকে যে সমস্ত কমিউনিস্ট পার্টি এবং সংগঠন এই কংগ্রেসে তাদের প্রতিনিধি পাঠিয়েছে তার মধ্যে রয়েছে সিপিআই(এম), পর্তুগিজ কমিউনিস্ট পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টি অফ আয়ারল্যান্ড, কমিউনিস্ট পার্টি অফ দা রাশিয়ান ফেডারেশন, কিউবা দূতাবাসের আধিকারিকগণ, চীন, ভিয়েতনাম প্রভৃতি। আফগানিস্তান, ইরান, স্পেনের বিভিন্ন কমিউনিস্ট পার্টিগুলি ও কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন। দক্ষিণ আফ্রিকা, ইজরায়েল, সাইপ্রাস, ভেনেজুয়েলা - এই সব দেশের প্রতিনিধিরা ভিডিও কনফারেন্সিং-এর মাধ্যমে কংগ্রেসে যোগ দেন। বহু বছরের সহমর্মিতার ইতিহাসকে বজায় রেখে মধ্য এশিয়ার দেশগুলো এবং আফ্রিকার বহু দেশ যেখানে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ - এসেছিলেন সেখানকার প্রতিনিধিরাও।

বিদায়ী কমিউনিস্ট পার্টির কার্যকরী সমিতির পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক বিষয়ক যে প্রস্তাবটি রাখা হয়েছে সেখানে সাম্রাজ্যবাদকে যুদ্ধ থেকে বিরত রাখার বিষয়টিকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। বিশ্লেষণে তুলে ধরা হয়েছে কোভিড মহামারীতে এবং পৃথিবীর উষ্ণায়নের জেরে ব্যাপক বৈষম্যের শিকার নিপীড়িত শ্রেণির মানুষের কথা। এই প্রসঙ্গে পার্টি শাখা, জেলা এবং স্কটিশ এবং ওয়েলস স্তরের শাখাগুলির থেকে প্রচুর সংশোধনী জমা পড়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের জেরে যে নিদারুণ পরিস্থিতির শিকার হচ্ছেন মানুষ সে সম্পর্কে ও নয়া শীতল যুদ্ধ শুরুর ক্ষেত্রে চীনকে ঘিরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পদক্ষেপের বিষয়টি আলোচনা হয়।

ওই প্রতিবেদনে এবং প্রতিবেদন সংক্রান্ত আলোচনায় আরও উঠে এসেছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শোষণের মধ্য দিয়ে মার্কিন লগ্নিপুঁজি যেভাবে ব্যাপক মুনাফা অর্জন করছে এবং বৃহত্তর শক্তি হিসেবে চীনের উত্থান যা আগামী দশকের মধ্যেই বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হতে চলেছে সে প্রসঙ্গ। ব্রিটেন সহ সাম্রাজ্যবাদের বিভিন্ন ছোটোখাটো দোসর দেশ জাপান, ফ্রান্স এবং কম মাত্রায় হলেও জার্মানিও এই উত্থানের জেরে ভীত হচ্ছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, পারস্পরিক শত্রুতা থাকলেও তারা চীনের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ এবং রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডাকে এক নতুন স্তরে নিয়ে গেছে। দক্ষিণ চীন সাগর এলাকায় পশ্চিমী যুদ্ধজাহাজগুলো ইয়োরোপিয়ান সামরিক পরিকাঠামো জোরদার করছে। ব্রিটেনের নিউক্লিয় শক্তি ভাণ্ডারের সম্প্রসারণ এবং মার্কিন-ব্রিটিশ-অস্ট্রেলিয়ার যৌথ আঁতাত অস্ট্রেলিয়া এবং এশিয়া প্যাসিফিক এলাকায় ন্যাটোর শক্তি বৃদ্ধির বিষয়টিও তুলে ধরা হয়েছে।

একই সময়ে চীনের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে উন্নয়নশীল দেশগুলোর সঙ্গে আর্থিক সহযোগিতা সংক্রান্ত সম্পর্ক গড়ে তোলার বিষয়টি প্রস্তাবে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, এর ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলিকে নয়া শীতল যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটেন অস্থিতিশীল ইয়োরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং ন্যাটো’র পক্ষে আনার বিষয়টি দুরূহ হয়ে পড়েছে। এর পাশাপাশি পার্টি কংগ্রেসে আলোচিত হয়েছে মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার দেশগুলিতে পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সম্প্রসারণের ফলে সেখানে উদ্ভূত বিভিন্ন পরিস্থিতির কথা।

