ইরানি পরমাণু বিজ্ঞানীর রহস্যজনক মৃত্যু
লালন ফকির
ইরানের বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী মোহসেন ফখরিজাদেহ্ মাহাবাদী-র আকস্মিক মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু প্রশ্ন সামনে চলে এসেছে। এই পরমাণু বিজ্ঞানী এবং পদার্থবিদ বেশ কিছুদিন ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইজরায়েলের খতম তালিকায় ছিলেন। আন্তর্জাতিকস্তরে পরমাণু গবেষণা সংক্রান্ত বিভিন্ন আলোচনায় তিনি ইরানের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। গত ২৭ নভেম্বর তেহরানের উপকণ্ঠে তাঁর গাড়ির কনভয়ে ট্রাকের সাহায্যে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তাঁকে হত্যা করা হয়। প্রচারমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদ অনুযায়ী ইজরায়েলি গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ ও ইরানীয় সন্ত্রাসবাদী সংস্থা মুজাহিদিন-ই-খালক্ (এমইকে) এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী। এমইকে ইতিপূর্বে দেশের অভ্যন্তরে একাধিক সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ চালিয়েছে।
ইরানের বিদেশমন্ত্রী জাভেদ জারিফ বলেছেন, এর আগের ইজরায়েল যে একাধিক সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ সংগঠিত করেছে, তার সঙ্গে এবারের ঘটনার অনেক সাদৃশ্য আছে। সারা বিশ্বে এই হত্যাকাণ্ড ধিক্কৃত হয়েছে। ইয়োরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়া এবং তুরস্কের পক্ষ থেকে এই হত্যাকাণ্ডের কঠোর নিন্দা করে বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছে।মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-র প্রাক্তন প্রধান এই হত্যাকাণ্ডকে চরম অপরাধজনক এবং ভয়ঙ্কর বেপরোয়া বলে চিহ্নিত করেছেন। একইসাথে তিনি জানিয়েছেন, এই হত্যাকাণ্ড প্রতিশোধের জন্ম দেবে এবং আঞ্চলিক সংঘাতের সৃষ্টি করবে। নির্বাচিত মার্কিন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন এবং উচ্চপদস্থ মার্কিন কর্তৃপক্ষের কেউ ইজরায়েলের সমালোচনা করেনি।
নিহত ৬২ বছর বয়স্ক পরমাণু বিজ্ঞানী মোহসেন ফখরিজাদেহ্ ইরানের ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ডের ব্রিগেডিয়ার পর্যায়ের একজন আধিকারিক ছিলেন। তিনি ইরানের পরমাণু বিজ্ঞান গবেষণার রূপকার ছিলেন। দু’বছর আগের রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে ইরানের পরমাণু গবেষণা সংক্রান্ত যে বক্তৃতা তিনি করেছিলেন তা শুনে ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বিকৃত তথ্যের ভিত্তিতে তাঁকে ইরানের পরমাণু অস্ত্র নির্মাণের প্রধান মাতব্বর বলে চিহ্নিত করেছেন। ইরান অবশ্য এর কঠোর সমালোচনা করেছিল।
আন্তর্জাতিক মহলের ধারণা, ইজরায়েল মধ্যপ্রাচ্যে গুপ্ত হত্যাকাণ্ড চালাতে এক বলয় সৃষ্টি করতে চাইছে। এক্ষেত্রে ইরান ও তার সহযোগী দেশগুলি হলো আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু। যে সমস্ত বিজ্ঞানী ইরানে পরমাণু গবেষণা কেন্দ্রে কাজ করছেন তারাই এই আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। ২০১০ সাল থেকে ২০১২ সালের মধ্যে ইরানের অন্তত চারজন পরমাণু বিজ্ঞানী ইজরায়েলি ঘাতকবাহিনীর হাতে দেশের অভ্যন্তরে নিহত হয়েছেন। এছাড়া একাধিক বিজ্ঞানীকে বিদেশ ভ্রমণকালে অপহরণ করা হয়েছে অথবা বেআইনিভাবে আটক করা হয়েছে। ইরানি পরমাণু বিজ্ঞানীদের ওপর আক্রমণের আগে নাতাঞ্জতে অবস্থিত ইরানি গবেষণা কেন্দ্র ধ্বংস করা ছিল ইজরায়েল এবং মার্কিন প্রশাসনের লক্ষ্য।
