আফ্রিকা ও সামরিক অভ্যুত্থান (পর্ব-১)
সম্প্রতি পশ্চিম আফ্রিকার তিনটি দেশ মালি, গুয়ানা এবং বুরকিনা ফাসো সামরিক শাসনের কবলে পড়েছে। এই তিনটি দেশেই ইসলামিক জঙ্গি সংগঠন যেমন আলকায়দা ও ইসলামিক স্টেট্স-এর ক্রমবর্ধমান আক্রমণ এবং তা প্রতিরোধে পশ্চিম আফ্রিকায় ন্যাটো যুদ্ধ জোটের ব্যর্থতার কারণে ক্রমবর্ধমান গণবিক্ষোভই এর কারণ বলে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
পশ্চিম আফ্রিকার মতো বিগত কয়েক বছর যাবত আফ্রিকার একাধিক দেশে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটেছে। বিগত শতাব্দীর আটের দশক থেকে বর্তমানে তা অন্যত্রও ছড়িয়ে পড়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা চলে যে, ২০২১ সালে উত্তর-পূর্ব আফ্রিকায় অবস্থিত সুদানে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে অসামরিক সরকারের সংঘাত সৃষ্টি হয় এবং তা এখনও অব্যাহত আছে। বিগত তিন বছরের মধ্যে এটি হলো দ্বিতীয় ঘটনা। লিবিয়ার বিষয়টি পূর্বের সংখ্যাতেই উল্লেখিত হয়েছে।
পশ্চিম আফ্রিকার অপর দেশ চাডেও সামরিক বাহিনীর সাথে অসামরিক সরকারের বিরোধ অব্যাহত রয়েছে। এখানে রাষ্ট্রপতি ইদ্রিস ডেরয়না ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে মৃত্যুর পর তাঁর পুত্রকে সামরিক বাহিনী সরকারের প্রধান হিসাবে আসীন করলেও উভয়ের সম্পর্ক এখনও সহজ নয়। নতুন রাষ্ট্রপতি সাধারণ নির্বাচন বা জাতীয় সংসদের অনুমোদন ব্যতিরেকেই ক্ষমতাসীন হয়েছিলেন। কিন্তু ফ্রান্স বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেউই কোনো প্রতিবাদ জানায়নি। পশ্চিম আফ্রিকার অন্যতম দেশ নাইজারেও ২০২১ সালে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটেছে।
চাড এবং সুদানের ঘটনায় গণতন্ত্রের দাবিদার বলে পরিচিত মার্কিনিদের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমী দুনিয়া একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি। প্রসঙ্গত, চাড-এর সামরিক বাহিনী হলো এই অঞ্চলের সামরিক বাহিনীগুলির মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রশিক্ষিত। তাছাড়া এই অঞ্চলে ফরাসিদের দ্বারা গঠিত ‘বার্কহানে’-র কঠোর সমর্থক।
এই অঞ্চলে অর্থাৎ পশ্চিম আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ যেগুলি একসময় ফ্রান্সের উপনিবেশ ছিল এবং ‘ফ্রাঙ্কোফোন’ বলে পরিচিত দেশগুলিতে বিপুল সংখ্যক ফরাসি সেনাবাহিনীর উপস্থিতি রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও এই অঞ্চলে শান্তিরক্ষার ও স্থিতিশীলতা বজায়ের নামে বছরে ১৩০ কোটি ডলারের বেশি ব্যয় করে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আফ্রিকা রক্ষার প্রসঙ্গে তার অবস্থানকে এই অঞ্চলের বিভিন্ন দেশ সংহতি জানিয়ে থাকে। সুদানের সামরিক বাহিনী জনশ্রুতি অনুসারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কুনজরে রয়েছে। এই সামরিক বাহিনীর সাথে ইজরায়েলের সুসম্পর্ক রাখা এবং এরা ‘আব্রাহাম চুক্তি’-র সমর্থক। অথচ অতি সম্প্রতি সুদান হলো সেই সব দেশের মধ্যে অন্যতম যারা প্যালেস্তাইনের গভীর সমর্থক।
তিউনিশিয়ার সামরিক বাহিনী অসামরিক সরকারের ক্ষমতা খর্ব করেছে। মিশরে সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠিত। আলজিরিয়াতে সামরিক বাহিনী বাইরে থেকে সরকারের উপর প্রভাব খাটিয়ে থাকে। অন্যান্য আফ্রিকান দেশগুলিতে সামরিক প্রশাসনের যারা একসময় অসামরিক সরকারের সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা কায়েম করেছে তারা নানা কায়দা, কৌশলে সামরিক প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে ক্ষমতায় রয়ে গেছে। নাইজেরিয়ার উদাহরণ এক্ষেত্রে উল্লেখ্য।
মালিতে জনগণ ১৮ মাসের মধ্যে দু-দুটো সামরিক অভ্যুত্থান ঘটতে দেখেছে। সামরিক অভ্যুত্থান গত ২০২০ সালের আগস্ট মাসে সম্পাদিত হয়েছে।
কর্নেল অসীমি গোয়েটা যিনি ২০১৯ সালের সামরিক অভ্যুত্থান সংগঠিত করেছিলেন এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপরাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন, তিনি ২০২১ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অসামরিক সরকারের পতন ঘটান। ২০২১ সালের মাঝামাঝি নাগাদ রাষ্ট্রপতি আলফান্স কায়দ্রে পরিচালিত অসামরিক সরকারের পতন ঘটায় সামরিক বাহিনী। এই সামরিক অভ্যুত্থান পরিচালনা করে সামরিক বাহিনী, যার নেতৃত্বে ছিলেন ৪১ বছর বয়সী কর্নেল মামাডি ডুমবোওয়া।
ডুমবোওয়া মার্কিন সেনাবাহিনী দ্বারা প্রশিক্ষিত এবং তিনি বলেছেন যে, দুর্নীতি প্রতিরোধ, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা এবং অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা প্রতিরোধ আটকাবার জন্য এই সামরিক অভ্যুত্থান প্রয়োজন ছিল। প্রসঙ্গত, গুয়েনায় প্রচুর পরিমাণ আকরিক লোহা এবং বহু মূল্যবান খনিজের ভাণ্ডার রয়েছে এবং এগুলি সবই বহুজাতিক বিদেশি কোম্পানিগুলির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল। দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। এই সময় সামরিক অভ্যুত্থানের ঘটনা অনেক কম ছিল।
(পরবর্তী সংখ্যায়)