ইরানের নারী আন্দোলনের বার্তা
ঈশিতা মুখার্জি
ইরানে বিক্ষোভ চলছে, প্রতিবাদ চলছে দেশের শাসক এবং তার আইনের বিরুদ্ধে। ঘটনার সূত্রপাত ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২। মাহসা আমিনি, কুর্দ মহিলা পুলিশি হেফাজতে অত্যাচারের ফলে তেহেরানের কাস্রা হাসপাতালে মারা যান। কে মাহসা আমিনি? কেন তিনি ছিলেন পুলিশি হেফাজতে? উত্তর-পূর্ব ইরানে কুর্দ পরিবারে ১৯৯৯ সালে তাঁর জন্ম। তাঁর কুর্দি নাম জিনা, কিন্তু ইরানে পোশাকি নাম পার্সি হতে হয় বলে তাঁর পোশাকি নাম মাহসা। ১৩ সেপ্টেম্বর তিনি তাঁর ভাই ও পরিবারের সাথে দেখা করতে তেহেরানে আসেন এবং হাঘানি মেট্রো স্টেশন থেকে নামতেই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় এই কারণে যে,তাঁর হিজাব সঠিক মতো তাঁর চুল ঢাকতে পারছিল না এবং তাঁর চুল প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছিল। তাই তাঁকে নীতি-পুলিশ গ্রেপ্তার করে হেফাজতে নেয়। তাঁর পরিবারকে বলা হয় যে, তাঁকে বন্দি করে নিয়ম কানুন শিখিয়ে এক ঘণ্টা পর ছেড়ে দেওয়া হবে। গ্রেপ্তারের দু ঘণ্টা পর তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় এই মর্মে যে, তাঁর হার্ট অ্যাটাক হয়েছে এবং হাসপাতালে কোমায় চলে গিয়ে তাঁর মৃত্যু হয়। এই বিবরণ ইরানের পুলিশের দেওয়া। কিন্তু মাহসার এক ভাই আরফান সালি মোর্তিজা সাংবাদিকদের জানান যে, পুলিশি হেফাজতে নির্মম অত্যাচারের ফলে জিনার মৃত্যু হয়, তাঁর মাথায় কঠিন আঘাতের চিহ্ন ছিল। জিনার মাও এই কথা জানান। আরফান সালি মোর্তিজা অর্থাৎ জিনার সম্পর্কে ভাই কুর্দিস্তানের বামপন্থী মুক্তি আন্দোলনের সৈনিক।
কুর্দের মুক্তি আন্দোলন মহিলাদের অধিকারের আন্দোলনকে বিপুলভাবে প্রভাবিত করেছিল। বামপন্থী এই আন্দোলন মহিলাদের শিক্ষার অধিকার, কাজের অধিকার, নিজের পছন্দের অধিকারের প্রশ্নও সামনে এনেছে। ইরানেও মহিলাদের অধিকার রক্ষার সংগ্রামকে এগিয়ে প্রভাবিত করেছে কুর্দের আন্দোলন। ১৯৩০ সাল থেকে ইরানে পোশাক বিধি ছিল না। পাশ্চাত্য পোশাক, হিজাব না পরা, পাশ্চাত্য সংস্কৃতি রাজা রেজা শাহের শাসনকাল থেকে চলে আসছে। তখন গ্রামেগঞ্জে কর্মরত কৃষিজীবী শ্রমজীবী নারী সঠিকভাবে হিজাব পরে কাজও করতে পারতেন না। শুধু ধনী পরিবারের মহিলারাই যত্নের সাথে সবসময় হিজাব পরে থাকতেন। সেদিন কিন্তু শাসক বাহিনী জোর করে মহিলাদের হিজাব ছাড়ানোর কথা বলেছিল। সেদিন মহিলারা প্রতিবাদ জানিয়েছিল হিজাব পরিধান করে। প্রশ্নটা হলো নিজের পছন্দের অধিকার। এই কথা ইরানের মহিলারা সেইদিন থেকে লড়াই আন্দোলনের মাধ্যমে বলে এসেছেন। ১৯৪১ সালে শাসকের পরিবর্তনে মহিলাদের পছন্দের অধিকার দেওয়া হয়, হিজাব পরা বা না পরা বাধ্যতামূলক ছিল না তখন। কিন্তু ১৯৭৯ সালে ইসলামি স্বৈরাচারী শাসন কায়েম হওয়ার ফলে হিজাব ইরানে বাধ্যতামূলক হয়ে যায়, নানাভাবে মহিলাদের দমন-পীড়ন শুরু হয়ে যায়। মহিলারা সেদিনও পথে নামেন, প্রতিবাদ করেন। কিন্তু শাসক হিজাব পরা বাধ্যতামূলক করে আইন পাশ করে, হিজাব না পরার কড়া শাস্তি ধার্য করে, গ্রেপ্তার, জেল, বেতমারা পর্যন্ত ধার্য হয়। হিজাব না পড়লে ৭৪ বার বেত মারার নিদানও দেওয়া হয়। ইরানের মহিলারা সেই থেকে পথে আন্দোলন করেছেন, শাস্তি বরণ করে এসেছেন। ১৯৭৯ সালের সেই আন্দোলনের ধারা বয়ে, কুর্দের মুক্তি আন্দোলনের বার্তা নিয়ে বর্তমানে ইরানের মহিলাদের আন্দোলনকে আরও স্পষ্ট, আরও জোরদার আন্দোলনের রূপ দিয়েছে।
