লাতিন আমেরিকার কয়েকটি দেশে গণতন্ত্র আজ অবরুদ্ধ
লালন ফকির
বলিভিয়ায় গণতন্ত্রের দাবিতে মোরালেসপন্থীদের বিক্ষোভ।
লাতিন আমেরিকার কয়েকটি দেশে, বিশেষত আন্দিজ পর্বতমালার সংলগ্ন দেশগুলিতে নানান কারণে গণতন্ত্রের বিকাশ আজ রুদ্ধ হয়ে উঠেছে। বলিভিয়া থেকে শুরু করে কলম্বিয়া - সর্বত্রই এই চিত্র। গণতন্ত্রবিরোধী শক্তিগুলির নেতিবাচক ভূমিকার পাশাপাশি এই অঞ্চলে করোনা ভাইরাসের অতিমারীকেও এই দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলি ব্যবহার করছে। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, বিগত প্রায় দুই দশক ধরে এই অঞ্চলে সামাজিক আন্দোলন বা বাম মনোভাবাপন্ন শক্তিগুলির যে বিকাশ ঘটেছিল, বর্তমানে তাও বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে।
সম্প্রতি জুলাই মাসের শেষার্ধে মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প এক ট্যুইট বার্তায় ঘোষণা করেছেন, আগামী ৩নভেম্বর দেশে সম্ভাব্য রাষ্ট্রপতি নির্বাচন স্থগিত করা হতে পারে। নির্বাচনী পূর্বাভাসে ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা হ্রাসের আশঙ্কা দেখা দেওয়ার ফলে এই সিদ্ধান্ত বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচনে কারচুপির আশঙ্কাও ট্রাম্প করছেন। তবে প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের তারিখ নির্দিষ্ট করার দায়িত্ব মার্কিন কংগ্রেসের। রাষ্ট্রপতির এই বিষয়ে বিশেষ করণীয় নেই। সুতরাং, মার্কিন জনগণ ট্রাম্পের ট্যুইট ঘোষণাকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে না।
অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন পিছিয়ে যাবার প্রশ্নে প্রতিক্রিয়া যাই হোক না কেন, প্রতিবেশী লাতিন আমেরিকার দেশগুলি এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। যেমন বলিভিয়ায় যে নির্বাচন প্রক্রিয়া পিছিয়ে যাচ্ছে - এবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আন্দিজ অঞ্চলের দেশগুলি, বিশেষত বলিভিয়া, ইকুয়েডর, কলম্বিয়া এবং পেরুতে নির্বাচন প্রক্রিয়া পিছিয়ে যাওয়া গণতন্ত্রবিরোধী কার্যকলাপের অংশ। বিষয়টি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ পূর্বোক্ত দেশগুলিতে বামপন্থী প্রগতিশীল শক্তিগুলির বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলি সাংবিধানিক বা সংবিধান বহির্ভূতভাবে নির্বাচিত সরকারগুলির পতন ঘটিয়ে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধিতে ব্যবহার করছে। যেমন, ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে সামরিক বাহিনীর মদতপুষ্ট চরম দক্ষিণপন্থী শক্তি মার্কিন প্রশাসনের সহযোগিতায় এক সাংবিধানিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বলিভিয়ার নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ইভো মোরালেসকে ক্ষমতাচ্যুত করে। এরপরই মোরালেসের রাজনৈতিক দল এমএএস-এর ওপর আক্রমণ সংগঠিত করা হয়। মোরালেসের সমর্থক বিভিন্ন ধরনের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনগুলোও একই সাথে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। ইকুয়েডরের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রাফায়েল কোরিয়াকে শুধু ক্ষমতাচ্যুতই করা হয়নি, ২০২১ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তার রাজনৈতিক দল এফসিএস-এর অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করা হয়। পেরুতে রাষ্ট্রপতি মার্টিন টিমা জারাকে দেশের সংসদের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে দেওয়া হয়। ফলে একদিকে দেশটি যেমন সাংবিধানিক জটিলতায় জড়িয়ে পড়েছে, তেমনি অন্যদিকে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। কলম্বিয়ায় দেশের সামাজিক আন্দোলনের কয়েকশ’ কর্মীকে ২০২০ সালে খুন করা হয়েছে। সেখানে ক্ষমতাসীন দক্ষিণপন্থী সরকারের রাষ্ট্রপতি ইভান ডেকু এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী। দেশে গণতন্ত্রের বিশুদ্ধতা রক্ষার নামে এই হত্যালীলা সংগঠিত হয়েছে।
