আয় ও সম্পদের ক্রমবর্ধমান বৈষম্য এবং মানবোন্নয়ন
লালন ফকির
অস্ট্রিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহরের নাম গ্রাজ। সম্প্রতি এই শহরের মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন অস্ট্রিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি (কেপিও)’র নেত্রী এলকে কাহর। গ্রাজ শহরে অধিবাসীর সংখ্যা তিন লক্ষের মতো। এদেশের সর্ববৃহৎ শহর অবশ্য রাজধানী ভিয়েনা। এই নির্বাচনী ফলাফলে অনেকের চোখ যেমন কপালে উঠেছে তেমনই এই জয়ে অনুপ্রাণিত হয়ে সংহত হওয়ার চেষ্টা করছে ইয়োরোপের বাম আন্দোলন। গ্রাজের সিটি কাউন্সিল গত ১৭ নভেম্বর কাহরকে মেয়র হিসাবে নির্বাচিত করার জন্য ভোট দিয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে অস্ট্রিয়ার কোনো বড়ো শহরে এমনি এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদে প্রথম কমিউনিস্ট নেতার জয় বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। কাহর অস্ট্রিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির একজন সদস্য। তিনি গ্রাজের পৌরসভা নির্বাচনে ২৮.৯ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়লাভ করেছেন। মধ্য-ডান পিপলস পার্টি ২৫.৭ শতাংশ ভোট পেয়েছে। এখানে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচনী ব্যবস্থা রয়েছে।
কেন গ্রাজ শহরে কমিউনিস্টদের জয় কিছুটা হলেও উল্লেখযোগ্য। জার্মানির মতোই ডয়েচ ভাষায় কথা বলে অস্ট্রিয়বাসীরা। হিটলারের প্রথম লক্ষ্য ছিল অস্ট্রিয়া দখল। প্রায় আল্পস পর্বতমালা ঘেরা এই দেশটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের তুলনা মেলা ভার। দেশটি জার্মানির বাভারিয়ান অঞ্চলের কাছাকাছি। এখনও বাভারিয়া অঞ্চলের জার্মান জাতীয়তাবাদের গোঁড়ামি সর্বজনবিদিত। সেই অর্থে বৃহত্তর জার্মানি গঠন (Anschluss) ছিল হিটলারের লক্ষ্য। এই গোঁড়ামিকে পুঁজি করে হিটলারের উত্থান এবং জার্মান ভাষাভাষী অঞ্চলকে একত্রিত করার নেশা জার্মান এবং অস্ট্রিয়বাসীদের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়।
কমিউনিস্টদের জয় এই গোঁড়ামির বিরুদ্ধে এক চপেটাঘাত। কয়েক দশক ধরেই কমিউনিস্ট পার্টি অস্ট্রিয়ার স্থানীয় পর্যায়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তি এবং কাহর নিজেই প্রায় ৩০ বছর ধরে পার্টির সদস্য।
ইয়োরোপের প্রায় প্রতিটি দেশে সোশ্যাল ডেমোক্রাটদের উপস্থিতি কিছুটা উপলব্ধি করা যায়। মার্কসবাদ-কে সংশোধন করে ‘সোনার পাথর বাটি’র মতো সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চায় ওঁরা। অবশ্য ওঁদের সমাজতন্ত্রের ধারণা কেবল সামাজিক সুরক্ষা প্রতিষ্ঠা এবং মুক্ত বাজার নীতির বিরোধিতার মধ্যে আবদ্ধ। মার্কসবাদের পথ এঁরা অনেকদিনই ত্যাগ করেছে। দেশে দেশে শ্রমিকের চরিত্র পালটেছে ঠিকই কিন্তু শ্রমিকশ্রেণির চরিত্র পালটায়নি। আজও উদ্বৃত্ত মূল্য তৈরির মধ্যদিয়ে শ্রমিকরা শোষিত হয়। এখন পুঁজি আরও বেশি বিশ্বায়িত। লেনিনের বাখ্যার মতো সাম্রাজ্যবাদ আরও সংহত এবং আগ্রাসী। তবু সোশ্যাল ডেমোক্রাটদের চেতনা এক বদ্ধ ঘরের মধ্যে অ্যাটকে আছে।
অস্ট্রিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি কিন্তু মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিনের পথ ধরেই চলেছে। অস্ট্রিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি তৈরি হয় ১৯১৮ সালে। এই অর্থে কেপিও পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন কমিউনিস্ট পার্টি। ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ অর্থাৎ নাজি জমানায় এই দল নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। নাজিদের বিরুদ্ধে অবরোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এদের উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল। বর্তমান সময়ে পুঁজির বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অস্ট্রিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা উজ্জ্বল। গ্রাজ শহরে এই জয় ইয়োরোপের মুক্তিকামী মানুষের সামনে এক আলোকবর্তিকা হিসেবেই আগামীদিনে কাজ করবে।