আরেক ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতির অপমৃত্যু
তুরস্কের ‘আয়া সোফিয়া’ এখন থেকে মসজিদ
শংকর মুখার্জি
ইস্তানবুলের ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সৌধ ‘আয়া সোফিয়া’কে মসজিদ হিসেবে ঘোষণা করেছে তুরস্কের রাষ্ট্রপতি তায়িপ এরদোগান। গত ১০ জুলাই তুরস্কের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক আদালত এই সৌধকে মসজিদে রূপান্তরের পক্ষে রায় দেয়। ১৬ বছর ধরে এই আইনি লড়াই চলছিল। আদালতের রায় ঘোষণার এক ঘণ্টার মধ্যেই সরকারি সিদ্ধান্তে স্বাক্ষর করেন এরদোগান। এখন থেকে এই সৌধে মুসলিমরা প্রার্থনা করতে পারবেন। ইতিমধ্যে সেখানে নামাজ পড়াও শুরু হয়েছে। প্রায় ১৫০০ বছরের প্রাচীন এই সৌধটি স্থাপত্যের বিচারে এক অপূর্ব নিদর্শন। খ্রিস্টান ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষের কাছেই এটি পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক তুরস্কের জনক কামাল আতাতুর্ক ১৯৩৪ সালে এই সৌধকে মিউজিয়মে পরিণত করেছিলেন। গত আট দশকের বেশি সময় ধরে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সারা পৃথিবীর কোটি কোটি পর্যটক স্থাপত্যের এই অপূর্ব নিদর্শন এবং মিউজিয়ম পরিদর্শন করেছেন। গত বছরও এসেছিল ৪০ লক্ষেরও বেশি পর্যটক। সম্প্রীতির এক অপূর্ব নমুনা হিসেবে দশকের পর দশক বিরাজ করেছে ‘আয়া সোফিয়া’।
এরদোগান তুরস্কের মসনদে বসেন ২০০৩ সালের মার্চ মাসে। এই ১৭ বছরে তাঁর সমস্ত কর্মসূচির অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক তুরস্কের রাজনীতির মূলস্রোতে ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করা। ‘আয়া সোফিয়া’র রূপান্তর সেই লক্ষ্যপূরণের সাথে সঙ্গতি রেখেই করা হয়েছে। তুরস্কের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক আদালত ‘দ্য কাউন্সিল অব স্টেট’। তারাও নিরপেক্ষভাবে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি আস্থা দেখাতে পারেনি। নিজেদের অবস্থানকে সরকারের ইচ্ছার সাথে সম্পৃক্ত করে ফেলেছে। রায়ে বলা হয়েছে: আদালত ‘‘এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, দলিল-দস্তাবেজ এটাকে মসজিদ হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং (সৌধের) এই চরিত্রের বাইরে এর ব্যবহার আইনত সম্ভব নয়। ...১৯৩৪ সালের মন্ত্রীসভার সিদ্ধান্ত এটির মসজিদ হিসেবে ব্যবহারে ইতি টেনেছিল এবং মিউজিয়ম হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছিল যা আইনসমূহের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না।’’ অর্থাৎ কামাল আতাতুর্কের স্বাক্ষরিত তৎকালীন মন্ত্রীসভার সেই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তকে একপ্রকার বেআইনি হিসেবেই ঘোষণা করেছে আদালত।
৫৩২ খ্রিস্টাব্দে বাইজানটাইনরা এই গ্রিক অর্থোডক্স ক্যাথ্রিডালটা তৈরি করে। তখন বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্ত্যানটিনোপল। আজকের ইস্তানবুলই হলো সেদিনের কনস্ত্যানটিনোপল। এর ৯০০ বছর পর ১৪৫৩ সালে অটোমান তুর্কিরা কনস্ত্যানটিনোপল দখল করে। প্রতিষ্ঠিত হয় তুর্কি সাম্রাজ্য। এই অটোমান তুর্কিরাই ‘আয়া সোফিয়া’কে মসজিদে পরিণত করে। তারা ‘আয়া সোফিয়া’র গঠনেও কিছু পরিবর্তন আনে। চার্চের বাইরে চারকোণে চারটি পেনসিল আকৃতির মিনার তৈরি করে। চার্চের অভ্যন্তরে প্যানেল তৈরি করে তাতে দেবতা ও মুসলিম খলিফাদের আরবীতে নাম লেখা হয়; এবং স্বর্ণাভ মোজাইক ও খ্রিস্টীয় মূর্তিগুলিকে ঢেকে দেওয়া হয়। এছাড়া ২৭০ ফুট লম্বা ও ২৪০ ফুট চওড়া ‘আয়া সোফিয়া’র গঠনে আর কোনো মৌলিক পরিবর্তন ঘটায়নি অটোমান তুর্কিরা। ১৯৩৪ সালে মিউজিয়মে পরিণত হবার পর ওইসব মূর্তি, মোজাইক আবার প্রকাশ্যে আসে। বর্তমানে সেগুলির আবার ঢেকে দেওয়া হয়েছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে অটোমান সাম্রাজ্য বর্তমান সিরিয়া, লেবানন, ইরাক, জর্ডন, ইজরায়েল, সৌদি আরব, ইয়েমেন ও এজিয়ান সমুদ্রের দ্বীপসমূহ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে অটোমান সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ে। এর অধিকাংশ বিশেষ করে তুরস্কের প্রায় সমগ্র অঞ্চল অধিকার করে নেয় গ্রিস ও মিত্র শক্তির অন্যান্য দেশগুলি।
