কোভিড ১৯-এ বিপর্যস্ত ব্রাজিলে মরুদ্যান মারানহাও
ব্রাজিলের মারানহাও প্রদেশেই প্রথম লকডাউন ঘোষণা হয়।
গোটা দুনিয়া এখন ত্রস্ত কোভিড-১৯ অতিমারীর মারণ দাপটে। ২৬ আগস্ট পর্যন্ত পাওয়া পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ২৩ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ এ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন এই গ্রহে। যেখানে শীর্ষে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আর তারপরেই ব্রাজিল এবং আমাদের ভারতের স্থান। করোনা মোকাবিলায় ট্রাম্প, বোলসোনারো এবং নরেন্দ্র মোদী-এই দক্ষিণপন্থী শাসকত্রয়ীর সামগ্রিক ব্যর্থতার এই প্রতিফলনের উল্টোদিকে রয়েছে বেশ কিছু আশাব্যঞ্জক দিকও। চীন, ভিয়েতনাম, কিউবার মতো সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর সীমিত ক্ষমতার পরিসরে উজ্জ্বল বামপন্থী বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চলা ভারতের কেরালার সরকারের মতোই ব্রাজিলের মারানহাও প্রদেশ। এখানে সম্প্রতি টানা প্রায় ৪০ দিন ধরে কোভিড-১৯ জনিত মৃত্যুহার ১ শতাংশেরও কম ছিল। এই প্রদেশে রয়েছে কমিউনিস্ট পার্টি অব ব্রাজিল-এর নেতৃত্বে কোয়ালিশন সরকার, যার গভর্নর কমিউনিস্ট নেতা ফ্লাভিও দিনো। অর্থনৈতিক দিক থেকে একটু পিছিয়ে থাকা ব্রাজিলের এই প্রদেশটি এই মুহূর্তে কোভিড-১৯ অতিমারী নিয়ন্ত্রণে উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক শিরোনামে।
ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি জেয়ার বোলসোনারো প্রথম থেকেই স্বাস্থ্যবিধি সংক্রান্ত সর্তকতা অবলম্বনের ক্ষেত্রে উদাসীন ছিলেন। দেশে লকডাউন চালু করতে চাননি। গোটা বিষয়টিকে উপেক্ষা করে নরেন্দ্র মোদীর মতোই নানান অবৈজ্ঞানিক মন্তব্য করেছেন রোগ সম্পর্কে। সংক্রমণের প্রথমদিকে গুরুত্ব দেননি বেড়ে চলা রোগাক্রান্তের হারকে। গোটা বিষয়টিকে গুরুত্বহীন করে দেবার জন্য তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোতে এ হলো কেন্দ্রীয় সরকারের থেকে বাড়তি টাকা নেবার ফিকির। কিন্তু মারানহাও-এর কমিউনিস্ট কোয়ালিশন সরকার প্রথম থেকেই লকডাউন চালু করেছে ব্রাজিলে। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী কোভিড পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছে।
২০১৪ সাল থেকে লাগাতার দু’টি নির্বাচনী পর্বে এই মারানহাও-তে বামপন্থীরা জিতেছেন। ফ্লাভিও দিনো কমিউনিস্ট পার্টি অব ব্রাজিল-এর প্রার্থী হিসেবে মারানহাও প্রদেশে ৬৩ শতাংশ ভোট পেয়ে জিতে গভর্নর নির্বাচিত হয়েছেন। প্রসঙ্গত, ব্রাজিলে এই মুহূর্তে প্রায় ৩.৬ মিলিয়ন মানুষ কোভিড আক্রান্ত। ইতিমধ্যেই সেখানে এক লক্ষ ১৫ হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এহেন একটি পরিস্থিতিতে মারানহাও রাজ্যের পরিসংখ্যান চমকপ্রদ। ব্রাজিলের উত্তর-পূর্ব অংশের এই প্রদেশটিতে প্রায় ৬৯ লক্ষ মানুষ বসবাস করেন। সেখানে এ পর্যন্ত ১৪ লক্ষের বেশি মানুষ কোভিড আক্রান্ত হলেও মৃতের সংখ্যা ১হাজার ৩৬৫ জন। আর প্রতি ৪৮ জনে আক্রান্ত ১ জন এবং ২,০৮৫ জন নাগরিক পিছু মৃত্যুর হার ১। সে দেশের জাতীয় গড়ের তুলনায় এই মান অনেক কম। ব্রাজিলের মতো একটি বড়ো দেশ যেখানে দক্ষিণপন্থী রাষ্ট্রপতি জেয়ার বোলসোনারো কোভিড-১৯ অতিমারী নিয়ন্ত্রণ করতে চূড়ান্ত ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন সেখানে কমিউনিস্ট পার্টি অব ব্রাজিলের নেতৃত্বে একটি কোয়ালিশন সরকার যে দক্ষতার সঙ্গে এই অতিমারীকে নিয়ন্ত্রণ করেছে, তা গোটা দেশের কাছেই আশার আলো হিসেবে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। পশ্চিমী সংবাদ মাধ্যমের একাংশ মারানহাওতে ফ্লাভিও দিনো পরিচালিত সরকারের ভুমিকার প্রশংসা করার পাশাপাশি বলেছে, ব্রাজিলে জেয়ার বোলসোনারোর এই মুহূর্তে বিরোধী রাজনীতির মূল ভূমিকানির্বাহী হিসেবে উঠে এসেছেন ফ্লাভিও দিনো।
