সরকারের আপাত পরিবর্তন হলেও সংকট এবং অনিশ্চয়তা অব্যাহত শ্রীলঙ্কায়
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া রাজাপক্ষে গণবিক্ষোভের জেরে ভীত হয়ে শ্রীলঙ্কা ছাড়লেও দ্বীপরাষ্ট্রের মানুষের দুর্দশা কমেনি একটুও। দ্বীপভূমিতে নতুন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রীসভা নির্বাচিত হলেও শ্রীলঙ্কার নাগরিকদের সামনে এখনো কোনো ইতিবাচক দিশা দেখাতে পারেনি নতুন দায়িত্ব নেওয়া সরকার। নয়া সরকার বহাল হবার পরেও খোলা বাজারে চালের দাম শ্রীলঙ্কার মুদ্রায় ২৫০ টাকা কিলো থেকে নামেনি। কমেনি জ্বালানি তেলের খোঁজে মানুষের হাহাকার। কমেনি কলম্বো পাসপোর্ট অফিসের সামনে দীর্ঘ লাইনে শ্রীলঙ্কা ছাড়তে চাওয়া নাগরিকদের ঢল। মুদ্রাস্ফীতির পরিমাণ ছাড়িয়েছে ৫৪.৬ শতাংশ। যা আরও বেড়ে পৌঁছাতে পারে ৭০ শতাংশে। পরিস্থিতি কার্যত অপরিবর্তিত। তবে এতদিন জাতীয়তাবাদ দিয়ে জনতার ক্ষোভকে সামলাতে না পেরে তাঁদের দমাতে এবার সেনাকে ব্যবহার করার রাস্তায় যেতে চায় শ্রীলঙ্কার নয়া সরকার। তার ইঙ্গিত ইতিমধ্যেই স্পষ্ট।
কার্যত শাসকের নামটুকুই শুধু বদলেছে শ্রীলঙ্কায়। এমনটাই মনে করছেন ক্ষুব্ধ শ্রীলঙ্কার আমজনতা। রনিল বিক্রমসিঙ্ঘের মন্ত্রীসভার সদস্যরা জনতার ক্ষোভ প্রশমিত করতে সর্বদলীয় সরকার গড়ার কথা হাওয়ায় ভাসিয়ে দিচ্ছেন, সংবাদ সংস্থার রিপোর্টে তা উঠে আসছেও। কিন্তু তার পাশাপাশি গল ফেস এলাকায় জড়ো হওয়া ক্ষুব্ধ জনতার উপর লেলিয়ে দেওয়া হচ্ছে সরকারি নিরাপত্তা বাহিনী এবং সেনাকে। প্রসঙ্গত, এর আগে সিংহলি জাতীয়তাবাদকে উসকে দেওয়া হলেও তা কাজে আসেনি। তাই শ্রীলঙ্কা জুড়েই জোরালো হচ্ছে সাধারণ নির্বাচনের দাবি। নির্বাচনের মধ্যদিয়ে দেশের মানুষের রায়ের ভিত্তিতে সরকার গঠনের দাবি।
রাষ্ট্রপতি পদে রনিল বিক্রমসিঙ্ঘে দায়িত্ব নিয়েছেন ২১ জুলাই। তিনি তাঁর দলের একমাত্র সাংসদ। গোটা সংসদে রাজাপক্ষের দলের সাংসদরা সংখ্যায় বেশি। তাই রনিলের নির্বাচনের পেছনে রাজাপক্ষের পূর্ণ মদত রয়েছে তা বলাই বাহুল্য। ২২ জুলাই প্রধানমন্ত্রী পদে শপথ নিয়েছেন দীনেশ গুনবর্ধনে। এই প্রধানমন্ত্রী আবার রাজাপক্ষের কাছের লোক বলেই পরিচিত। ওইদিনই একই সঙ্গে ১৮ জন সদস্যের নতুন মন্ত্রীসভা শপথ নিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে, যার অধিকাংশই পুরনো গোতাবায়া রাজাপক্ষে মন্ত্রীসভার অংশ। তাই বলা হচ্ছে, বিদেশে আপাতত ঠাঁই নেওয়া গোতাবায়া রাজাপক্ষে এই মন্ত্রীসভার জোরেই পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় ফিরবেন, কিছুদিনের স্বআরোপিত ‘বনবাসে’র বিরতির পরেই।
