E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

পেরুর ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা

প্রাকৃতিক সম্পদের রাষ্ট্রীয় মালিকানার উপর জোর

শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়


১৯ জুলাই পেরুর ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সুত্রপাত হলো। ওই দিন চূড়ান্ত ফলাফলের ভিত্তিতে নিশ্চিত হলো বামপন্থী দল ফ্রি পেরু’র প্রার্থী শিক্ষক আন্দোলনের নেতা পেদ্রো কাস্তিও’র জয়। তিনি ৬ জুন শুরু হওয়া রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে দীর্ঘ ছয় সপ্তাহের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার পর দক্ষিণপন্থী কেইকো ফুজিমোরিকে প্রায় ৪৪ হাজার ভোটে পরাজিত করে নির্বাচিত হলেন।

পেরুর ২০০ বছরের ইতিহাসে প্রথম নির্বাচিত বামপন্থী রাষ্ট্রপতি কাস্তিও ফল প্রকাশের পর দেশের আর্থিক সংস্কারের প্রশ্নে বলেছেন, আমরা অন্য কোনো দেশের আর্থিক মডেল নকল করব না। আমরা সত্যিকারের অর্থনৈতিক উন্নয়ন করব, যা আইনগত এবং আর্থিক স্থিতি নিশ্চিত করবে।

পেদ্রো কাস্তিও ২০১৭ সালে পেরু কাঁপানো শিক্ষক আন্দোলন থেকে উঠে আসা একজন বামপন্থী নেতা। পেরুর সরকারি স্কুলগুলিতে বেসরকারি স্কুলগুলির তুলনায় শিক্ষকদের বেতন ভীষণ কম ছিল। শিক্ষকদের সংগঠন ২০১৭’র আগে রাষ্ট্রের কাছ থেকে বেতন বৃদ্ধির যে প্রস্তাব পেত তাই মেনে নিত, দ্বিমত পোষণ করার পরিস্থিতি ছিল না। পেদ্রো কাস্তিও এবং তার কমরেডরা এই ইস্যুতে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। তাদের সঙ্গে সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার শ্রমিক এবং খনি শ্রমিকরা যোগ দেবার পর শ্রমজীবীদের আন্দোলন ক্রমে তীব্র গণআন্দোলনের রূপ নেয়। উত্তাল ঢেউয়ের মতো একের পর এক ধর্মঘটের ডাক সফল হতে থাকে। পেরুর রাজধানী লিমাতে ১৫ হাজার শিক্ষকের সুবিশাল মিছিল সংগঠিত করেন পেদ্রোরা। পরবর্তীতে শ্রমিক শ্রেণির নেতা হিসেবে এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে উত্থান হয় পেদ্রো কাস্তিওর।

গত ২০১৪ সাল থেকেই পেরুর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। এখানকার ১২ বছর ধরে বেড়ে চলা জিডিপি’র হার ২০১৪ সালে প্রথম মুখ থুবড়ে পড়ে। পেরু পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম তামা রপ্তানিকারী দেশ। এর পাশাপাশি দস্তা এবং অন্যান্য বহুমূল্য নানা ধাতু পেরু রপ্তানি করে থাকে। গত দু’দশক ধরে ফল এবং সবজি রপ্তানিও পেরুর অর্থনীতির অন্যতম উল্লেখযোগ্য দিক। পর্যটন ব্যবসা থেকে পেরুর জিডিপি’র ১০ শতাংশ আয় আসে। কিন্তু পেরুতে এখন অর্থব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়ার মুখে। তামা, দস্তা রপ্তানি করলেও পেরুর মানুষকে তাদের খাদ্যশস্যের জন্য আমদানির ওপর ভরসা করে চলতে হয়। আর্জেন্টিনা, রাশিয়া, আমেরিকা থেকে গম আসে। এই আমদানি করা খাবারের পরিমাণ ঠিক করে দেয় পেরুর গরিব মানুষেরা পরিবার পিছু কতটুকু খাবেন। কারণ গত এক দশক ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে তামার দাম কমেছে, আর তাই দেশে বেড়ে গেছে খাদ্যশস্যের দাম। কারণ, খাদ্যশস্যের আমদানি ৫০ শতাংশ কমে গেছে। আর এক ধাক্কায় ৩৩ মিলিয়ন জনসংখ্যার দেশ পেরুতে দারিদ্র্যের হার ছাড়িয়েছে ৩০ শতাংশ।

ফ্রি পেরু নামের বর্তমান মার্কসবাদী-লেনিনবাদী দলটি প্রতিষ্ঠা করেন ডক্টর ভ্লাদিমির সেরন। দলের পক্ষ থেকে প্রথমে ঠিক করা হয়েছিল ভ্লাদিমির সেরন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী হবেন। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দেওয়া হয়। উপরাষ্ট্রপতি পদে কাস্তিও দাঁড়াবেন বলে ঠিক ছিল। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে কাস্তিওকেই দলের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী করা হয়। এই দলটি বহু বছর বাদে পেরুর খেটে খাওয়া এবং গরিব মানুষের মধ্যে দৃঢ় গণভিত্তি সম্পন্ন একটি বামপন্থী দল হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। দলের পক্ষ থেকে পেরুর মতো প্রাকৃতিক সম্পদ প্রাচুর্যে ভরা একটি দেশের গরিব মানুষের পক্ষে স্লোগান দেওয়া হয়, ‘নো মোর পুওর ইন আ রিচ কান্ট্রি’ (প্রাচুর্যে ভরা দেশে আর কেউ গরিব থাকবে না)।