একচেটিয়া পুঁজিবাদের বাজারের কবল থেকে গরিব সাধারণ শ্রমজীবীদের রেহাই দিতে গণ আন্দোলন গড়ে তোলার কথাও উচ্চারিত হয়েছে। স্লোগান তোলা হয়েছে, ‘সংকট হলো পুঁজিবাদ, তাই সমাজবাদের পথ ধরো’ - কংগ্রেস থেকে এই আহ্বান জানানো হয়েছে ব্রিটেনের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে দেশের উন্নয়নের তাগিদ।

সম্মেলনে বিভিন্ন প্রস্তাবের মধ্যে রাখা হয়েছে ব্রিটেনে বসবাসকারী ভারতীয় শ্রমিক সংগঠন এবং বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স কাউন্সিলের সঙ্গে ব্রিটেনে বর্ণবাদী অভিবাসী এবং জাতীয়তার আইনের প্রতিবাদের প্রসঙ্গে আলোচনার বিষয়টিকেও।

সিপিবি’র পার্টি কংগ্রেসে বক্তব্য রাখছেন সীতারাম ইয়েচুরি।

কমিউনিস্ট পার্টি অফ ব্রিটেন-এর ৫৬ তম পার্টি কংগ্রেসে যোগ দেন সিপিআই(এম) সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। সম্মেলনকে অভিনন্দন জানিয়ে তিনি বলেন, কোভিড পরিস্থিতি ছাড়াও বর্তমান আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে ধনতন্ত্রের সংকট অত্যন্ত তীব্রভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে গত দু'বছরে এবং তা দেউলিয়া হয়ে গেছে বিশেষত নয়াউদারবাদের কারণে। কিন্তু একই সঙ্গে নয়াউদারবাদের আক্রমণ লাগাতার চলছে। উন্নত দেশগুলিতে স্টিমুলাস প্যাকেজ দেওয়া হচ্ছে। আর সমস্ত তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলিকে চাপ দেওয়া হচ্ছে নয়াউদারবাদের দাওয়াই অনুসরণ করতে। এর ফলে যেটা হচ্ছে তা হলো, ভারতের মতো দেশে বৃহৎ পুঁজিপতি এবং কর্পোরেটদের রমরমা হচ্ছে। আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের কার্যত লুট এবং বেসরকারিকরণ চলছে এমন মাত্রায় যা গত সাত দশকে আমরা দেখিনি।

তিনি বলেন, নয়াউদারবাদের যে পদ্ধতিতে দেশে স্টিমুলাস প্যাকেজের মাধ্যমে অর্থের জোগান দিচ্ছে তা হলো, সরকার এই অর্থ সংগ্রহ করতে বাজারে স্টক মার্কেটে বন্ড ছাড়ছে যা স্টক মার্কেটকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তুলছে। এইভাবে ধনী আরও ধনী হচ্ছে এবং গরিব আরও গরিব হচ্ছে। স্বাস্থ্য সংকটের এই পরিস্থিতিতে নয়াউদারবাদ এই কায়দায় তা কার্যকর করছে যার বিরুদ্ধে দেশের জনগণ স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। নয়াউদারবাদ এবং শোষণের বিরুদ্ধে এই প্রতিবাদকে স্তিমিত করতে দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক শক্তি এবং দেশের দক্ষিণপন্থী সরকারগুলি জাত্যভিমানপূর্ণ, উৎকট স্বদেশ ভক্তির আবেগপূর্ণ স্লোগান ব্যবহার করে খেটে খাওয়া মানুষের ঐক্য এবং সংগ্রামকে বিভাজিত করছে এবং উৎপাটিত করার চেষ্টা করছে।