খাদ্যশস্য সহ আমদানি নির্ভর শ্রীলঙ্কার বিদেশি মুদ্রা থেকে মজুত খাদ্যের ভাঁড়ার প্রায় নিঃশেষ। সংকটের কালো ছবি গত মাসচারেক ধরেই শ্রীলঙ্কার মানুষের সামনে যত স্পষ্টতর হয়েছে, তত ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছে তাঁদের। তারই জেরে ৯ জুলাই থেকে রাষ্ট্রপতি ভবনের দখল অর্ধাহার-অনাহারে থাকা আমজনতার হাতে ছিল এতদিন। এদিকে দ্বীপভূমিতে রাষ্ট্র সংঘের ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম পরিচালিত এক সাম্প্রতিক সমীক্ষায় ভয়াবহ ফলাফল উঠে এসেছে। ওই সমীক্ষার রিপোর্ট বলছে, শ্রীলঙ্কার দশটি পরিবারের মধ্যে ন’টিই প্রতিদিন একবেলা খেতে পাচ্ছে না। খাদ্য থেকে জ্বালানি তেল-গ্যাস, বিদ্যুৎ থেকে ওষুধ, নিত্যব্যবহার্য সবকিছুই এখনও তাঁদের নাগালের বাইরে। কোথায় গেল আমাদের টাকা? প্রশ্ন তুলছেন বিক্ষুব্ধ মানুষ। নানা দুর্নীতির প্রশ্নেও তোলপাড় চলছে। ২২ জুলাই রাতে এই মন্ত্রীসভা কাজের দায়িত্ব নেবার কিছুক্ষণ আগেই কলম্বোর উপকণ্ঠে গল ফেস এলাকায় আর্থিক অচলাবস্থার বিরুদ্ধে সরকারের কাছের খাবার, জ্বালানি সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম আকাশছোঁয়া হওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে মাসাধিককাল ধরে অবস্থান বিক্ষোভে অংশ নেওয়া জনতার ওপর সেনাবাহিনী নামিয়ে তাদের ব্যাপক মারধর করা হয়। এই পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে সাধারণ মানুষের রোষ থেকে ছাড় পাননি কেউই। জবাবদিহি চেয়ে জনতা নেতা-মন্ত্রীদের ধাওয়া করেছে নিয়মিত।
পর্যবেক্ষকদের মত, শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতির অতি দ্রুত অবনতির পেছনে অন্যতম কারণ দিশাহীন অর্থনীতি। বেসরকারিকরণ করা হয়েছে ঢালাওভাবে। সংকটের সময় রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের পরিষেবা মেলেনি। অর্থনীতির মৌল ক্ষেত্র নড়বড়ে হয়ে গেছে। প্রচুর পরিমাণে বিদেশি ঋণ নিলেও তা খরচ করা হয়েছে অন-উৎপাদনশীল ক্ষেত্রে।
শ্রীলঙ্কার মানুষের ক্ষোভ রুখতে এ বছর দু’দফায় জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। প্রথমবার ১ এপ্রিল, দ্বিতীয়বার ৬ মে। দুটি ক্ষেত্রেই কয়েকদিন পরেই তা প্রত্যাহার করতে হয় সরকারকে। অর্থনৈতিক সংকট থেকে নজর ঘোরানোর জন্য জনসংখ্যার ৭৫ শতাংশ হওয়া সত্ত্বেও সিংহলিরা বিপন্ন এমন ধারণা তৈরি করা হয়েছে। একদিকে তামিল ও অন্যদিকে মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এই ধারণাকে ব্যবহার করা হয়েছে। পরবর্তীতে, টালমাটাল পরিস্থিতিতে পদত্যাগ করতে হয় প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষকে। তারপর এক বছর মেয়াদে রনিল বিক্রমসিঙ্ঘে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। এবছর এপ্রিল মাসের ৩ তারিখে গোটা মন্ত্রীসভা পদত্যাগ করে। সেই সঙ্গে পদত্যাগ করেন সেন্ট্রাল ব্যাংকের গভর্নর। অর্থমন্ত্রী পদত্যাগ করেন ৫ এপ্রিল। এর জেরে সংসদে গরিষ্ঠতা খোয়ান রাষ্ট্রপতি।