কমিউনিস্ট পার্টি অব ব্রাজিলের সম্পাদক কারলোস রুলা বলেছেন, ‘ধীরে ধীরে মারানহাও এই কোভিড-১৯-জনিত অতিমারী পরিস্থিতি থেকে স্থিতিশীলতা অর্জন করছে। তবুও এই মারণ রোগকে মোকাবিলা করার জন্য নজরদারি জারি রাখা অত্যন্ত জরুরি। অতএব আরও একবার আমি আপনাদের বলছি বিজ্ঞানে বিশ্বাস রাখুন, স্বাস্থ্যকর্মীদের কথা শুনুন। দূরত্ব বজায় রাখার আইন মেনে চলুন। জনবহুল স্থানে যাবেন না। অতিমারীর প্রভাব খর্ব করার জন্য আমাদের রাজ্যে আমরা দিন-রাত মেহনত করছি’।
মারানহাও কোভিড-১৯ অতিমারী রুখতে প্রদেশভিত্তিক সঠিক এবং উন্নততর ব্যবস্থা নেবার সূচক অনুযায়ী ব্রাজিলে প্রথম স্থান অধিকার করেছে।এই প্রদেশের স্বাস্থ্য দপ্তর থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই প্রদেশ হাসপাতালে কোভিড জনিত স্থানান্তরকরণ বা ভর্তির ক্ষেত্রে রোগীদের সংখ্যায় উল্লেখযোগ্য হ্রাস ঘটাতে পেরেছে। বর্তমানে ৪৭৮ জন মানুষ হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। কোভিড-১৯ জনিত অতিমারীর চূড়ান্ত পরিস্থিতিতেও এখানে ১,৭০০ মানুষ হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। প্রদেশ সরকারের সাফল্য বোঝা যাবে নিচের কিছু উল্লেখ থেকে। এই প্রদেশে এখন ৪৩.৯৪ শতাংশ আইসিইউ বেড-এ রোগী ভর্তি। যেখানে ক্লিনিক্যাল বেডগুলির ২৮.১৫ শতাংশে রোগী ভর্তি রয়েছে। কোভিড-১৯ পরিস্থিতিজনিত বিশেষ রোগীশয্যার সংখ্যা ধীরে ধীরে কমিয়ে ফেলা গেছে এখানে। চলতি আগস্ট মাসেই মারান প্রদেশের কোভিড-১৯ জনিত মৃত্যুহার ২.৪৯ শতাংশ। যা এপ্রিল মাসেও আক্রান্তের নিরিখে ছিল ১০.৬৭ শতাংশ। কোভিড-১৯ সংক্রান্ত বিশ্লেষণধর্মী একটি প্রকল্পের অধীনে সম্প্রতি জাতীয়স্তরে একটি সমীক্ষা রিপোর্ট সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। সেন্টার ফর পাবলিক লিডারশিপ এই সমীক্ষা পরিচালনা করেছে ব্রাজিলের সাতাশটি যুক্ত প্রদেশের মধ্যে। ২৮ জুলাই সমীক্ষায় প্রাপ্ত তথ্য সংক্রান্ত গবেষণা সমাপ্ত হয়েছে। সমীক্ষার মূল্যায়নের ক্ষেত্রে মূলত ন’টি বিষয়ের পরিসংখ্যান বিবেচনা করা হয়েছে। এই ন’টি বিষয়ের মধ্যে রয়েছে কোভিড-১৯-জনিত নিশ্চিত রোগাক্রান্তের সংখ্যা, মৃত্যুহার এবং শ্বাসকষ্টজনিত লক্ষণ সমূহ ভিত্তিক রোগীর সংখ্যা, এই অতিমারীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে স্বচ্ছতা বজায় রাখা সহ সোশ্যাল আইসোলেশন সংক্রান্ত সংখ্যা (গুগল থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে) ইত্যাদি। এই চূড়ান্ত পরিসংখ্যানের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, যার সংখ্যার মানক সংক্রান্ত সূচক যত বেশি সেই প্রদেশের ভূমিকা তত খারাপ। দেশের সরকার পরিচালিত কোভিড-১৯-জনিত পরিস্থিতিতে মারানহাও-এর সূচক ২৫.৩১। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বলা হচ্ছে, দক্ষিণপন্থী পরিচালিত দেশে মারানহাও-এর এই সাফল্য বামপন্থী বিকল্পের স্লোগানকে আরও জোরদার করেছে।