কিউবার কমিউনিস্ট পার্টির অষ্টম কংগ্রেস
পরিবর্তন ও ধারাবাহিকতার কংগ্রেস
শান্তনু দে
ফিদেল কাস্ত্রো
রাউল কাস্ত্রো
মিগুয়েল দিয়াজ-ক্যানেল
১৬-১৯ এপ্রিল, হাভানায় হয়ে গেল কিউবার কমিউনিস্ট পার্টির অষ্টম কংগ্রেস। কোভিডের কারণে আগাম সতর্কতা হিসেবে পার্টির ৫৮,০০০ শাখা কমিটির ৭ লক্ষ সদস্যের মধ্যে প্রতিনিধিত্ব করেন মাত্র ৩০০ জন। যেখানে ২০১৬-তে, সপ্তম কংগ্রেসে প্রতিনিধির সংখ্যা ছিল ১,০০০।
১৬ এপ্রিল। ছয় দশক আগে এই দিনেই কিউবা বিপ্লবের সমাজতান্ত্রিক চরিত্রের কথা ঘোষণা করেন কমানদান্তে ফিদেল কাস্ত্রো। তার ঠিক আগের দিন কিউবার বিমান ঘাঁটিতে ঘটা বোমাবর্ষণে নিহতদের শেষকৃত্য অনুষ্ঠান। যা ছিল সিআইএ’র ষড়যন্ত্রে কিউবা থেকে নির্বাসিত প্রায় দেড় হাজারজনকে প্রশিক্ষণ দিয়ে কিউবা আক্রমণের সূচনা। ‘বে অব পিগস’র সেই চেষ্টা সেদিন সফল হয়নি। ফিদেলের নেতৃত্বে বাহাত্তর ঘণ্টার লড়াই। ১৯ এপ্রিল, মার্কিন মদতে প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে সেই বিজয়ের ৬০-তম বার্ষিকীও এবছর।
পার্টির প্রাদেশিক কমিটিগুলি ৪ মার্চ কংগ্রেসের জন্য তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করে। পরে ১৫-২০ মার্চ, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা কংগ্রেসের দলিল নিয়ে যোগ দেন নিজেদের এলাকার পাঠচক্রে। বৈঠকগুলি থেকে আসা সেই সমস্ত মতামত সংগ্রহের শেষে মূল্যায়ন করে কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিশন।
কিউবার কমিউনিস্ট পার্টিতে ফি বছর গড়ে নতুন করে সদস্যপদ অর্জন করছেন ৩৯,৪০০ জন, যার তিনভাগের একভাগ ইয়ং কমিউনিস্ট লিগ থেকে। যদিও, পার্টি সদস্যদের ৪২.৬ শতাংশের বয়স ৫৫ বছরের ওপরে। এই মুহূর্তে ক্যাডারদের ৫৪.২ শতাংশ মহিলা, ৪৭.৭ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ ও মিশ্র বর্ণের।
প্রথম সম্পাদক হিসেবে চূড়ান্ত দায়িত্ব শেষে কংগ্রেসে মুখ্য প্রতিবেদন পেশ করেন রাউল কাস্ত্রো। ১১,৯৭১ শব্দের প্রতিবেদনে রাউল তুলে ধরেন সশস্ত্র বাহিনীর (যে সামরিক বাহিনীর প্রধান ছিলেন তিনি) অবদান, কোভিডের কারণে পর্যটন শিল্পের বিপর্যয়, মহামারী মোকাবিলার চ্যালেঞ্জ, অর্থনৈতিক পরিবর্তনগুলির ‘পুনর্বিন্যাস’, এক মুদ্রা ব্যবস্থায় রূপান্তর প্রক্রিয়া, মার্কিন অর্থনৈতিক অবরোধ, লাতিন আমেরিকায় মার্কিন হস্তক্ষেপ, দুষ্কর্মে ইয়োরোপের সহযোগিতা থেকে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির সঙ্গে ভেনেজুয়েলা, নিকারাগুয়া-সহ পুয়ের্তো রিকোর প্রতি সংহতির কথা। বলেন, কোনো পরিস্থিতিতেই ‘বিপ্লব ও সমাজতন্ত্রের নীতিগুলিকে পরিত্যাগ করবে না কিউবা।’