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে সংগঠিত প্রবল বিক্ষোভ দমন করার কাজটাও শুরু হয়ে গেছে ২২ জুলাই থেকেই। দেশজুড়ে সাংবিধানিক ব্যবস্থা বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন রনিল বিক্রমসিঙ্ঘে। সরকারিভাবে তিনি বিক্ষোভ অবস্থানে অংশ নেওয়া গল ফেসের গোপামা ভিলেজে তাঁবু খাটিয়ে থাকা জনতাকে সরে যেতে না বললেও ব্যবস্থা নিচ্ছেন অন্যভাবে। সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনী লাঠি চালিয়েছে ওই জনতার ওপর। সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনীর এই আক্রমণে ৬০ জন সমাজকর্মী এবং সাংবাদিকরা আইনজীবী সহ প্রতিবাদীরা গুরুতর আহত হয়েছেন। সংবাদে প্রকাশ, সেনার পক্ষ থেকে হুমকি দিয়ে বলা হচ্ছে অবিলম্বে বিক্ষোভ স্থল ছাড়তে হবে প্রতিবাদীদের। সেনাবাহিনী এবং নিরাপত্তা বাহিনীর নজরদারিতে পরিস্থিতি এমনই দাঁড়িয়েছে যে, পুলিশি নির্যাতনের শিকার শ্রীলঙ্কাবাসী গোপামা ভিলেজ এলাকা থেকে বেরিয়ে ওষুধ কিনতেও যেতে ভয় পাচ্ছেন।
সরকার বিরোধী বিক্ষোভকারীরা রাষ্ট্রপতি ভবন ছেড়ে বেরনোর পরে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, অন্তত এক হাজার মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক বিভিন্ন দ্রব্য খোয়া গেছে। তবে এর কোনো পূর্ব তালিকা পুরাতাত্ত্বিক বিভাগ এবং সরকারের কাছে ছিল না। রাজনৈতিক মহল মনে করছে, এক্ষেত্রে দু’টো বিষয়কেই ছুঁতে চাওয়া হয়েছে। অর্থাৎ ইঙ্গিতটা খুব স্পষ্ট। এক্ষেত্রে হেলিকপ্টারে দ্বীপ রাষ্ট্র ছেড়ে যাওয়া গোতাবায়া রাজাপক্ষের দিকেও আঙুল উঠছে বিক্ষোভরত জনতার পাশাপাশি যারা রাষ্ট্রপতি ভবনের দখল নিয়েছিলেন।
শ্রীলঙ্কায় থাকা বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনগুলির পর্যবেক্ষণ হলো, রনিল বিক্রমসিঙ্ঘে সরকার যেন দ্রুত শ্রীলঙ্কার মানুষের অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণ করে, মৌলিক অধিকার সমূহ বজায় রাখে এবং তাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়। সেনাবাহিনীর সাম্প্রতিক হামলা যা গল ফেসে অবস্থানরত বিক্ষোভকারীদের ওপর নামিয়ে আনা হয়েছে, সে বিষয়ে উল্লেখ করে তারা আরও বলেছেন, আন্তর্জাতিক স্তরে বিভিন্ন দেশের উচিত জোরালোভাবে শ্রীলঙ্কাকে এ কথা বুঝিয়ে দেওয়া যে, জনগণের অধিকারকে যদি বর্তমান শ্রীলঙ্কা প্রশাসন অগ্রাধিকার না দেয় তাহলে তারা দ্বীপ রাষ্ট্রের সাহায্যে এগিয়ে আসবে না।
চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদ মাধ্যম জিন হুয়া-তে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি বিক্রমসিঙ্ঘের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে চীন প্রস্তুত, একথা বলেছেন চীনের রাষ্ট্রপ্রধান শি জিনপিং।
অন্যদিকে রামেশ্বরম হয়ে শ্রীলঙ্কার শরণার্থীরা আগের চেয়েও বেশি সংখ্যায় তামিলনাড়ুতে আশ্রয় নিতে আসছেন। একই সঙ্গে ভারত, কুয়েত, মালয়েশিয়া এবং সৌদি আরবে বৈধভাবে কাজ খুঁজতে যাওয়ার জন্য দেশ ছাড়ার হিড়িক পড়ে গেছে দ্বীপ রাষ্ট্রের আতঙ্কিত অধিবাসীদের মধ্যে।
সংবাদ সংস্থাকে কলম্বো শহরের এক অটোচালক জানিয়েছেন, আগে প্রতিদিন তার আয় হতো দিন পিছু এক হাজার টাকা। কিন্তু এই মুহূর্তে সপ্তাহে তিন দিনের বেশি তিনি অটো নিয়ে বের হতে পারছেন না। যাত্রীও সেরকম সংখ্যায় নেই। আর রয়েছে জ্বালানি তেলের জোগানের অভাব - যে সমস্যায় ভুগছে গোটা দ্বীপরাষ্ট্র। সিঙ্গাপুরের এক হোটেলে কাজ পেয়েছেন - তাই পরিবারের ভরণপোষণের জন্য আর এক সপ্তাহের মধ্যেই শ্রীলঙ্কা ছেড়ে চলে যাবার খরচ জোটাতে পরিবারের গয়না বেচতে বাধ্য হয়েছেন এই অটো চালক।
শ্রীলঙ্কায় ছোটো ব্যবসায়ীদের পরিস্থিতিও একই রকম। কলম্বো শহরে ওষুধের দোকান খোলা রেখেও সামান্য দিনপিছু চালানোর খরচও উঠছে না দোকানিদের। তার কারণ আন্তর্জাতিক জোগান এবং সরবরাহে ব্যাপক টান। স্বাস্থ্য পরিষেবা যা শ্রীলঙ্কার গর্বের বিষয় ছিল, সেখানে এই মুহূর্তে ছবিটা করুণ। চিকিৎসা পরিকাঠামো বিপর্যস্ত। শ্রীলঙ্কার ডাক্তাররা সোশ্যাল মিডিয়ায় আবেদন জানাচ্ছেন, চলতি সংকট মুক্তির জন্য ওষুধ এবং মেডিক্যাল সরঞ্জাম পাঠানোর।
সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে গণবণ্টন ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে খাদ্যের জোগানের ক্ষেত্রে সুষ্ঠু বিতরণের মতো আগামী এক মাসের রসদ রয়েছে। আর জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রেও একই বক্তব্য সরকারের। কিন্তু এ সমস্ত পেরিয়েও যে প্রশ্নটা বেশি করে উঠেছে তা হলো, শুধুমাত্র শাসকের নাম পরিবর্তন বা প্রসাধনী প্রশাসনিক পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে জনগণের মৌলিক সমস্যাগুলির কতটা সমাধান এভাবে করতে পারবে সরকার! এই মুহূর্তে তাই আগামী সাধারণ নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া বিক্ষোভরত শ্রীলঙ্কার জনগণের কাছে কার্যত কোনো বিকল্প নেই।