রাজনৈতিক অস্থিরতার আবর্তে নেপাল
লালন ফকির
ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্র নেপালে শুরু হয়েছে এক রাজনৈতিক অস্থিরতা। চলতি বছরের শুরুতেই নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলি দেশের সংসদ ভেঙে দিয়েছেন। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই বর্তমান অস্থিরতার সূত্রপাত হয়েছে। ওলিকে দেশের শাসকদল কমিউনিস্ট পার্টি অফ নেপাল (ইউএমএল) বহিষ্কার করে। সংসদ ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। নির্বাচন কমিশন দেশের শাসকদলের ভাঙনকে স্বীকৃতি দিতে রাজি হয়নি। এই ভাঙনের একদিকে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী ওলি এবং তার নেতা পুষ্পকুমার দহল ওরফ প্রচণ্ডের নেতৃত্বে গোষ্ঠী এবং অপরদিকে রয়েছেন মাও কৃষ্ণা ওরফে নেপাল সহ অন্যান্য বরিষ্ঠ নেতৃত্ব। উভয় গোষ্ঠীই নিশ্চিত হতে পারছে না সুপ্রিম কোর্ট পুনরায় জাতীয় সংসদের পুনরুজ্জীবন ঘটাবে, না আগামী এপ্রিল-মে মাসের মধ্যে পুনরায় দেশের নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার ব্যবস্থা নেবে। বিভিন্ন শহরে প্রধানমন্ত্রী-বিরোধী বিক্ষোভ সমাবেশ ঘটে চলেছে। এসবই ঘটছে এমন সময়ে যখন দেশটি কোভিড সংক্রমণে আক্রান্ত এবং ভূমিকম্প বিধ্বস্ত অঞ্চলে পুনর্গঠন চলছে।
নেপালের রাজনীতিতে বিগত কয়েক দশক ধরেই অস্থিরতা বিদ্যমান। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে অস্থিরতার কারণ রয়েছে। শতাধিক বছরের পুরনো রাণা শাসনের অবসান ঘটে ১৯৫১ সালে। তারপর থেকে নির্বাচিত কোনো সরকারই তার মেয়াদ পূরণ করতে পারেনি। এর কিছু কারণও রয়েছে। প্রথমত, জাতীয় রাজনীতির খণ্ডিত চেহারার মধ্যে কোনো নির্দিষ্ট দলের রাজনীতিই অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের বাইরে নেই এবং কোনো দলেরই তার কর্মীবাহিনীর ওপর পূর্ণ কর্তৃত্ব নেই। দ্বিতীয়ত, নেপাল তার জন্মলগ্ন থেকেই রাজনৈতিক সংহতি নির্মাণের ক্ষেত্রে দুর্বল এবং স্বল্প অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। তৃতীয়ত, নেপালে যে রাজনৈতিক নেতৃত্ব গড়ে উঠেছে তার একাংশ উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং ক্ষমতালোভী।এরা ক্ষমতার ভাগাভাগি চায় না। চতুর্থত, নেপালের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির প্রভাব বিস্তারের প্রবণতা রয়েছে।
২০০৬ সালে মাওবাদী বিদ্রোহ দমন করে যে যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠে সেখানে কোনোদিনই কোনো কোয়ালিশন সরকার দীর্ঘমেয়াদি হয়নি। নেপালে নতুন সংবিধান গৃহীত হওয়ায় ‘নতুন নেপাল’ গঠনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। এখানে যে ক্ষমতা ভাগাভাগির পরিকল্পনা হয় তা ছিল এইরকম - নেপাল কংগ্রেসের সুশীল কৈরালা এবং ওলি (২০১৪), প্রচণ্ড এবং নেপাল কংগ্রেসের দেউবা (২০১৭-১৮), ওলি এবং শাসক কমিউনিস্ট পার্টির প্রচণ্ড (২০২০)। এইসব কোয়ালিশনের কোনোটিই বেশিদিন টেঁকেনি। নেপালের সাম্প্রতিক অস্থির পরিস্থিতির পর্যালাচনা করতে হলে দেশটির কিছু অতীত ইতিহাস ও তার তাৎপর্য সম্পর্কে আলোচনা করা প্রয়োজন।
এশিয়ার স্থলবেষ্টিত দেশ নেপালের উত্তরে তিব্বত, পূর্বে সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গ। দক্ষিণ ও পশ্চিমে বিহার ও উত্তরপ্রদেশ। তিনটি ভৌগোলিক অঞ্চলে দেশটি বিভক্ত। দক্ষিণে তরাই অঞ্চল, মহাভারত লেক, তুরিয়া পাহাড় ও অন্তর্বর্তী তরাই সমন্বিত মধ্যাঞ্চল এবং হিমালয়।
