কোভিড-১৯ ও ইয়োরোপ
লালন ফকির
কোভিড ১৯ অতিমারী হিসাবে ইয়োরোপে আত্মপ্রকাশ করে চলতি বছরের শুরু থেকে। প্রথম দিকে এর এপিসেন্টার ছিল ইয়োরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। পরবর্তীকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথম স্থান দখলে রাখলেও ইয়োরোপের অন্যান্য দেশ, বিশেষত, ফ্রান্স, জার্মানি,স্পেন প্রভৃতি দেশ আক্রান্তের এবং মৃত্যুহারের নিরিখে তালিকার কিছুটা নিচের দিকে চলে যায়। ব্রাজিল, ভারত, রাশিয়া প্রভৃতি উপরের দিকে চলে আসে। উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলির বিশেষত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইয়োরোপের নাগরিকদের জীবন ও জীবিকা উভয়ই আক্রান্ত হয়ে পড়ে।
অর্থনৈতিক মন্দা এইসব দেশে ২০০৭-০৮ সাল থেকে শুরু হয়েছে এবং বিগত এক দশকের বেশি সময় ধরে তা পরিগ্রহ করেছে এক ভয়াবহ রূপ। এর প্রভাবে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বেকারি, দারিদ্র্য, কর্মচ্যুতি, চাহিদার অভাব প্রভৃতি পুঁজিবাদী ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে সমগ্র সমাজ। এর ফলে বিশেষভাবে মানুষের জীবনজীবিকা সরাসরি আক্রান্ত হয়ে পড়ে, আর তার থেকে জন্ম নেয় অন্যান্য ব্যাধিসমূহ।
এইভাবে যখন বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা নাগরিকদের জীবিকাকে তছনছ করে দিচ্ছে ঠিক তখনই করোনা ভাইরাস জনগণের জীবনকে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।এই পরিস্থিতি বিগত একশো বছরের মধ্যে পৃথিবী দেখেনি। অর্থনৈতিক মন্দা ও করোনার মধ্যে যেকোনো একটির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের অর্থ হলো অপরটির বৃদ্ধির পরিবেশ তৈরি করে দেওয়া। এর সাথে যুক্ত হয় সমস্যাগুলি সম্বন্ধে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব। যেমন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল বা ইয়োরোপের দেশগুলির সরকারের বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর অভিযোগ উঠেছে যে, করোনার সমস্যার গভীরতা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় গুরুত্বই তারা দেয়নি। অর্থাৎ এই অতিমারীর সর্বনাশা প্রভাব সম্পর্কে মানুষকে প্রথম থেকে সচেতন করা হয়নি। তাছাড়া এমনিতেই পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে চিকিৎসা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে প্রতিরোধক চেতনা গড়ে তোলার ওপরে সাধারণভাবে কম গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে। অর্থাৎ মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যসচেতনতা গড়ে তোলা, রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা তৈরি করা প্রভৃতির ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয় না। মধ্যবর্তী স্তরে অর্থাৎ মহামারী ইত্যাদিতে যাতে মানুষ আক্রান্ত হয়ে না পড়ে তার জন্য প্রতিষেধক ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সব থেকে যা গুরুত্ব পায় তা হলো, রোগ নিরাময়কারী চিকিৎসা ব্যবস্থা। এর প্রধান কারণ, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সবকিছুই মুনাফাতাড়িত। আর এই ব্যবস্থায় স্বাস্থ্যক্ষেত্র যেহেতু ব্যক্তিমালিকানাভিত্তিক,তাই মানুষকে রোগমুক্ত করার থেকে কি পরিমাণ মুনাফা অর্জন করা যায় সেটাই হয়ে দাঁড়ায় প্রধান বিষয়। করোনা মোকাবিলার ক্ষেত্রেও এই চিত্র পরিলক্ষিত হয়েছে।