২০২০ সালের অতিমারী পরিস্থিতিতে পেরুর সার্বিক ক্ষতি হয়েছে। পর্যটন ব্যবসা একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। বিশ্বব্যাপী মন্দার জেরে কমে গেছে খনিজ রপ্তানি। কারণ চাহিদা নেই। তাই অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে কাবু পেরু। এক লক্ষ আশি হাজার মানুষ কোভিড অতিমারীতে মারা গেছেন। পরিসংখ্যান বলছে, ১৫০ শতাংশ বেশি মৃত্যু ঘটেছে এখানে। গত জুন মাসে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন শুরুর সময় দেশের মাত্র ৪ শতাংশ মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছিল। স্বাস্থ্যক্ষেত্রের বেলাগাম বেসরকারিকরণ, সরকারি চিকিৎসা খাতে ব্যয়, বিনিয়োগ হ্রাস-এর জন্য দায়ী। এবং সরকারের অনিয়ন্ত্রিত অযৌক্তিক লকডাউন নীতির জন্য মানবিক বিপর্যয় ঘটেছে আশঙ্কাজনকভাবে। কারণ চূড়ান্ত সংক্রমণ কালে এই লকডাউন নীতির জেরেই শ্রমিকদের খনিতে জোর করে পাঠানো হয়েছে আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নেবার জন্য। এই দেশে মাত্র ৩৮ শতাংশ পেরুবাসীর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট রয়েছে। তাই বিভিন্ন ডিজিটাল মাধ্যমে তাদের কাছে ত্রাণের অর্থ পৌঁছানো যায়নি। পেরুর অর্থনৈতিক উন্নয়নের এবং বৃদ্ধির জন্য চীনের অর্থনীতির আংশিক অবদান রয়েছে। ২০১৪ থেকে পেরুর বাণিজ্যের সবথেকে বড় সঙ্গী চীন। ৫৮ বিলিয়ন ডলারের সামগ্রী পেরু থেকে চীন কেনে; যেখানে আমেরিকা, পেরুর একদা বৃহত্তম সঙ্গী, কেনে ৩৩ বিলিয়ন ডলারের দ্রব্য। পেরুর তামা রপ্তানির দুই-তৃতীয়াংশ যায় চীনে। ২০১০ সালে পেরুর সঙ্গে চীন একটি বাণিজ্য চুক্তিতে সই করে। তিনটি বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্প পেরুতে চলছে চীনের পৃষ্ঠপোষকতায়। পেরুর একটি বন্দর চানকে-তে চীনের বিনিয়োগ ১.৩ বিলিয়ন ডলার। আমাজনিও জলপথ এবং ট্রানসকন্টিনেন্টাল রেলওয়ে এরকমই আরও দুটি প্রকল্প যা চীনের প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ এবং সহায়তায় নির্মিত হচ্ছে সেখানে। লাতিন আমেরিকায় চীনের ব্যবসার বাণিজ্যের ওপর মার্কিনী আঘাতের জেরে পেরুর সঙ্গে চীনের বাণিজ্যিক জোট আরও দৃঢ় হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

কাস্তিও’র আর্থিক নীতি সংক্রান্ত পরিচালনভার যাদের হাতে থাকবে সেই অস্কার ডানকোর্ট (সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের প্রাক্তন কর্তা) এবং পেদ্রো ফ্রাঙ্ক (বিশ্ব ব্যাঙ্কের প্রাক্তন কর্তা) ইতিমধ্যেই ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, তারা দেশের দশক পুরনো মুদ্রাস্ফীতি লক্ষ্য ভিত্তিক অর্থব্যবস্থাকে কোনভাবেই নাড়াঘাঁটা করবেন না। তাঁরা বলেছেন পেরু তার আন্তর্জাতিক ঋণ শোধ করবে, এই মুহূর্তে যার পরিমাণ পেরুর জিডিপি’র ৪৪ শতাংশ।

পেরুতে এখন তামার দাম তার সর্বকালীন রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে। বলা হচ্ছে, পেদ্রো যেটা করতে পারেন তা হলো পেরুর অর্থনীতির খোল নলচে না বদলে, তার দলের ‘সুষম বণ্টন সংক্রান্ত’ যে কর্মসূচি রয়েছে তা প্রয়োগ করে আর্থিক ব্যবস্থাকে দেশের খেটে খাওয়া মানুষের পক্ষে নিয়ে আসা।