নেপালের সর্বশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৭ সালের ২৬ নভেম্বর ও ৭ ডিসেম্বর। দু’দফায় নেপালের সংসদে নিম্নকক্ষ ও প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচনে ভোটগ্রহণ করা হয়। ২০১৫ সালে গৃহীত নতুন সংবিধানের আওতায় এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সংসদের নিম্নকক্ষে ২৭৫ টি আসন এবং নতুন করে গঠিত ৭টি প্রদেশে ৫৫০টি আসনের জন্য ভোটগ্রহণ করা হয়। সংসদের ২৭৫টি আসনের মধ্যে ১৬৫ টি আসনে প্রত্যক্ষ নির্বাচন হয়। এক্ষেত্রে প্রার্থীদের ভোটের সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে জয়ী ঘোষণা করা হয়। বাকি ১১০ টি আসন আনুপাতিক ভোটের ভিত্তিতে স্থিরীকৃত হয়। একইভাবে প্রাদেশিক আইনসভার ৫৫০ টি আসনের মধ্যে ৩৩০ টি আসনে প্রত্যক্ষ নির্বাচন হয়। অবশিষ্ট আসনগুলি আনুপাতিকহারে বিভিন্ন দলের মধ্যে বণ্টিত হয়। নির্বাচনে বিশাল ব্যবধানে জয়ী হয় বামপন্থী জোট। দুই কমিউনিস্ট পার্টি অর্থাৎ কমিউনিস্ট পার্টি অফ নেপাল (ইউনাইটেড মার্কসিস্ট লেনিনিস্ট) ও কমিউনিস্ট পার্টি অফ নেপাল (মাওয়িস্ট সেন্টার)। প্রত্যক্ষ নির্বাচনে আসনগুলির ৭০ শতাংশ বামপন্হীরা দখল করে। মোট আসনের ৭০ টি সিপিএন (ইউএমএল) পায় এবং সিপিএন (এমসি) পায় ৩৬ টি আসন। মধ্যপন্থী নেপালি কংগ্রেস পায় ২৩ টি আসন যা মোট আসনের ১৪ শতাংশ। দুই মদেশীয় দল রাষ্ট্রীয় জনতা পার্টি অফ নেপাল এবং সংসদীয় সমাজবাদী ফোরাম পায় ২১ টি আসন, অন্যান্য দলগুলি পায় ৫টি আসন। আনুপাতিকহারে আসন বণ্টনের ক্ষেত্রে সিপিএন (ইউএমএল) এবং নেপালি কংগ্রেস প্রায় সমান সমান ভোট পায়। ইউএমএল পায় ৩৩.২৪ শতাংশ, নেপালি কংগ্রেস পায় ৩২.৭৮ শতাংশ, সিপিএন (এমসি) পায় ১৩.৬৬ শতাংশ ভোট। দুই মদেশীয় দল ৫শতাংশের কিছু কম ভোট পায়।
২৭৫টি আসনের সংসদে বাম জোট পেয়েছে ১৭৪ টি (সিপিএন-ইউএমএল ১২১, সিপিএন-এমসি ৫৩) নেপালি কংগ্রেস ১৪৩টি,রাষ্ট্রীয় জনতা দল ১৭টি, সমাজবাদী ফোরাম ১৬ টি আসন পায়। চীনপন্থী বলে পরিচিত বামেদের এই বিশাল জয়ে ভারত সন্তুষ্ট হয়নি।
নেপালের বর্তমান সঙ্কটের চারটি কারণ উল্লিখিত হয়েছে। ওলি যখন জাতীয় সংসদ বাতিলের ঘোষণা করেন তখন তিনি স্পষ্ট করেই বলেন, তাঁর বরিষ্ঠ দলীয় নেতারা তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে দেয়নি। তাঁর জাতীয় সংসদ ভাঙার সিদ্ধান্ত সংবিধান পরিপন্থী। সংসদ ভেঙে দেওয়ার অধিকারী প্রধানমন্ত্রী নন। প্রচণ্ড এবং অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে দেশের সংবিধান রচনার ক্ষেত্রে ওলিরও ভূমিকা ছিল। সংবিধান নির্মাণের ক্ষেত্রে দেশের স্থায়িত্ব বজায় রাখা এবং ঘন ঘন নির্বাচন থেকে দেশকে রক্ষা করাই ছিল এর লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য। সংবিধানে বলা হয়েছিল, কার্যকালের আড়াই বছর পূর্ণ না হলে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনা যাবে না। আড়াই বছর পর অনাস্থা প্রস্তাব গৃহীত হলে একই সঙ্গে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী কে হবেন তা সাংসদদের মধ্যে থেকে নির্বাচিত করতে হবে।
শাসক কমিউনিস্ট পার্টির নেতা প্রচণ্ড এবং নেপাল মনে করেন বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য ওলিও দায়ী। বারংবার বলা সত্ত্বেও দলের সভাপতি এবং দেশের প্রধানমন্ত্রীর মতো দু’টি গুরুত্বপূর্ণ পদের কোনো একটিকে ছেড়ে দিতে তিনি রাজি হননি। ওলির বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ, তিনি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরগুলির দায়িত্ব কাউকে ছেড়ে দিতে চাননি। এর ফলে সরকার পরিচালনায় যোগ্যতার পরিবর্তে বশ্যতাই গুরুত্ব পেয়েছে। পরিণতিতে প্রশাসনে দুর্নীতি বেড়েছে। জনগণ থেকে প্রশাসন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রাথমিকস্তরে ওলি এজন্য ভারতকে দায়ী করেন। পরে তিনি এই অবস্থান থেকে সরে আসেন এবং নিজের দলের বরিষ্ঠ নেতাদের দায়ী করেন। এই অস্থির পরিস্থিতির জন্য চীনও নেপালের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করছে বলে রাজনৈতিক মহলের ধারণা।