স্ট্যাক্সনেট নামে ভাইরাস দিয়ে এই গবেষণা কেন্দ্রকে সম্পূর্ণ অকেজো করার চেষ্টা হয়েছিল। ইরানে বিভিন্ন পরমাণু কেন্দ্র এর আগেও আক্রান্ত হয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনে শেষ দু’বছরে ইজরায়েলের সঙ্গে যোগসাজসে একাধিক পরমাণু কেন্দ্রে অন্তর্ঘাত চালানো হয়েছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের অনুমতি নিয়ে মোসাদ ফখরিজাদেহ্’র হত্যার ষড়যন্ত্র হয়েছিল। এর আগে নেতানিয়াহু সৌদি আরবের প্রিন্স মহম্মদ বিন সলমনের সঙ্গে গোপনে বৈঠক করেন। মহম্মদ বিন সলমন সৌদি আরবের যুবরাজ, কিন্তু তিনিই প্রকৃতপক্ষে শাসনক্ষমতা ভোগ করেন। মার্কিন ও ইজরায়েল প্রচার মাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী ইরান তাদের আক্রমণের যে হুমকি দিচ্ছে সে সম্পর্কে আলোচনা হয়। ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর মতে পরমাণু বিজ্ঞানীর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে মার্কিন বিদেশমন্ত্রী মাইক পম্পিও, ইজরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু, ও সৌদি আরবের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে। মার্কিন প্রচারমাধ্যমের মতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ট্রাম্পের পরাজয়ের পর তিনি ইরানের নাতাঞ্জ সহ অন্য পরমাণুকেন্দ্রগুলি অকেজো করে দেবার চেষ্টা করেছিলেন। এই আক্রমণ করার জন্য নেতানিয়াহু ট্রাম্পকে অনুরোধ করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে ফখরিজাদেহ্ হত্যাকাণ্ডের আগে তিনি বরিষ্ঠ ইজরায়েলি সামরিক আধিকারিকদের ইরানের ওপর সম্ভাব্য আক্রমণ সম্বন্ধে পূর্বাভাস দেন। ইজরায়েলি প্রশাসনের অন্তিম আশা ছিল যে, ট্রাম্প রাষ্ট্রপতি পদ ছেড়ে যাওয়ার আগে ইজরায়েলের জন্য বড়ো কিছু পুরস্কার দিয়ে যাবেন।
ট্রাম্প অবশ্য ইতিমধ্যেই ইজরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর পছন্দমত একাধিক কাজ করেছেন। এরমধ্যে রয়েছে ২০২০ সালের প্রথমে ইরানের সামরিক প্রধান কাশেম সুলেমানি হত্যা। এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ইজরায়েলি গোয়েন্দা বিভাগ সরাসরি যুক্ত ছিল। এছাড়া পশ্চিম তীরে অবস্থিত ইজরায়েলি বসতিগুলিকে স্বীকৃতি প্রদান ও জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাসের স্থানান্তর প্রভৃতি। আন্তর্জাতিক মহলে জেরুজালেমের অস্তিত্ব খুবই বিতর্কিত। আন্তর্জাতিক মহল কখনই জেরুজালেমকে ইহুদি রাষ্ট্রের রাজধানী হিসাবে স্বীকৃতি দেয় না। পরমাণু বিজ্ঞানী হত্যাকাণ্ডের কোনো নিন্দা মার্কিন রাষ্ট্রপতি করেননি, কিন্তু ইজরায়েলের জনৈক দক্ষিণপন্থী সাংবাদিকের একটি টুইট ফরোয়ার্ড করেছেন। টুইটে বলা হয়েছে, “এই হত্যাকাণ্ড ইরানের ওপর একটি বড়ো মনস্তাত্ত্বিক আঘাত”।
ইরান সহ ছ’টি দেশকে নিয়ে ‘জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অফ অ্যাকশান’ (জেসিপিওএ) যা ইরান পরমাণু চুক্তি বলে পরিচিত তা বহু আলোচিত একটি বিষয়। ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত এই চুক্তি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়। কিন্তু অন্যান্য দেশগুলি তাদের স্বাক্ষর প্রত্যাহার করেনি। সদ্য অনুষ্ঠিত মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রচারে জো বাইডেন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি ক্ষমতাসীন হলে এই চুক্তিকে পুনরুদ্ধার করবেন। অনেকের ধারণা, বাইডেনের সম্ভাব্য পদক্ষেপে বাধা সৃষ্টি করতে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। ন্যাশনাল ইরানিয়ান আমেরিকান কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট জামাল আবাদও বলেছেন, ট্রাম্প প্রশাসন ও ইজরায়েলি সরকারের প্রধান লক্ষ্য হলো ইরানের শান্তিপূর্ণ পরমাণু গবেষণাকর্ম বানচাল করা।
ওয়াশিংটনভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক বলে পরিচিত কুইন্সি ইনস্টিটিউটের ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং ইরান সম্পর্কিত বিশেষজ্ঞ ট্রিটা পার্সি বলেছেন, এই হত্যাকাণ্ড নেতানিয়াহু’র কাছে সুবিধাজনক পরিস্থিতি তৈরি করেছে। বর্তমান পরিস্থিতিকে ব্যবহার করে নেতানিয়াহু এই অঞ্চলে মার্কিন হস্তক্ষেপ নিশ্চিত করতে চাইছে। এর লক্ষ্য হবে ইরান ও সদ্যনির্বাচিত মার্কিন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনের মধ্যে শর্তহীনভাবে পরমাণু গবেষণা নিয়ে আলোচনা বানচাল করা।
বারাক ওবামা মার্কিন রাষ্ট্রপতি থাকাকালে বলেছিলেন, “ইজরায়েলি আক্রমণের পরিণতিতে আলোচনা থেকে ইরানকে দূরে রাখতে সাহায্য করবে।” এই প্রেক্ষিতে বর্তমানে বাইডেন প্রশাসনের উচিত ইরানের ওপর আক্রমণ থেকে ইজরায়েলকে সংযত করা। মার্কিন প্রশাসন যদি তা করতে ব্যর্থ হয় তাহলে ইরানের সামনে সামরিক এবং কুটনৈতিক পদক্ষেপ ছাড়া বিকল্প কিছু থাকবে না। ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর বিদায়লগ্নে ইরানের ওপর সামরিক আক্রমণের যে পরিকল্পনা করেছিলেন তা কার্যকর হলে পাল্টা পদক্ষেপ হিসাবে ইরান দুবাইয়ের ওপর আক্রমণ করবে বলে জানিয়েছিল।
এই হত্যাকাণ্ডের পর ইরানি সংসদে অনুমোদিত এক প্রস্তাবে পরমাণু সমৃদ্ধকরণের পূর্বঘোষিত কর্মসূচিগুলি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদকে লেখা পত্রে ইরান জানিয়েছে, ইজরায়েলি হত্যাকাণ্ডের পর নিজের দেশের জনগণকে রক্ষার জন্য সমস্ত প্রতিরোধক ব্যবস্থা গ্রহণের অধিকার তাদের আছে। ইরানের জনগণ এই হত্যাকাণ্ডে দারুণ বিক্ষুব্ধ। কিন্তু পাশাপাশি এই প্রশ্নও উঠছে যে, কেন ইরান সরকার তার দেশের বিজ্ঞানী গবেষকদের ইজরায়েলি হানা থেকে রক্ষা করতে পারছে না। ফখরিজাদেহ্ যেহেতু ইজরায়েলি খতমতালিকার শীর্ষে ছিলেন তাই তাঁর সুরক্ষা ব্যবস্থা ছিল যথেষ্ট মজবুত। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাকে প্রাণ দিতে হয়েছে। মার্কিন-ইজরায়েল চক্রের ষড়যন্ত্র কত গভীর তা এর থেকে বোঝা যায়। এই চক্রই হলো এই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার সামনে প্রধান বাধা।