১৯২২ সালে মুস্তাফা কামালের নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী বাহিনী গ্রিকদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করে। গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি সুলতানি রাজের অবসান ঘোষণা করে, অবসান ঘটে খলিফাতন্ত্রের। ১৯২৩ সালে গড়ে ওঠে প্রজাতন্ত্রী তুরস্ক। প্রথম রাষ্ট্রপতি হন মুস্তাফা কামাল। গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি মুস্তাফা কামালের উপাধি দেন আতাতুর্ক; যার অর্থ তুর্কি জাতির জনক। কামাল আতাতুর্কের হাত ধরেই গড়ে ওঠে আধুনিক তুরস্ক। বহুবিবাহ বন্ধ হয়। নিষিদ্ধ হয় বোরখা ও ফেজপড়া। চালু হয় আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা। মেয়েরা পেয়েছিলেন ভোটাধিকার ও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকার। এই কামাল আতাতুর্কই ১৯৩৪ সালে ‘আয়া সোফিয়া’কে মিউজিয়মে পরিণত করে সারা বিশ্বে নজির সৃষ্টি করেছিলেন।
ঔপনিবেশিক শাসন-উত্তর সময়ে মুক্তিপ্রাপ্ত জাতিগুলির মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল। তবে এর ব্যতিক্রম যে তৎকালীন বিশ্বে ছিল না তা একেবারেই নয়। আমাদের হাতের সামনেই আছে নেপাল, পাকিস্তান, ইজরায়েল। এই তিনটি রাষ্ট্রই ধর্মের ভিত্তিতে তৈরি হয়েছিল। এই প্রগতিশীল অগ্রগতির প্রত্যক্ষ প্রতিফলন ঘটেছিল কামাল আতাতুর্কের সিদ্ধান্তসমূহে। ভারতেও স্বাধীনতার পর যে রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল তাতেও ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকেই অন্তত সরকারিভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এব্যাপারে যথেষ্ট সতর্ক ও যত্নবান ছিলেন। বিতর্কিত বাবরি মসজিদে ১৯৪৯ সালে তালা দেওয়া এবং সোমনাথ মন্দির পুনর্নির্মাণের প্রশ্নে তাঁর অবস্থান সেই পরিচয়ই বহন করে। কিন্তু এখন সেই ভারতও নেই, নেই সেই তুরস্কও। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বিজেপি-আরএসএস’র নেতৃত্বাধীন এদেশের হিন্দুত্ববাদী শক্তি ৪৬০ বছরের প্রাচীন বাবরি মসজিদকে ধ্বংস করে। ভারত রাষ্ট্র তখন এই সৌধকে বাঁচাতে কোনো দায়িত্বই পালন করেনি। এটা ছিল স্বাধীনতার পর ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রকাঠামোর ওপর সবচেয়ে বড়ো আঘাত। এই হিন্দুত্ববাদী শক্তিই এখন আরও বেশি শক্তি নিয়ে দেশের ক্ষমতায় আসীন। যারা আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক সর্বক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদের অনুপ্রবেশ ঘটাচ্ছে। দেশের বিচারব্যবস্থাও তাদের স্পর্শ থেকে বাইরে থাকছে না। বাবরি মসজিদ সম্পর্কিত রায় সেই সন্দেহকেই ঘনীভূত করেছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত ওই বিতর্কিত জমিতে রামমন্দির তৈরির অনুমতি দিয়েছে। এই রায়ে ইতিহাস, প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ - কোনো কিছুকেই ধর্তব্যের মধ্যে আনা হয়নি। রায় ঘোষিত হয়েছে শুধুমাত্র বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে।
ভারতের মোদী সরকারের মতো তুরস্কের এরদোগান সরকারও অতিমারী কোভিড ১৯ মোকাবিলায় একেবারেই ব্যর্থ হয়েছে। হুহু করে সে দেশে বাড়ছে সংক্রমণ। অনেকটা আমাদের দেশের মতোই। এমনকি বেকারি, ক্ষুধাও অকল্পনীয় উচ্চতায় পৌঁছেছে। এমনিতেই তুরস্ককে ইসলামিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে গত ১৭ বছর ধরে কাজ করে চলেছেন এরদোগান। এইরকম একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য তাই এসময়টাকেই বেছে নেওয়া হয়েছে। যা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মনে এক বিজয়ী ধর্মীয় মনোভাবের জন্ম দেবে। কেননা গত বছরের স্থানীয় স্তরের নির্বাচনে শাসকদল ‘একে পার্টি’ যথেষ্ট ধাক্কা খেয়েছিল। প্রসঙ্গত, তুরস্কের ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী।
ভারতেও নরেন্দ্র মোদী আগামী ৫ আগস্ট রামমন্দিরের ভূমিপুজো করবেন। সরকারের সমস্ত ব্যর্থতা থেকে দেশের মানুষের নজর ঘোরাতেই এই প্রচেষ্টা। এবং দেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতির কফিনে শেষ পেরেকও। তাই এই সময় নির্বাচন। হিন্দু কট্টরবাদী হোক আর ইসলামিক কট্টরবাদী হোক - তাদের সমধর্মী নীতি প্রণয়নের ব্যাপারে ভৌগোলিক অবস্থান কোনো অন্তরায় হয় না। ‘আয়া সোফিয়া’র মসজিদে পরিণত হওয়া কিংবা রামমন্দির নির্মাণের সুচনা সেই সত্যকেই আরেকবার আমাদের সামনে হাজির করল।
কিন্তু সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হলো এই যে, একে একে নিভেছে দেউটি’র মতো ঔপনিবেশিক শাসন-উত্তর সময়ে গড়ে ওঠা জাতিরাষ্ট্রগুলিতে বহু লড়াই-সংগ্রামে অর্জিত ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক মূল্যবোধগুলির একে একে অপমৃত্যু ঘটছে।