নেপালে অবস্থিত চীনের রাষ্ট্রদূত হাউ ইয়াঙ্কি সর্বতোভাবে চেষ্টা করেছেন যাতে নেপালের কমিউনিস্ট পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ করা যায়। কিন্তু তাঁর উদ্যোগ সফল হয়নি। পরবর্তীকালে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ইন্টারন্যাশনাল ডিভিশনের ভাইস প্রেসিডেন্টের নেতৃত্বে গঠিত চার সদস্যের এক কমিটি গত ডিসেম্বর মাসে নেপাল সফরে যায়। কিন্তু ঐক্য স্থাপনে এঁরাও ব্যর্থ হন। এর ফলে নেপালের কমিউনিস্ট পার্টির ওপর চীনের কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাব দুর্বল হয়ে পড়ে।
নেপালের বর্তমান রাজনৈতিক পরিসরে এক নতুন ধরনের শক্তির উত্থান ঘটছে। এরা হলো হিন্দুত্ববাদী শক্তি এবং ক্ষমতাচ্যুত রাজতন্ত্রের অবশেষ। এরা কাঠমাণ্ডু সহ দেশের বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ সংগঠিত করছে। এদের দাবি হলো অপসারিত রাজতন্ত্রের পুনরুদ্ধার এবং হিন্দু রাষ্ট্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা। রাজনৈতিক মহলের মতে বেপরোয়া ওলির এদের প্রতি পরোক্ষ সমর্থন রয়েছে। সম্প্রতি ১৬ জানুয়ারি পশুপতিনাথ মন্দিরে ওলির সফর এর প্রমাণ।পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পর তিনি সেখানে যান। এখানেই শেষ নয়। নেপালি প্রচারমাধ্যমগুলির মতে ওলি নেপালি কংগ্রেসের সঙ্গে আসার উদ্যোগ নিয়েছেন।
কমিউনিস্ট পার্টিগুলির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে তাদের শক্তি জাতীয়স্তরে হ্রাস পাচ্ছে কিনা তা নিয়ে নেপালের রাজনৈতিক মহলের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে এবং জেলার গ্রামস্তরের যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে সেখানে তা বোঝা যাবে। বিরোধী দলগুলি ওলির বিরুদ্ধে ‘প্রচণ্ড’ ও ‘নেপাল’ গোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করতে চাইছে। কিন্তু ওলি বিরোধী গোষ্ঠীগুলির শক্তিও বেশি নয়। নেপালে ক্ষমতার ভাগ নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠী মঞ্চ ভাগাভাগির খেলায় ব্যস্ত।
এই পরিস্থিতিতে ভারতের শাসকদল মোটামুটি খুশি। ওলি এইসময়ে ভারতীয় সমর্থকদের বিরুদ্ধে কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে । অন্যদিকে নেপালের কালাপানি অঞ্চলের সীমানা বিরোধ ধামাচাপা পড়েছে বলেই ধারণা। ওলি বর্তমানে অন্তর্দ্বন্দ্বে জর্জরিত। সেজন্য সমস্যা সমাধানে তিনি ভারতের সহায়তা চাইছেন। ভারতের হিন্দুত্ববাদী শক্তি এতে উৎসাহী। রাজতন্ত্র এবং হিন্দুত্ববাদী শক্তির জোট কমিউনিস্ট পার্টির দুর্বলতার সুযোগে এই ব্যাপারে সুযোগ খুঁজছে।
নেপালের অস্থিরতা এবং রণনৈতিক কৌশল নির্ধারণসহ নানা প্রশ্নে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ভারতের কাছে উদ্বেগের বিষয়। নেপালের অবস্থানের গুরুত্ব চীনের কাছে অনেক বেশি। বিশেষত, চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’-এ নেপালের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এই অবস্থায় ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মিলিতভাবে নেপালের ওপর উল্টোদিক থেকে রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে চাইছে। চীনও তা জানে । ফলে নেপালের রাজনৈতিক অস্থিরতা তার অভ্যন্তরীণ বিষয় হলেও ভারত সহ অন্যান্য দেশের ওপরও তার প্রভাব পড়ছে। ফলে এটি এখন আন্তর্জাতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে।