দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবিদ্বেষ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা ডেসমন্ড টুটু প্রয়াত
দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবিদ্বেষ বিরোধী আন্দোলনের অনন্য নেতা ডেসমন্ড টুটু’র জীবনাবসান হয়েছে। ২৬ ডিসেম্বর রবিবার কেপ টাউনে নব্বই বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন নেলসন ম্যান্ডেলার সংগ্রামের সঙ্গী টুটু।
দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতি সিরিল রামাফোসা শোক প্রকাশ করে বলেছেন, ‘‘আর্চ বিশপ এমারিটাস ডেসমন্ড টুটু’র প্রয়াণ আমাদের দেশের ইতিহাসে শোকের সেই অধ্যায়ের অন্যতম, যেখানে মুক্তি সংগ্রামে নিবেদিত প্রাণ অসামান্য প্রজন্মের নেতৃবৃন্দকে শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে’’।
ডেসমন্ড টুটু’র প্রয়াণে শোক প্রকাশ করেছেন সিপিআই(এম)’র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং কংগ্রেসের অন্যতম শীর্ষ নেতা সাংসদ রাহুল গান্ধী তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোক জ্ঞাপন করেছেন। শোক প্রকাশ করা হয়েছে সারা ভারত শান্তি ও সংহতি সংগঠন (এআইপিএসও)’র পক্ষ থেকেও।
ইতিহাসের পাতায় দক্ষিণ আফ্রিকার কালো মানুষের অধিকারের লড়াই আন্দোলনের সঙ্গে ডেসমন্ড টুটু’র জীবন মিলেমিশে একাকার। বর্ণ বৈষম্যবাদী ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে মুক্তি সংগ্রামে অপ্রতিরোধ্য ভূমিকার স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৮৪ সালে ডেসমন্ড টুটু-কে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়।
দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবিদ্বেষ জমানার অবসান ঘটে ১৯৯৪ সালে রাষ্ট্রপতি নেলসন ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে। সামাজিক শোষণ মুক্তির আবহেই দেশে আলোড়ন ফেলে ডেসমন্ড টুটু’র ‘রামধনু রাষ্ট্র’ স্লোগান - আক্ষরিক অর্থেই শতাব্দীর পর শতাব্দীজুড়ে চলা আর্থ-সামাজিক বৈষম্য, স্বৈরাচার, নৈরাজ্যের অবসানের বার্তা ছিল যা। আজীবন বীজ বুনেছেন সেই স্বপ্নের দেশ গঠনের। সমর্থন করেছেন এলজিবিটি সমাজের অধিকারকে।
স্বভাবতই শুধু দেশের মানুষের কাছেই নয়, সমানভাবেই বিদেশেও দুর্দান্ত জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। নিজের শোক বার্তায় রাষ্ট্রপতি রামাফোসা জানানঃ ‘‘ডেসমন্ড টুটু ছিলেন প্রবাদ প্রতিম ধর্মীয় নেতা, বর্ণবিদ্বেষ বিরোধী সংগ্রামে অক্লান্ত কর্মী ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মানবাধিকারের প্রচারক।’’
ডেসমন্ড টুটু’র জন্ম ১৯৩১ সালের ৭ অক্টোবর জোহানেসবার্গের পশ্চিমে কার্লসড্রপে। পড়াশোনার শেষে তিনি শিক্ষকতায় যোগ দেন। ১৯৫৮ সালে যাজক হিসেবে যুক্ত হন রোজটেনভিল্লের সেন্ট পিটার্স থিওলজিক্যাল কলেজে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের শেষে যান ব্রিটেনে।
১৯৭৫ সালে ব্রিটেন থেকে ফিরে ঝাঁপিয়ে পড়েন বর্ণবিদ্বেষ বিরোধী আন্দোলনে। ১৯৮০ সালে শ্বেতাঙ্গবাদী প্রশাসন গ্রেপ্তার করে টুটু-কে। কিন্তু ততদিনে দেশের মুক্তিকামী প্রতিটি পরিবারে আপন যাজক এই স্বাধীনতা সংগ্রামী। ডেসমন্ড টুটু’র অহিংসার আদর্শ ছাপ ফেলেছে সমাজে। স্বৈরাচারী সরকার তাঁর পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করে। কিন্তু বেশি সময় টুটু-কে জনবিচ্ছিন্ন রাখতে পারেনি।
ঘরে বাইরে জোরালো ধিক্কারের মুখে প্রশাসন টুটু’র পাসপোর্ট ফেরত দিতে বাধ্য হয়। এর পর তিনি আমেরিকা এবং ইয়োরোপে পাড়ি দেন। দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারের কালো মানুষের ওপরে নির্মম জুলুমের প্রসঙ্গে আলোচনা করেন রাষ্ট্রসঙ্ঘের মহাসচিব, বিভিন্ন রাষ্ট্র প্রধান, রোমান ক্যাথলিক গির্জার প্রধান পোপ এবং নানা দেশের গির্জার যাজকদের সঙ্গে। এই সময়েই টুটু দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী সরকারের ওপরে নিষেধাজ্ঞা ও অবরোধ চাপানোর জন্য আবেদন করেন। একাধিক দেশ তাঁর আহ্বানে সাড়া দেয়।
শুরু হয় মুক্তি সংগ্রামের নয়া অধ্যায়। প্রবল চাপের মুখে স্বৈরাচারী সরকার ১৯৯০ সালে দীর্ঘ ২৭ বছর কারাবাসের শেষে দক্ষিণ আফ্রিকার মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম অগ্রণী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। মুক্তির প্রথম রাত ম্যান্ডেলা কাটান ডেসমন্ড টুটু’র কেপ টাউনের বাড়িতেই। টুটু’র ‘জনতার আর্চ বিশপ’ সম্বোধনটি ম্যান্ডেলারই দেওয়া।
রাষ্ট্রপতি পদে দায়িত্বভার গ্রহণ করেই ম্যান্ডেলা ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশনের চেয়ারম্যান পদে নিযুক্ত করেন অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত ডেসমন্ড টুটু-কেই। এই কমিশন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বেআব্রু করে সাবেক বর্ণবিদ্বেষবাদী সরকারের একের পর এক নৃশংস মানবাধিকার লঙ্ঘনের কাণ্ডগুলিকে।