করোনা ভাইরাসের আক্রমণ থেকে মানুষকে রক্ষা করার প্রশ্নে আরেকটি বিষয়ও লক্ষণীয়। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি তুলনামূলকভাবে করোনার বিরুদ্ধে কার্যকর লড়াই করছে,ফলে মৃত্যুহার ও আক্রান্তের সংখ্যা সেখানে কম। উদাহরণ হিসাবে চীন, ভিয়েতনাম, কিউবা, লাওস, উত্তর কোরিয়া প্রভৃতি দেশের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে।এরসঙ্গে ভেনেজুয়েলার নামও উল্লেখ করা দরকার।অন্যদিকে উন্নত পুঁজিবাদী দুনিয়া বা উন্নয়নশীল দেশগুলিতে যেখানেই চরম দক্ষিণপন্থী সরকার ক্ষমতায় আছে সেখানেই মৃত্যুহার বা আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। উদাহরণ হিসাবে বলা চলে,মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র,ব্রাজিল, ব্রিটেন,ভারত প্রভৃতি দেশ।এইসব সরকারের দক্ষিণপন্থী মনোভাবই করোনা থেকে জনগণকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে।
উন্নত-অনুন্নত নির্বিশেষে সমস্ত পুঁজিবাদী দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থা বেসরকারি সংস্থার আওতায় থাকায় জনগণকে অসীম দুর্গতির মধ্যে পড়তে হয়েছে। যেকারণে স্পেনের সরকারকে বাধ্য হয়ে সমগ্র চিকিৎসা ব্যবস্থাকে সরকারি নিয়ন্ত্রণে ফিরিয়ে আনতে হয়েছে। ইতালি,ফ্রান্স,ব্রিটেনে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য সরাসরি অর্থিক সাহায্য দিতে হয়েছে।
ইয়োরোপের অধিকাংশ দেশেই ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি নাগাদ করোনা সংক্রমণ শুরু হয় এবং অল্পদিনের মধ্যেই তা মহামারীর আকার ধারণ করে। ঐ সময়ে ছিল ইয়োরোপের ফুটবল মরশুম। করোনা সংক্রমণের প্রতিক্রিয়ায় ইংল্যান্ডের ইপিএল, ফ্রান্সে ফরাসি লিগ, স্পেনে লা লিগা, ইতালিতেও সিরিয়া প্রভৃতি টুর্নামেন্ট স্থগিত রাখতে হয়। ২০২০ সালে ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপ হবার কথা ছিল। সেটিও স্থগিত হয়ে যায়।
আগেই বলা হয়েছে, ইয়োরোপের দেশগুলির মধ্যে ইতালি সবথেকে বেশি আক্রান্ত হয়ে পড়েছিল। ইতালিতে এমনিতে অর্থনৈতিক বিভাজন দারুণ তীব্র।উত্তরাঞ্চল কম উন্নত। তুলনায় দক্ষিণাঞ্চল কিছুটা বেশি উন্নত। করোনার আক্রমণ যাতে উত্তরাঞ্চল থেকে দক্ষিণাঞ্চলে ছড়িয়ে না পড়ে তা ঠেকানোর দিকে বেশি নজর দেওয়া হয়। প্রথম দিকে এই চেষ্টা কিছুটা সফল হলেও পরে তা হয়নি। উত্তর-দক্ষিণ নির্বিশেষে সংক্রমণ বাড়তেই থাকে। মার্চ মাসের শেষ থেকে সংক্রমণ বৃদ্ধির হার ১২.৩ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১৩.৪ শতাংশ হয়েছিল। জুন মাস পর্যন্ত সংক্রমণ বৃদ্ধির হার অব্যাহত ছিল। সংক্রমণের হার বৃদ্ধির সাথে সাথে দেশের উত্তর থেকে দক্ষিণে মানুষের যাওয়ার হারও বৃদ্ধি পেতে থাকে। বর্তমানে ওই দেশে কোয়ালিশন সরকার ক্ষমতায়। এই জোটে মধ্য বামপন্থী বলে পরিচিত ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (পিডি) যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে ফাইভ স্টার মুভমেন্ট (এমফাইভএম )-এর মতো দল। এই সরকার করোনা মোকাবিলায় জরুরি ভিত্তিতে ২,৫০০ কোটি ইউরোর বিশেষ বাজেট পেশ করেছে। এর মধ্যে ১০০ কোটি ইউরো কর্মসংস্হান এবং আয়ের ব্যবস্থার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে।মার্চ মাসে প্রত্যেক কর্মহীনের জন্য ৬০০ ইউরো বরাদ্দ করা হয়েছিল। একই সাথে ২ মাসের জন্য ক্লোজারের ওপর জারি করা হয়েছিল নিষেধাজ্ঞা। এছাড়া ঋণের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি ঋণের কিস্তি পরিশোধ থেকেও অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল।
