ভারত-মালদ্বীপ সম্পর্ক কোন পথে
লালন ফকির
দক্ষিণ-মধ্য এশিয়ার ক্ষুদ্র দেশ মালদ্বীপের সাথে ভারতের সম্পর্ক বেশ টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে চলেছে। বিশেষত, মালদ্বীপের পূর্বতন রাষ্ট্রপতি আবদুল্লা ইয়েমেনের সাম্প্রতিক একটি উক্তিকে কেন্দ্র করে বিতর্কের সূত্রপাত ঘটেছে। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক মহলের ধারণা, ভারতে মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি কেন্দ্রের বিজেপি জোট সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি এবং নরেন্দ্র মোদি সরকারকে সামনে রেখে আরএসএস নেতৃত্বাধীন হিন্দুত্ববাদীদের মুসলিম বিদ্বেষও এক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ কারণ। সমগ্র বিষয়টি আলোচনার পূর্বে দেশটির ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান সম্পর্কে কিছু আলোচনা করা যেতে পারে।
প্রজাতন্ত্রী মালদ্বীপ দক্ষিণ মধ্য এশিয়ায় অবস্থিত একটি ক্ষুদ্র দেশ। এর আয়তন মাত্র ৩০০ বর্গ কিলোমিটার। জনসংখ্যা তিন লক্ষের সামান্য কিছু বেশি। শ্রীলঙ্কার ৬৭৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত মালদ্বীপ ১২০০-রও বেশি ক্ষুদ্র প্রবাল দ্বীপ নিয়ে গঠিত। এর মধ্যে ১৯৯টিতে জনবসতি রয়েছে। এই দ্বীপগুলি ভারত মহাসাগরের বুকে মোট ২৯টি দ্বীপবলয় তৈরি করেছে। আয়তন ও জনসংখ্যার নিরিখে এশিয়ার ক্ষুদ্রতম দেশ মালদ্বীপ।
মালদ্বীপকে ১৯৬৯ সালের এপ্রিল পর্যন্ত বলা হতো মালদ্বীপ দ্বীপপুঞ্জ। পূর্বে দেশের শাসক ছিলেন একজন নির্বাচিত সুলতান। ১৯৮৭ সালে দ্বীপপুঞ্জকে অভ্যন্তরীণ স্বশাসনের অধিকার দিয়ে ব্রিটিশ নিরাপত্তার অধীনে রাখা হয়। ১৯৫৩ সালের জানুয়ারি মাসে দেশটি প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়। কিন্তু ১৯৫৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পুনরায় সুলতানি শাসন ফিরে আসে। মালদ্বীপ ১৯৬৫ সালের ২৬ জুলাই পূর্ণ স্বাধীনতা পায় এবং কমনওয়েলথের বাইরে আসে। এরপর গণভোটে দেশটি প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয় ১৯৬৮ সালের নভেম্বর মাসে। রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হন ইব্রাহিম নাসির।
২০০৫ সালের জুন মাসে সংসদ বহুদলীয় ব্যবস্থা চালু করার পক্ষে মত দেয়। নতুন সংবিধান রচনার জন্য তৈরি করা হয় গণপরিষদ। ২০০৮ সালের অক্টোবরে প্রথম বহুদলীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২০১১ সালের শেষার্ধ থেকে রাজনৈতিক অস্থিরতা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। ২০১৮ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়। সেনাবাহিনী শাসনের অধিকার পায়।
২০০৮ সালের পূর্বে ৩০ বছর মালদ্বীপ শাসন করেন মামুন আবদুল গায়ুম। ২০০৮ সালে তিনি নির্বাচন করতে রাজি হন। নির্বাচনে গায়ুম পরাজিত হন। রাষ্ট্রপতি হন নশিদ। ২০১২ সালে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে নশিদ পদত্যাগে বাধ্য হন। এর এক বছর পর এক বিতর্কিত নির্বাচনে মাত্র ছয় হাজার ভোট পেয়ে রাষ্ট্রপতি হন আবদুল্লা ইয়েমেন। ২০১৫ সালে রাষ্ট্রপতি পদে পুনর্নির্বাচিত হওয়ার পর ইয়েমেন তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের জেলে পাঠাতে শুরু করেন। জেলে যান তাঁর সৎ ভাই মামুন আবদুল গায়ুম ও প্রথম নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি নশিদ।
মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে মহম্মদ সোলির জয় নতুন ভৌগোলিক-রাজনৈতিক সমীকরণের সম্ভাবনা তৈরি করে। তিনি ভারতের সাথে সুসম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন এবং চীনের সাথে দূরত্ব বৃদ্ধির কথা বলেন। দীর্ঘদিন যাবত মালদ্বীপের মিত্র এবং রক্ষাকর্তার ভূমিকায় ছিল ভারত। অন্যদিকে চীন তার বিশাল আর্থিক সম্পদের মাধ্যমে মালদ্বীপকে সাহায্য করতে এবং সুসম্পর্ক নির্মাণ করতে আগ্রহী।
মালদ্বীপের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোচনার পূর্বে একটি বিষয়ের উল্লেখ প্রয়োজন যা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। নির্বাচিত প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি মোহাম্মেদ নশিদের মুক্তির নির্দেশ দিয়েছেন দেশের সুপ্রিম কোর্ট। সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে ২০১৫-তে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার সমস্ত অভিযোগ থেকে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। একইসাথে সুপ্রিম কোর্ট ১২জন আইনসভার প্রতিনিধিকে সাংসদ হিসাবে পুনর্বহাল করার নির্দেশ দিয়েছে। মালদ্বীপের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবদুল্লা ইয়েমেন সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মানতে অস্বীকার করেন এবং দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেন। এরফলে সর্বত্রই প্রতিবাদ ধ্বনিত হয় এবং তৈরি হয় এক চরম অনিশ্চয়তা।
পূর্বেই উল্লেখিত হয়েছে যে, পূর্বতন রাষ্ট্রপতি আবদুল্লা ইয়েমেনের একটি উক্তিকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক বিতর্কের সূত্রপাত। ২০১৮ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইব্রাহিম ইয়েমেন মালদ্বীপ ভূখণ্ড থেকে দুটি ভারতীয় হেলিকপ্টার এবং একটি বিশেষ ধরনের এয়ারক্রাফট প্রত্যাহারের দাবিকে কেন্দ্র করে বিতর্ক তৈরি হয়। মালদ্বীপ সরকারের মতে হেলিকপ্টার এবং একটি বিশেষ ধরনের এয়ারক্রাফট চালানোর প্রযুক্তিগত দক্ষতা মালদ্বীপের বিমানবাহিনীর আছে। তাই একে কেন্দ্র করে ভারতীয় সেনাবাহিনীর মালদ্বীপের ভূখণ্ডে অবস্থানের কোনো প্রয়োজন নেই। মালদ্বীপের শাসকদল প্রগ্রেসিভ পার্টি অব মালদ্বীপের (পিপিএম) অধিকাংশ কর্মী-সমর্থক মালদ্বীপের মাটিতে ভারতীয় সেনাদের অবস্থানকে মেনে নিতে পারছেন না। প্রাক্তন মন্ত্রী লুবনা জাহির এক টুইট বার্তায় বলেছেনঃ ‘‘আমি ভারতীয় খাবার পছন্দ করি, ভারতীয় পণ্য ব্যবহার করি, ভারতীয় ওষুধ পছন্দ করি কিন্তু মালদ্বীপের ভূখণ্ডে ভারতীয় সেনাকে মেনে নিতে পারি না।’’ অপর একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আহমেদ সাউফেন এক টুইট বার্তায় বলেছেনঃ ‘‘দেশের সর্বত্র মালদ্বীপবাসীরা তাদের দেশে ভারতীয় সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে বিরক্ত এবং ক্রুদ্ধ, যার বহিঃপ্রকাশ বিভিন্ন ঘটনায় ঘটেছে।’’