তিনি বলেন, দুনিয়া জুড়ে এই দক্ষিণপন্থী মোড় যা ভারতে গত ৭ বছর ধরে অত্যন্ত উচ্চকিত রয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। এই দক্ষিণপন্থী সরকার ভারতে ধর্মীয় উত্তেজনা এবং জাতপাতের দ্বন্দ্ব সাম্প্রদায়িকতাকে যা আমরা ভারতে বলি সাম্প্রদায়িকতা তাকে উৎসাহিত করছে,যা দেশের শ্রমজীবী মানুষের ঐক্যকে বিনষ্ট করছে এবং ভারতের সাংবিধানিক কাঠামোকে ধ্বংস করছে। এখন এটা ভারতের সংবিধান এবং ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের পক্ষে অত্যন্ত গভীর আঘাত যার বিরুদ্ধে ভারতের জনগণ সংগ্রামরত।

তিনি দক্ষিণপন্থীদের আক্রমণ প্রসঙ্গে আরও বলেন, ভারতে এখন সাধারণ মানুষের জীবন থেকে যুক্তিকে সরিয়ে অযৌক্তিকতা বেশি শক্তিশালী। যুক্তিহীনতাকে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে যুক্তির বদলে। ভারতের দক্ষিণপন্থী ফ্যাসিবাদী শক্তি দেখছে যে সিপিআই(এম) তাদের মূল বাধা, তাই আমাদের পার্টি'র ওপর নেমে আসছে শারীরিক এবং মতাদর্শগত হিংস্র আক্রমণ। এটা নতুন কিছু নয়। তারা তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করেও পরাস্ত হয়েছে কেরালার এলডিএফ সরকারের পতন ঘটাতে। এমনকি পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরার মতো রাজ্যগুলিতে কমরেডরা ওই শক্তির হিংস্র আক্রমণের মোকাবিলা করছেন।

তিনি বলেন, ইতিহাসের পুনর্লিখন শুরু হয়েছে। এই ইতিহাসের পুনর্লিখনের বিষয়টিতে আমি আনন্দিত যে ব্রিটেনে, আমার বিশ্বাস ওয়েলসে শুরু করা হয়েছে ব্রিটেনের উপনিবেশিক অভিজ্ঞতার ইতিহাস পড়া। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ইতিহাস পড়ানো এটা অত্যন্ত ইতিবাচক পদক্ষেপ এবং আমি আশা করি এটা ধারাবাহিক থাকবে। কারণ ইতিহাস সঠিকভাবে না জানা থাকলে আমরা কমিউনিস্টরা সবাই জানি, আমাদের ভবিষ্যৎ পথনির্দেশ প্রস্তুত করতে পারব না।

তিনি ভারতে শ্রমিকশ্রেণি এবং কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম এবং ঐক্যের প্রসঙ্গ তুলে বলেন, কৃষকরা কৃষি বিরোধী আইন যা কর্পোরেট এবং বহুজাতিকদের পক্ষে সরকার এনেছিল তা বাতিল করতে এক বছর ধরে সংগ্রামরত। এই আন্দোলনের প্রতি গত এক বছরে শ্রমিকশ্রেণি উঁচু মাপের সহমর্মিতা দেখিয়েছে যা আমরা দেখেছি। এর মধ্য দিয়ে শ্রমিক-কৃষক আঁতাতের যে বীজ তা বোনা শুরু হয়েছে। আমরা এখন এই চ্যালেঞ্জ এবং সংগ্রামের মধ্যে রয়েছি।

তিনি বলেন আন্তর্জাতিক সহমর্মিতার গুরুত্ব হলো শ্রমিকশ্রেণির অধিকার রক্ষা যা এই সময় আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। ভারতীয় এবং ব্রিটিশ কমিউনিস্টদের ঐক্যের সংযোগ রয়েছে গত ১০০ বছর ধরে। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় বহু ব্রিটিশ কমিউনিস্ট ভারতীয় কমিউনিস্টদের সঙ্গে ঔপনিবেশিক শাসকের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন। ভারতীয়রা যারা ব্রিটেনে রয়েছেন তারা বিভিন্ন সংস্থা এবং মঞ্চের মাধ্যমে বামপন্থী আন্দোলন এবং ট্রেড ইউনিয়নের সঙ্গে, শ্রমিকশ্রেণির বিভিন্ন সংগ্রামে এখানে যুক্ত। এই ঐতিহ্যকে ধরে রেখে আমরা আমাদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামকে আরও শক্তিশালী করব আগামী দিনে।