“জার, জিন্দেগি, আজাদি” এই হলো ইরানের মহিলাদের স্লোগান। এর অর্থ নারী, জীবন, মুক্তি। ইরানের মহিলারা বলছেন যে, ১৯৭৯ সালের প্রতিবাদ, কুর্দের মুক্তি আন্দোলনের পরের ধাপ হলো বর্তমান ইরানের নারী আন্দোলন। প্রকাশ্য রাস্তায় মহিলারা নিজের চুল কেটে ফেলেছেন, হিজাব পুড়িয়েছেন। দশকের পর দশক অবদমিত অধিকার রক্ষার আন্দোলন আগুনের ফুলকির মতো ছড়িয়ে পড়ছে। কুর্দের এক শহর থেকে গার্ডিয়ান পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিয়ে ২৫ বছর বয়সের মহিলা রোহজিন বলেন, এটাই ইরানের প্রকৃত নারী আন্দোলন। কুর্দিস্তানে মহিলারা গাড়ির বনেটের উপর উঠে তাদের হিজাব পুড়িয়েছে এবং মানুষ তাতে করতালি দিয়েছে। এই আন্দোলনের একটি দিক হলো এই আন্দোলন ধীরে ধীরে বহু মানুষকে এর দাবির সাথে সহানুভূতিশীল করতে সক্ষম হয়েছে। কৃষক, শ্রমিক সকলেই এই আন্দোলনের সপক্ষে এসে দাঁড়িয়েছে। সপক্ষে এসে দাঁড়িয়েছে শিল্পী-সাহিত্যিকেরাও।
বহু শিল্পীরা ছবি এঁকে, মূর্তি গড়ে, গান বেঁধে এই আন্দোলনের সঙ্গে থাকছেন। ঘরশি এরকমই এক শিল্পী যিনি কুর্দি হয়েও বর্তমানে আমেরিকাবাসী। তিনি উপরের ছবিটি এঁকেছেন যেখানে মহিলাকে প্রতিবাদের মুখ বলে দেখানো হয়েছে। প্রবাসী ইরানের বহু মানুষও এগিয়ে এসেছেন সহমর্মিতা দেখিয়ে। নারী আন্দোলন সবসময়েই ইতিহাসে সাফল্য লাভ করেছে, যখন তা নারীমুক্তির প্রকৃত শত্রুকে চিহ্নিত করতে পেরেছে এবং গণ আন্দোলনকে নেতৃত্ব দিয়েছে। ইরানে তাই সম্ভব হয়েছে। মানুষের স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রকৃত শত্রু স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রশক্তি, সে কথা জোরের সাথে বলেছে ইরানের মহিলাদের আন্দোলন এবং সাথি করে নিয়েছে সব অংশের মানুষকে। ১৯৭৯ সালে না পারলেও সেই আন্দোলনের ধারা, কুর্দের মুক্তি আন্দোলনের ধারা এই আন্দোলনে বলা যায় পূর্ণতা পাচ্ছে। হিজাব তো প্রতীকী। আসল কথা তো হিজাবকে কেন্দ্র করে সমাজের মূলধারা থেকে মহিলাদের বিচ্ছিন্ন করে রাখা হতো। শিক্ষা,কাজ সব ক্ষেত্রেই সীমা ছাড়ালেই নেমে আসত বেত্রাঘাত এবং কারাদণ্ড। মহিলাদের উপর এই দমন-পীড়ন আসলে তো গণতন্ত্র হরণ। তাই গণতন্ত্রের পক্ষে মানুষেরও জুটেছে শাস্তি। বিশ্ববিখ্যাত আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রাপ্ত চিত্রপরিচালক জাফর পানাহি এই মুক্তির কথা তাঁর ছবিতে বলেছিলেন বলে শাসকেরা তাঁকে ২০১০ সাল থেকে কারাগারে বন্দি রেখেছে। তাঁর “অফসাইড” ছবিতে তিনি দেখিয়েছিলেন যে, ইরানের মহিলারা ফুটবল খেলা দেখতে কীভাবে ছেলে সেজে খেলার মাঠে ঢুকেছিলেন। শতকের পর শতক আগুন ধিকি ধিকি করে জ্বলছিল। বারুদের আগুন লাগানোর কাজ করেছে জিনার শহিদ হওয়া। মহিলাদের দেশে শিক্ষা, উচ্চশিক্ষার অধিকার থাকলেও, সব বিষয় তাদের পড়তে দেওয়া হতো না। ২০১৬ সাল পর্যন্ত পরিসংখ্যানে দেখা যায় শ্রমশক্তির মাত্র ১৪.৯শতাংশ মহিলা। শিশুবিবাহ, বহুবিবাহ সব আইনসিদ্ধ। মহিলাদের সাধারণত কাজ করা, উপার্জন করা স্বীকৃত ছিল না। তাদের পরিবারের পুরুষের উপর দিনযাপনের জন্য নির্ভরশীল থাকতেই হবে - এরকম ব্যবস্থা ছিল। অনেকবার মহিলারা প্রতিবাদ করেছেন, পথে নেমেছেন; কিন্তু দমন-পীড়নের মাধ্যমে তা দাবিয়ে দেওয়া হয়েছে।