ইয়োরোপে ইতালির পর সংক্রমণের দিক থেকে স্পেনের অবস্থান। স্পেনও ইতালির মতো বৈষম্যপীড়িত রাষ্ট্র। স্পেনে সংক্রমণ অতিমারীর চেহারা নেওয়ার মুহূর্তে সারা দেশে ১৫ দিনের জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। পাশাপাশি চলে লকডাউন। হোটেল রেস্তোরাঁ থেকে শুরু করে সর্বত্রই লকডাউনের কঠোর বিধিনিষেধ জারি করা হয়। স্পেনে বর্তমানে সোশালিস্ট প্রধানমন্ত্রী পেড্রো স্যানচেজের নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন সরকার রয়েছে।বর্তমানে সেখানে বিকেন্দ্রীভূত গণতান্ত্রিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা রয়েছে। দেশের চিকিৎসাব্যবস্থা প্রধানত আঞ্চলিক সরকারগুলি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। মার্চ মাসের মধ্যভাগে ৭ ঘণ্টাব্যাপী মন্ত্রীসভার বৈঠক হয়। এই বৈঠক থেকে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং চিকিৎসা নীতি কেন্দ্রীয় সরকার গ্রহণ করে। এরফলে পরিস্থিতির অনেকটাই উন্নতি ঘটে।
ইয়োরোপের অন্যতম ধনী দেশ ফ্রান্সও করোনা মোকাবিলায় হিমশিম খেয়েছে। ফ্রান্সের সরকার করোনা আক্রমণ প্রতিরোধে একদিকে যেমন লকডাউনের পথ গ্রহণ করে, তেমনই অন্যদিকে দেশের স্থানীয় সংস্থার নির্বাচন সাময়িকভাবে স্থগিত রাখে। দেশের ৩৫হাজার স্থানীয় সংস্থার নির্বাচন মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে হবার কথা ছিল। রাষ্ট্রপতি এমানুয়েল ম্যাক্রন দেশের সমস্ত স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ঘোষণা করেন। পরবর্তীকালে হোটেল রেস্তোরাঁ সিনেমাহল প্রভৃতি বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রথমে ভোটগ্রহণ স্থগিত রাখলেও পরবর্তীতে বিভিন্ন মিউনিসিপ্যালিটিতে ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া চালু করা হয়। অবশ্য এই নির্বাচনে খুব কম সংখ্যক ভোটার তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন।
ইয়োরোপের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দেশ ব্রিটেন। এখানে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ অর্থনীতি রাজনীতি সমস্ত ক্ষেত্রেই বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন সামাজিক নিয়ন্ত্রণ আরোপের যে চেষ্টা করেছেন, ব্রিটিশ প্রচারমাধ্যমের একাংশের মতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তেমন নজির নেই। সংসদে এমন আইন প্রণয়ন করা হয় যার দ্বারা জরুরি ভিত্তিতে অবসরপ্রাপ্ত এবং ছাত্রী নার্সদের চিকিৎসার কাজে নিয়োগ করা যায়। মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ নাগাদ একটি বড়ো আকারের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।এর পরিমাণ ছিল ৩৩,০০০ কোটি পাউন্ড স্টারলিং, যা জিডিপি’র ১৫ শতাংশ। এর মধ্যে ২,০০০ কোটি ডলার বিভিন্ন শিল্প সংস্হাকে কর ছাড় এবং অনুদান হিসাবে দেবার জন্য বরাদ্দ করা হয়।
ইয়োরোপে করোনা সঙ্কট এবং সেই প্রেক্ষাপটে সংশ্লিষ্ট সরকারগুলির পদক্ষেপ অন্তত দু’টি বিষয়কে সামনে এনেছে। প্রথমত, স্বাস্থ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবাকে বেসরকারি নিয়ন্ত্রণে দেওয়ার মধ্য দিয়ে জনস্বাস্থ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে রক্ষা করা যায় না। দ্বিতীয়ত, শুধু নিরাময়-প্রতিষেধক ক্ষেত্রেই নয়, নাগরিকদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলাও প্রয়োজন।