নির্বাচনের আগে কাস্তিও এবং ভেরোনিকা মেনডোজা দলের পক্ষ থেকে একটি চার দফা কর্মসূচি প্রকাশ করেছেন। কর্মসূচিতে রয়েছে সর্বজনীন টিকাকরণ এবং রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে এবং নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নির্মাণ। রয়েছে দেশের সমস্ত ধরনের কাঁচামালের ওপর রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করা যা দেশে কর্মসংস্থান ঘটাবে। আর বাকি দুই দফা হলো, রাজনৈতিক স্তরে দুর্নীতি নির্মূল করা এবং দেশে গণতন্ত্রকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করা।

এই চার দফা কর্মসূচি রচিত হয়েছে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ফুজিমোরির ১৯৯৩ সালের যে সংবিধান তা বদলের লক্ষ্যে। উন্নয়নের লক্ষ্যে নেওয়া চার দফা কর্মসূচির মধ্যে নিহিত রয়েছে বেসরকারি ক্ষেত্রের ক্ষমতার রাশ টানা, রাষ্ট্রব্যাপী উন্নয়নের বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ, খনি ক্ষেত্রে উন্নততর সংগঠিত কর ব্যবস্থা স্থাপন। কারণ, খনি থেকে আকরিক উত্তোলনের পর্বে বর্তমানে স্থানীয় সরকারগুলিই শুধু আয়ের সুযোগ পায়, জাতীয় স্তরের সামগ্রিক কোনো উন্নয়ন পরিকাঠামো নেই। এবারে নির্বাচনে রাজধানী লিমার অভিজাত এবং ধনীদের যাবতীয় সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা ছিল পেদ্রোর বিরোধী ফুজিমোরির পক্ষে। এদের স্থায়ী সাংসদের সংখ্যা ২৪, যারা সংসদে সর্বতোভাবে বাধা দেবে পেদ্রো কাস্তিওকে। গত একমাস ধরে নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ভেস্তে দেওয়ার জন্য নানা আইনি প্যাঁচ কষে, পুঁজিপতিদের প্রতিনিধি কেইকো ফুজিমোরি কাস্তিওর জয় রোখার সম্ভাব্য সবরকম চেষ্টা করেন। একাধিক মোকদ্দমা করেন জয় আটকাতে। এর পাল্টা পেরুর জনগণ রাস্তায় নামেন। ব্যাপক গণ-আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে পেরু। কেইকো ফুজিমোরি এখন নির্দিষ্ট অভিযোগে কারাগারে।

পেরুর ১৩০ সদস্যের আইনসভায় কাস্তিওর দল ফ্রি পেরু’র ৩৭ জন নির্বাচিত সদস্য রয়েছে। যেখানে ফুজিমোরির পপুলার ফোর্স পার্টির ২৪ জন সদস্য রয়েছে। কাস্তিওকে পেরুর সংসদে শ্রমিকমুখী আর্থিক সংস্কার করার প্রশ্নে ব্যাপক বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হবে বলে মনে করা হচ্ছে। তাঁকে, এমনকি ইমপিচমেন্টের মুখেও পড়তে হতে পারে। সংসদের বাইরে দেশের গরিব খেটে-খাওয়া মানুষের গণআন্দোলনের স্বতঃস্ফুর্ত যে সমর্থন রয়েছে এবং তা থাকবে পেদ্রোর দিকে। তাঁরা যে ৪ দফা কর্মসূচিকে ভিত্তি করে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে লড়াই করেছেন সেই কর্মসূচি রূপায়ণের প্রশ্নে সংবিধানগতভাবে এগোনোর ক্ষেত্রে উদ্যোগী হতে হবে পেদ্রোকে।

বামপন্থীদের বিরুদ্ধে কুৎসা করার লক্ষ্যে পেরুর দক্ষিণপন্থীরা লাগাতার বলে চলেছেন সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে পেরুর বর্তমান রাষ্ট্রপতি ও তাঁর দলের। এই কুৎসার লক্ষ্য হলো আন্দিজ পর্বতমালার কোলে থাকা পেরুতে আদিম জনগোষ্ঠীর গরিব মানুষ যারা আগাগোড়া কৃষক সন্তান বামপন্থী পেদ্রো কাস্তিও’র দলের কট্টর সমর্থক। বেকায়দায় পড়ে এই আদিম জনগোষ্ঠীর মানুষকেও সন্ত্রাসবাদী বামপন্থী বলে দেগে দেওয়ার একটা চেষ্টা চলছে সেখানে। ধারাবাহিক কমিউনিস্ট বিরোধিতার সঙ্গে ধনীরা পেদ্রোর সরকারের বিরোধিতা করতে বর্ণবাদী প্রচারেও লিপ্ত হচ্ছে। যদিও বামপন্থী আন্দোলনের মূল ধারার সঙ্গেই শ্রমিকশ্রেণি পথেই রয়েছে, তাই এই সময় ঐতিহাসিক সুযোগ রয়েছে পেরুকে গণতন্ত্র এবং ন্যায়ের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবার পথ প্রশস্ত করার। পেদ্রো কাস্তিওকে তাঁর দলের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এই পথে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবার গুরু দায়িত্ব বহন করতে হবে।