উনিশ সালে কিউবার নতুন সংবিধান, সরকারি সংস্থাগুলির ‘পরিচালনা ও কাঠামো’ উন্নয়নে আইনি ও প্রশাসনিক পদক্ষেপগুলি থেকে মহামারী মোকাবিলা, পাঁচটি কোভিড টিকা তৈরি, অর্থনৈতিক অবরোধ প্রতিরোধে সাফল্যগুলি সবিস্তারে ব্যাখ্যা করেন তিনি।
পাশাপাশি ভুলত্রুটি ও দুর্বলতার দিকগুলিও তুলে ধরেন রাউল। কঠোর সমালোচনা করেন। বলেন, ‘কিউবাই একমাত্র দেশ, যেখানে কাজ না করেও কেউ বেঁচে থাকতে পারে - এই বিপজ্জনক ধারণা আমাদের মুছে ফেলতে হবে।’ এখনও রয়েছে ‘মাত্রাতিরিক্ত আমলাতান্ত্রিকতা, সম্পদের অপর্যাপ্ত নিয়ন্ত্রণ’ থেকে ‘দুর্নীতি ও অন্যান্য বেআইনি কার্যকলাপের ক্ষতিকারক উপস্থিতি’, যা ব্যাহত করছে ‘উৎপাদনশীলতা ও দক্ষতা বৃদ্ধির অগ্রগতিকে।’ তিনি বলেন, ‘অর্থনৈতিক-সামাজিক মডেলকে সময়োপযোগী করার প্রক্রিয়া হওয়া উচিত আরও গতিশীল। হওয়া উচিত কেন্দ্রীভূত পরিকল্পনা ও বিকেন্দ্রীকরণের যথার্থ মিলন।’
৫০-বছরেরও বেশি সময় মার্কিন অবরোধের মুখে একরত্তি দ্বীপরাষ্ট্র। তার মধ্যে দাঁড়িয়েও নিজের অর্থনীতিকে ধরে রেখেছে সমাজতান্ত্রিক কিউবা।
২০১১-তে তৈরি করেছে ‘পার্টি ও বিপ্লবের সামাজিক-অর্থনৈতিক নীতি সংক্রান্ত নির্দেশিকা’। যার উদ্দেশ্য ‘কিউবার অর্থনৈতিক মডেলকে সময়োপযোগী করা, সমাজতন্ত্রকে অব্যাহত রাখা, এবং তা যাতে বিপরীতমুখী না হয় নিশ্চিত করা, দেশের অর্থনৈতিক বিকাশ ও জীবনমানের উন্নতিকে নিশ্চিত করা।’
নীতির এই পুনর্বিবেচনা করতে গিয়ে কিউবা নতুন করে ভাবছে মজুরি ও অবসর ভাতার বিষয়টি। বন্ধ করা হচ্ছে লোকসানে চলা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা। তুলে দিতে চাইছে অবাঞ্ছিত বিনামূল্যের সুযোগসুবিধা এবং ‘অতিরিক্ত ভরতুকি’।
জমির রাষ্ট্রীয় মালিকানা খানিকটা শিথিল করে ‘লিজের’ মাধ্যমে ছোটো ছোটো মালিকদের হাতে চাষের জন্য, তা তুলে দিতে চাইছে। ক্ষুদ্র উৎপাদকদের জন্য বাজার তৈরির চেষ্টা চলছে। রপ্তানির জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে উৎপাদনকে। দেশে যে দ্বৈত মুদ্রা ব্যবস্থার প্রচলন আছে, তা-ও তুলে দিতে চাইছে।
সামাজিক-অর্থনৈতিক নীতি সংক্রান্ত নির্দেশিকাগুলি ‘রূপায়ণের আগে সব ক্ষেত্রে অনুমোদন না দিলেও, কিছু পেশায় বেসরকারি প্র্যাক্টিসের দাবি জানানো হয়েছিল।’ প্রতিবেদনে একথা উল্লেখ করে রাউল বলেন, ‘একে ব্যক্তি-স্বার্থে, লোভের থেকে এবং উচ্চ-আয়ের আগ্রহের জন্য প্ররোচনা হিসেবে দেখা যেতে পারে। মোটের উপর, একে দেখা যেতে পারে বেসরকারিকরণ প্রক্রিয়া শুরুর প্রতি আগ্রহ হিসেবে - যা নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে ছয়-দশকের বেশি সময় ধরে তৈরি সমাজতান্ত্রিক সমাজের ভিত্তিগুলি ও মর্মবস্তুকে।’
এ ব্যাপারে সতর্ক করে রাউল বলেন, ‘এই পথে হাঁটা মানে, জাতীয় শিক্ষা, সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা - যা সমস্ত কিউবাবাসীর জন্যই বিনামূল্যে এবং যার সুযোগ সর্বজনীন - তাকে স্বল্প সময়ের মধ্যে গুঁড়িয়ে ফেলা।’ যোগ করেন, ‘কেউ কেউ বিদেশি বাণিজ্যের উপর রাষ্ট্রের আধিপত্যের সমাজতান্ত্রিক নীতির অবসান চাইছেন। বিদেশি বাণিজ্যে একটি রাষ্ট্র-বহির্ভূত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় বেসরকারি বাণিজ্যিক আমদানির কর্তৃত্ব চাইছেন।’ তিনি বলেন, ‘এটি হবে আমাদের রণনীতিগত বিচ্যুতি। সমাজতন্ত্রের ধ্বংসসাধন, আর সেকারণে আমাদের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার ধ্বংসযজ্ঞ।’
‘অর্থনৈতিক ও সামাজিক মডেলের রূপায়ণে আরও গতিশীলতার’ ওপর গুরুত্ব দেন রাউল। বলেন, জরুরি হলো বিনিয়োগকে আরও সংহত করা। অর্থনীতিতে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রকে আরও শক্তিশালী করা। যা ‘সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিকে মজবুত করার জন্য অবিচ্ছেদ্য।’ সেইসঙ্গেই জরুরি জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধি, বিশেষত খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর জন্য মানসিকতার প্রকৃত পরিবর্তন।
সপ্তম কংগ্রেস অর্থনীতির যে ২৭৪টি গাইডলাইন চূড়ান্ত করেছিল, তার মধ্যে ৮২টি (৩০ শতাংশ) রূপায়ণ হয়ে গিয়েছে। ১০৯টি (৪০ শতাংশ) রূপায়ণের প্রক্রিয়ার মধ্যে। বাকি ৮৩টি (৩০ শতাংশ) প্রস্তাব অথবা অনুমোদনের অপেক্ষায়।
অষ্টম কংগ্রেস অতীতের গাইডলাইনগুলির মধ্যে ১৭টি বহাল রেখেছে। ১৬৫টি মডিফাই করেছে। বাদ দিয়েছে ৯২টি। যোগ করেছে ১৮টি।
অষ্টম কংগ্রেস থেকে কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষ পদ ফার্স্ট সেক্রেটারি নির্বাচিত হয়েছেন মিগুয়েল দিয়াজ-ক্যানেল। বিদায় নিয়েছেন রাউল। তিনি সহ পলিট ব্যুরো থেকে বিদায় নিয়েছেন আরও চারজন। ৬১বছরের ক্যানেলের জন্ম কিউবা বিপ্লবের পরে। পনেরো বছর ছিলেন ভিল্লা ক্লারা এবং হলগুয়েন প্রদেশের ফার্স্ট সেক্রেটারির দায়িত্বে। তারপর উচ্চশিক্ষা মন্ত্রক, মন্ত্রীসভার সহ সভাপতি থেকে তিনবছর ধরে দেশের রাষ্ট্রপতির দায়িত্বে।
কিউবায় মানবাধিকার নিয়ে লাগাতার অভিযোগ জানিয়ে আসছে ওয়াশিংটন থেকে ব্রাসেলস। কিউবায় নাকি শ্রমিকদের মতপ্রকাশ, ইউনিয়ন গঠনের কোনো স্বাধীনতা নেই?