২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে ইভো মোরালেসের পরিচালনাধীন নির্বাচিত সরকারের পতন ঘটার পর তিনি প্রথমে মেক্সিকোতে পরে আর্জেন্টিনায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। ক্ষমতাসীন থাকাকালীন তিনি জনগণের স্বার্থে লিথিয়াম খনিগুলি জাতীয়করণ করেছিলেন। তার আগে এগুলি বহুজাতিক কর্পোরেশনের মুনাফার স্বার্থে ব্যবহৃত হতো। মোরালেসকে সরিয়ে দেওয়ায় এই সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের নীতি আক্রান্ত হয়ে পড়ে। চরম দক্ষিণপন্থী সামরিক বাহিনীর মদতে দেশে রাষ্ট্রপতির পদে আসীন হন দেশের রাজনীতির ক্ষেত্রে এক অনামী ব্যক্তিত্ব জেনাইনুফ আনেজ। মোরালেস বলিভিয়া ছেড়ে যাওয়ার আগেই চরম দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলি এমএএস কর্মী-নেতৃত্বের ওপর সশস্ত্র হামলা চালায়। বামপন্থী ও সমাজতন্ত্রীদের উৎখাত করার কাজে যারা ব্রতী হয়েছে রাষ্ট্রপতি তাদের নানাভাবে পুরস্কৃত করছেন।
অভ্যুত্থানের প্রায় ৫ মাস পরে মার্কিন উদারপন্থার প্রচার মাধ্যমগুলি স্বীকার করে যে, মোরালেস বিরোধী অভ্যুত্থান ন্যায়সঙ্গত ছিল না। বলিভিয়ার আনেজ সরকার নিশ্চিত ছিল যে, মোরালেসের যা জনপ্রিয়তা তার ফলে তাদের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত। সুতরাং, একে প্রতিহত করতে নির্বাচনে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। ইতিমধ্যে একাধিকবার নির্বাচন ঘোষণা করার পরেও তা স্থগিত রাখা হয়েছে।
কোভিড-১৯-এর সংক্রমণে ৩ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ পেরুতে বিপর্যস্ত হয়েছে। ৪ লক্ষাধিক পেরুবাসী সংক্রামিত হয়েছেন, মারা গেছেন ২০ হাজার। একেবারে প্রাথমিকপর্বে দেশে লকডাউন ঘোষণা করে একে মোকাবিলা করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু দেশব্যাপী ভয়ঙ্কর দারিদ্র্য এবং আর্থিক বৈষম্য এই অতিমারী প্রতিরোধে বিশাল বাধা হয়ে দাঁড়ায়। করোনা অতিমারীতে আক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথে দেশে দেখা দিয়েছে এক সাংবিধানিক সঙ্কট। বিশেষত, রাষ্ট্রপতি মার্টিন ভিজকার্রা দেশের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার চেষ্টা করেন। প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে দেন। এর বিরুদ্ধে সংসদ আবার রাষ্ট্রপতিকে সাসপেন্ড করে উপরাষ্ট্রপতি মার্সেডিজ আরোঞ্জকে রাষ্ট্রপতি পদে নিয়োগ করেন। কিন্তু সদ্যনিযুক্ত রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করেন। এর কয়েকদিন পর লিমা (সংসদ)-র নির্বাচন হয়। এই নির্বাচনে কোনোপক্ষই সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেনি। কোনো দলই ১১ শতাংশের বেশি ভোট পায়নি। শাসকদলের দুর্নীতির বিরুদ্ধে এই সময়ে গণ আন্দোলন গড়ে ওঠে। রাষ্ট্রপতি ভিজকার্রা কিছু কর্মসূচির সাহায্যে এর মোকাবিলা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু সহযোগী দলগুলির সমর্থন না পাওয়ায় তিনি বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেননি। ফলে দেশে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। গণতন্ত্র অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। রাষ্ট্রপতি আগামী বছর সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা করেছেন।