২০২২ সালের আন্দোলন দমন-শোষণের গোড়া ধরে নাড়া দিতে পেরেছে। মতাদর্শ নিয়ে আঘাত করেছে মৌলবাদী শাসনযন্ত্রকে। জিনা আমিনি কুর্দের মহিলা - এই পরিচিতি প্রান্তিক মানুষের অধিকারের প্রশ্ন উত্থাপন করে দিয়েছে। প্রান্তিক পরিচিতির গোষ্ঠী যেমন কুর্দ, আরব, তুর্ক, এবং অন্যান্যদের স্বাধীন সত্তার কথাও তুলে দিয়েছে এই আন্দোলন। প্রকাশ্যে চুল কেটে, হিজাব ছিঁড়ে, নেচে তাঁরা নিজেদের শরীরের উপর নিজের অধিকারের প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। দেশের স্বাধীন নাগরিক তাঁদের পছন্দে বাঁচবে, শাসকের পছন্দে নয় - এই বার্তাই ইরান জুড়ে তাঁরা দিচ্ছেন। শাসকের পছন্দে বেঁচে ইরানের প্রতি তিন জনের মধ্যে একজন দরিদ্র। সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক দাবি নিয়েও আন্দোলনের অধিকার ছিল না। সব বাধা ভেঙে দিয়েছে বর্তমানের নারী আন্দোলন।
ইরানের মৌলবাদী স্বৈরাচারী সরকার শয়ে শয়ে আন্দোলনকারীকে বন্দি করেছে, গুলি চালিয়েছে; কিন্তু দমন-পীড়ন দিয়ে এবার আর আন্দোলনের আঁচ কমানো যাচ্ছে না, উলটে তা দাউদাউ করে জ্বলছে। ইরানের মানুষ এটিকে বিপ্লব বলে চিহ্নিত করছে - মহিলাদের বিপ্লব; মানুষের বিপ্লব। এই বিপ্লবের অর্থ একভাবে নারীশক্তির অভ্যুত্থান ও তাঁকে কেন্দ্র করে গণ অভ্যুত্থান।তাঁরা বলছেন, স্বাধীন জীবনের লক্ষ্যে এই বিপ্লব। এই আন্দোলনের সপক্ষে ধর্মঘট করেছেন শিক্ষক সংগঠন, শ্রমিক সংগঠন এবং অন্যান্যরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ধর্মঘট করেছে সমর্থনে। বাজারের ব্যবসায়ীরা ধর্মঘটে শামিল হয়েছেন। উল্লেখযোগ্য এই যে, তেল এবং পেট্রোকেমিক্যাল যা ইরানের অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড, সেখানে শ্রমিক কর্মচারীরা এই আন্দোলনের সমর্থনে ধর্মঘট করে চলেছেন। কেউ কেউ অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট ডেকে দিয়েছে। তেহেরানের বড়ো বড়ো বাজার এলাকায় দোকান বন্ধ করে রেখে আন্দোলন চলছে। মুক্তি,স্বাধীনতার দাবিতে উত্তাল ইরান - তাই ওঁরা বলছেন প্রতিবাদ নয়, বিপ্লব। নারীদের আন্দোলন আসলে নিজের পছন্দমতো বাঁচার অধিকারের আন্দোলন, তাই এখানে শামিল করা সম্ভব হয়েছে সমাজের অনেক অংশের মানুষজনকে।
ক্ষয়ে যাওয়া পুঁজিবাদ স্বৈরতন্ত্র আঁকড়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছে, আর ইরানের মহিলারা বিদ্রোহের আগুন জ্বেলে বিকল্পের প্রশ্ন সামনে আনছে। সাথে সব শোষিত মানুষ সঙ্গী হয়েছেন। এই আন্দোলন বিশ্বের সামনেও নতুন বার্তা দিচ্ছে। দেশে দেশে সংহতি যাত্রার সাথে সাথে নতুন প্রশ্ন সামনে এসে গেছে - সে প্রশ্ন আগ্রাসী ক্ষয়ে যাওয়া পুঁজিবাদ, স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে, সে প্রশ্ন গণজাগরণের পক্ষে।