ঘটনা হলো, কিউবার শ্রমিকদের ৯০ শতাংশের বেশি ইউনিয়নের সদস্য। অন্যদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই হার মাত্র ১১.৩ শতাংশ। ১৯৫৯, কিউবায় বিপ্লব। তার ২০বছর আগে ১৯৩৯ সালে সমস্ত ইউনিয়নকে নিয়ে তৈরি হয় ফেডারেশন অব কিউবান ওয়ার্কার্স (সিটিসি)। ইউনিয়নগুলি পুরোপুরি স্বাধীন, স্বনির্ভর। সদস্যপদের চাঁদা মজুরির ১ শতাংশ সরাসরি সংগ্রহ করা হয় কর্মস্থল থেকে, কেটে নেওয়া হয় না মজুরি থেকে।
২০১৬’র এপ্রিলে কিউবার কমিউনিস্ট পার্টির সপ্তম কংগ্রেসে এর জবাব দেন রাউল কাস্ত্রো। বলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বরাবর দাবি করে কিউবায় না কি মানবাধিকার নেই, আর সেটাই অর্থনৈতিক অবরোধ তোলার ক্ষেত্রে তাদের প্রধান প্রতিবন্ধকতা। আমাদের কাছে, মানবাধিকারের অর্থঃ সমকাজে সমমজুরি, তা সে পুরুষ হোন, আর মহিলা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ অন্যান্য দেশে এটা নেই। মহিলারা পান কম মজুরি। অথচ, এনিয়ে কয়েকডজন মানবাধিকারের উল্লেখ করা যেতে পারে। বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরিষেবা - কিউবায় অন্যতম একটি মানবাধিকার। এরকম মানবাধিকার এই বিশ্বে আর ক’টি দেশে আছে? বহু দেশে এটা কোনো মানবাধিকারই নয়। বরং, ব্যবসা। আমাদের দেশে শিক্ষা মেলে বিনামূল্যে। বিশ্বে আর ক’টি দেশ আছে, যেখানে ফ্রি-তে শিক্ষা মেলে? এটাও সব দেশে ব্যবসা।’
‘সেকারণেই এনিয়ে আমরা যে কারোর সঙ্গে যে কোনো জায়গায়, যে কোনো সময় আলোচনা করতে প্রস্তুত।’ বলেন রাউল। এবং, আজ পর্যন্ত কেউ এনিয়ে কিউবার সঙ্গে আলোচনায় বসার ইচ্ছা প্রকাশ পর্যন্ত করেনি।
কিউবায় প্রতি ১৭০ জন পিছু একজন ডাক্তার। আমেরিকায় দ্বিগুণেরও বেশি, ৩৯০ জন পিছু একজন ডাক্তার। আর ভারতে, সাড়ে আটগুণেরও বেশি, ১৪৫৭ জন পিছু একজন ডাক্তার।
পাঁচদশকের অবরোধের মুখেও কিউবা মানব উন্নয়নে গোটা বিশ্বের কাছে এক অনন্য নজির। বর্ণবিদ্বেষের অবসান। মহিলাদের সমানাধিকার, মহিলাদের উত্থান। নিরক্ষরতার হার, শিশুমৃত্যু তলানিতে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা সংক্রান্ত গবেষণা, ক্রীড়ায় সমানে পাল্লা দিয়ে চলেছে দুনিয়ার সবচেয়ে উন্নত দেশগুলির সঙ্গে।
মানব উন্নয়ন সূচকে সবচেয়ে উন্নত দেশগুলির তালিকায় কিউবা। ১৮৯টি দেশের মধ্যে স্থান ৭২, যেখানে ভারত ১২৯। গড় আয়ু ৭৯.৫, যেখানে আমেরিকায় ৭৮.৯৩, আর ভারতে প্রায় ৭০। পাঁচ বছরের কম বয়েসি শিশুর মৃত্যু হার প্রতি এক হাজারে মাত্র ৫, যেখানে আমেরিকায় ৬.৫, আর ভারতে ৩৬.৬।
একরত্তি দেশ কিউবা। আয়তন মেরেকেটে ১ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার। জম্মু কাশ্মীরের চেয়ে বড়ো, তেলেঙ্গানার চেয়ে ছোটো। জনসংখ্যা সাকুল্যে এক কোটি দশ লক্ষ। উত্তর চব্বিশ পরগনা, দক্ষিণ দিনাজপুর মিলিয়ে এর চেয়ে বেশি মানুষ থাকেন। আমেরিকার জনসংখ্যা এর ৩৩ গুণ। তেত্রিশ কোটি।
এহেন এক ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রের লড়াই এই দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী দেশের সঙ্গে। মাত্র নব্বই মাইল দূরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাকের ডগায় কিউবা। এমন এক দ্বীপ, যা তার শত্রুর চেয়ে ৮৪ গুণ ছোটো।
কিউবার বিপ্লব মানে বিপ্লবী সৃজনশীলতা, স্বাধীনতার স্বপ্নপূরণ, শ্রমিক ও মহিলাদের উত্থান, সাম্রাজ্যবাদের ধারাবাহিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতি চব্বিশ ঘণ্টার লড়াই, দেশপ্রেম, আন্তর্জাতিক সংহতি, সমাজতন্ত্রকে রক্ষা এবং নতুন সমাজতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণে প্রত্যয়ী মনোভাবের উদাহরণ।