রাজনৈতিক মহলের মত যে, এই সমগ্র প্রচার ইয়েমেনের রাজনৈতিক দল পিপিএম-এর পক্ষ থেকে সংগঠিত করা হয়েছে। এই দলের পক্ষ থেকে গত ২০ নভেম্বর এক টুইট বার্তায় বলা হয়েছেঃ ‘‘মালদ্বীপের আকাশে বাতাসে সর্বত্র ভারতীয় সামরিক বাহিনীর তর্জন গর্জন ধ্বনিত হচ্ছে।’’ কিছুদিন পূর্বে ফুবামুল্লাহ শাহতে মালদ্বীপে ভারতীয় সেনার উপস্থিতির বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ সংগঠিত হয়েছে। সেপ্টেম্বর মাসে মালদ্বীপ ডেমোক্র্যাটিক পার্টির উদ্যোগে ভারতীয় সেনার উপস্থিতির প্রতিবাদে মিছিল সংগঠিত হয়।
প্রসঙ্গত, শ্রীলঙ্কার ন্যায় মালদ্বীপের শাসকদল পিপিএম ভারত ও চীন উভয়ের সাথেই সমান গুরুত্ব সহকারে সম্পর্ক রক্ষা করে না। বিপরীত পক্ষে পিপিএম কিছুটা চীনের অনুকূলে অবস্থান গ্রহণ করে থাকে। এর অন্যতম কারণ হলো ইয়েমেনকে যখন গ্রেপ্তার ও কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয় তখন তাকে সুরক্ষা দিতে ভারত সরকার কোনো ভূমিকা গ্রহণ করেনি বলে ইয়েমেনের অভিযোগ।
মালদ্বীপের ২০১৮ সালে রাষ্ট্রপতি পদে ইব্রাহিম মোহাম্মেদ সলিহ আসীন হওয়ার পর তিনি ‘ইন্ডিয়া ফার্স্ট’ ঘোষণা করেছিলেন। এর প্রতিক্রিয়ায় ভারতও ঘোষণা করে ‘ইন্ডিয়া ওনলি’ নীতি। ভারত-মালদ্বীপ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নতির জন্য সলিহ’র শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এই সময় উভয় দেশই বেশ কিছু পরস্পর স্বার্থ সম্পর্কিত অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।
সলিহ দেশের অন্যান্য রাষ্ট্রনায়কদের ন্যায় বিশ্বাস করতেন যে, ভারতের সাহায্য ব্যতিরেকে মালদ্বীপের অগ্রগতি প্রায় অসম্ভব। মালদ্বীপের অনেক নাগরিক চিকিৎসা এবং পড়াশুনার প্রশ্নে ভারতে আছেন, অনেকে ব্যবসার কাজেও যুক্ত আছেন। পূর্বতন রাষ্ট্রপতি ইয়েমেনের চীন-ঘেঁষা নীতির পরিবর্তনের জন্য সলিহ’র উপর চাপ ছিল। সলিহ’র নিকট এই অবস্থানের পরিবর্তন করা বেশ কষ্টসাধ্য ছিল। তিনি ভারত ও চীনের সাথে মালদ্বীপের কূটনৈতিক সম্পর্কের প্রশ্নে ভারসাম্য বজায় রাখতে চেয়েছেন।
ভারত ও মালদ্বীপের পারস্পরিক সম্পর্কের অবনতি হওয়ার প্রশ্নে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতির বেশ কিছু অভিমুখকে চিহ্নিত করছে। প্রসঙ্গত, মালদ্বীপ প্রধানত সুন্নি মুসলিমদের দেশ। এখানে একমাত্র সুন্নি মুসলিমরাই দেশের নাগরিকত্ব অর্জন করে। ভারতে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষজনের উপর ক্রমাগত হিংসা, বিদ্বেষমূলক প্রচার প্রভৃতির প্রতিক্রিয়া এখানকার জনগণের উপর পড়তে পারে।
মালদ্বীপের শাসকদল পিপিএম তাদের প্রচারমাধ্যমের পরিকাঠামোকে ব্যবহার করে ভারত-বিরোধী প্রচার সংগঠিত করেছে। এই পরিস্থিতিতে নরেন্দ্র মোদি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার গৃহীত ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতি শুধু জাতীয় স্তরেই প্রতিফলিত হচ্ছে তাই নয়, প্রতিবেশী দেশগুলির সাথে সম্পর্কের অবনতি ঘটাচ্ছে। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনতির ক্ষেত্রেও তা প্রতিফলিত হচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকার এখান থেকে শিক্ষা নেবে কী?