নানান কারণে বর্তমান সরকারকে অযোগ্য সরকার বললেও কম বলা হয়। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আইএমএফ-এর নির্দেশে গৃহীত আর্থিক সংস্কারের কর্মসূচি। এর ফলে করোনা সংক্রমণ ভয়াবহ চেহারা নিয়েছে এবং তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েই চলেছে। দেশের ১৭০ লক্ষ জনগণের জীবন সমস্ত দিক থেকেই আজ বিপর্যস্ত। করোনা ভাইরাসের আক্রমণ এতই বেশি যে, সরকারের পক্ষ থেকে এর কোনো তথ্য পরিসংখ্যান দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। সৎকারের অভাবে মৃতদেহ রাস্তায় স্তূপীকৃত হয়ে আছে। রাজধানী কুইটোর অবস্থা শোচনীয়। এখানে আগস্টের প্রথমদিকে ৮৬ হাজারের বেশি মানুষ সংক্রমিত হয়েছেন। দেশের বর্তমান রাষ্ট্রপতি লেনিন মোরেনো আইএমএফ থেকে ঋণের শর্ত অনুযায়ী জনস্বাস্থ্য খাতে সরকারি বরাদ্দ হ্রাস করেছেন। ফলে করোনা সংক্রমণ মারাত্মক চেহারা ধারণ করেছে। এর পাশাপাশি চলছে গণতন্ত্রের ওপরে আক্রমণ। ২০১৯ সালের জুলাই মাসে রাষ্ট্রপতি এক বিজ্ঞপ্তি জারি করে পূর্বতন রাষ্ট্রপতি রাফায়েল কোরিয়ার দল এফসিএস-এর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। রাফায়েল কোরিয়া বর্তমানে বিদেশে নির্বাসিত। এই ঘটনায় তিনি বলেছেন, “পুনরায় গণতন্ত্র লুঠ হলো ইকুয়েডরে।”
দেশটির বর্তমান জনসংখ্যা ৫ কোটি। নানান দিক থেকেই দেশটি আক্রান্ত। ইতিমধ্যে ৩ লক্ষের বেশি মানুষ করোনায় আক্রান্ত। এর মধ্যে ১০ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছেন। এর পাশাপাশি চলছে ভয়ঙ্কর অর্থনৈতিক সঙ্কট। ফলে দেশের বর্তমান শান্তি প্রক্রিয়ার আলোচনা যা দক্ষিণপন্থী সরকার এবং প্যারা মিলিটারি শক্তিগুলির মধ্যে সংঘটিত হচ্ছে তা নানাভাবে ব্যাহত হচ্ছে। রাষ্ট্রপতি ডুকেহ ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ। তিনি কলম্বিয়ার অভিজাত শ্রেণি বা মার্কিন প্রশাসন কাউকেই খুশি করতে পারছেন না। বিগত বছরে রাষ্ট্রপতি অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবিলা এবং শান্তি প্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়ে যাওয়া - উভয় ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়েছেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে করোনা সংক্রমণ মোকাবিলায় ব্যর্থতা। এছাড়া দেশে বেড়ে চলেছে ভয়ানক রাজনৈতিক সংঘর্ষ। এই সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে দেশের সামাজিক আন্দোলনের শীর্ষস্থানীয় সংগঠকরা আক্রমণের শিকার হচ্ছেন।
আন্দিজ পর্বতমালার সংলগ্ন এলাকা বলিভিয়া থেকে কলম্বিয়া - সর্বত্রই চলছে এই প্রক্রিয়া। অন্যদিকে করোনা সংক্রমণের মোকাবিলায় সরকারগুলি ব্যর্থ। একে সামনে রেখে বামপন্থী প্রগতিশীল শক্তিগুলিকে কোণঠাসা করতে সক্রিয় অতিদক্ষিণপন্থী শক্তিগুলি। এদের আরেকটি লক্ষ্য হলো। ভেনেজুয়েলার গণতন্ত্রের ধ্বংস করা। ভেনেজুয়েলায় হুগো সাভেজের সময়ে যে সমস্ত প্রগতিশীল ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল, বর্তমানে ভেতর ও বাইরের দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলি তাকে নস্যাৎ করতে উদ্যত হয়েছে। কিন্তু সেখানকার জনগণ এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলছেন, যা লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে শক্তিশালী করছে।